সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস আপনাকে ফ্লু বা অন্য যেকোন রোগের বিরুদ্ধে সঠিক সুরক্ষা দিতে পারে। সাধারণ এই বিষয়টি আজকাল আমাদের মুখে মুখে ফেরে, ডাক্তারি বিদ্যা জানা থাকুক বা না থাকুক এটি সবাই জানেন। কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্য হাত সাবান দিয়ে ধোয়ার ধারণাটি সাধারণ মানুষের কাছে আনতে তো বটেই, আবিষ্কার করতেই ডাক্তারদের লেগেছিল অনেকগুলো বছর। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকা এবং ইউরোপের কিছু ডাক্তার রোগী দেখার আগে নিছক পরিষ্কারের আশায় সাবান সহ হাত ধোয়ার কথা না ভাবলে আজো এ নিয়ে সচেতনতা দেখা যেত কিনা তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে।
হাত ধোয়ার সাথে স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকটি প্রথম যার মাথায় আসে তিনি হাঙ্গেরীর চিকিৎসক ইগনাজ শেমেলউইস। ডাক্তার শেমেলউইস ১৮৪৪ থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত ভিয়েনা জেনেরাল হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। সেই সময়ে ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতাল ছিল অন্যতম সেরা মেডিকেল কলেজ এবং এর গাইনী বিভাগ এতটাই বড় ছিল যে, তাকে দুটো আলাদা ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছিল। একটি ওয়ার্ড ডাক্তার এবং তাদের শিক্ষার্থীরা পরিচালনা করতো। অন্য ওয়ার্ডের দায়িত্বে ছিল সাধারণ ধাত্রী এবং তাদের ছাত্রীগণ।
আর এই দুই ওয়ার্ডের মাঝে ছিল বিশাল বড় একটি ব্যবধান। যা পরবর্তীতে স্বাস্থ্য সেবার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসে।
২০১৩ সালে প্রকাশিত জার্নাল অফ দ্য রয়েল সোসাইটি অফ মেডিসিনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ১৮৪০ থেকে ১৮৪৬ সাল পর্যন্ত ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালে ধাত্রীদের পরিচালিত ওয়ার্ডে মাতৃমৃত্যু হার প্রতি হাজার জন্মদানের বিপরীতে ছিল ৩৬ দশমিক ২। অন্যদিকে ডাক্তারদের পরিচালিত ওয়ার্ডে তা প্রায় তিনগুণ বেশি ছিল। প্রতি এক হাজারে এই ওয়ার্ডে মাতৃমৃত্যু ছিল ৯৮ দশমিক ৪।
আরও পড়ুন- স্প্যানিশ ফ্লুঃ পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল যে ভাইরাসে
বিশেষত ডাক্তারদের ওয়ার্ডে “চাইল্ডবেড ফিভার” যা বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় “স্ট্রেপটোকক্কাল ইনফেকশন” নামে পরিচিত, সেই হার ছিল অনেকটা বেশি। শেমেলউইস এই মৃত্যহার নিয়ে তার অনুসন্ধান শুরু করেন এবং তিনি দুই ওয়ার্ডের সেবাপ্রদানের ধরণ নিয়ে প্রথম কাজ শুরু করেন।
প্রথম যে পার্থক্য নিয়ে শেমেলউইস কাজ করেন তা বেশ অদ্ভুতই বলা চলে। ডাক্তারদের ওয়ার্ডে প্রতিবার একেকটি মৃত্যুর পর একজন যাজক নিয়মিতভাবে আসতেন এবং মৃত্যুপথযাত্রী মায়েদের শেষ ধর্মীয় আচার পালনের জন্য একটি ঘন্টাধ্বনি বাজাতেন। এই পদ্ধতি ধাত্রীদের ওয়ার্ডে প্রচলিত ছিল না। শেমেলউইস ধারণা করেন, এই ঘন্টাধ্বনি সদ্য মা হওয়া মহিলাদের মনে হয়তো কোন বিরূপ প্রভান ফেলে থাকে। তিনি ধারণা করতেন হয়ত এই ঘন্টাধ্বনি মহিলাদের মানসিক ভয় জাগ্রত করে। অর্থাৎ তার অবস্থা খারাপ না হলেও কেবল স্নায়ুবিক চাপ থেকেই তার মৃত্যু ঘটছে। শেমেলউইস সেই যাজকের প্রবেশ ওয়ার্ডে সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেন, যদিও তাতে কোনপ্রকার উন্নতি দেখা যায়নি। এই পুরো পরীক্ষার বিবরণ পাওয়া যায় পারডু ইউনিভার্সিটির দর্শনের অধ্যাপক ডানা টুলোডজিকির শেমেলউইস সংক্রান্ত গবেষণাপত্রে, যা পরবর্তীতে “ফিলোসফি অফ সায়েন্স”এ প্রকাশিত হয়।
১৮৪৭ সালে এক সহকর্মী জ্যাকব কোলেস্কচকার মৃত্যু শেমেলউইসের জীবনে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। একটি ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে কোলেস্কচকার স্কালপেল দিয়ে তার হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলেন। সেখান থেকে একটি ইনফেকশন প্রাণ কেড়ে নেয় তার। শেমেলউইস ধারণা করেন, এমন কোন ইনফেকশনই কি তবে তার রোগীদের মৃত্যুর কারণ কিনা।
আরও পড়ুন- করোনাভাইরাস নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কেন বিশ্বাসযোগ্য নয়
আরও পড়ুন- চীন যেভাবে করোনাভাইরাস জয়ের পথে
আরও পড়ুন- সাবান বনাম করোনাভাইরাস
শেমেলউইস জানতেন প্রায়ই ডাক্তাররা বিভিন্ন অপারেশনের পরেই এই ওয়ার্ডে রোগী দেখতে আসেন। আর জীবাণুর বিরুদ্ধে তখনো কোন প্রকার ব্যবস্থাই তারা রাখতেন না। শেমেলউইস পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হন, তার বন্ধুর ক্ষতস্থান দিয়ে মৃতজীবি কোন প্রাণীর প্রবেশ ছিল, যা মূলত ইনফেকশন এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। সেখান থেকেই তার মনে ধারণা আসে, ডাক্তারদের এই অপরিচ্ছন্ন হাতই হয়ত বাচ্চা জন্মদানের সময় মায়েদের মাঝে জীবাণু সংক্রমণ ঘটায়, যা থেকে বাড়তে থাকে মৃত্যুর হার।
যদিও শেমেলউইসের ধারণা একেবারেই ঠিক ছিল না। তবে তাতে বেশ কাজ হয়েছিল। তিনি ওয়ার্ডে ডাক্তারদের অপারেশনের পর রোগী দেখার আগে ক্লোরিন পানিতে হাত ধোঁয়া বাধ্যতামূলক করেন এবং তা থেকে মৃত্যুহার অনেকটাই কমে আসতে শুরু করে। এবং ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৯ পর্যন্ত ডাক্তারদের ওয়ার্ডে মাতৃমৃত্যু হার ধাত্রী ওয়ার্ডের সমপর্যায়ে নেমে আসে।
এরপরের কাহিনী বেশ কয়েকভাবে ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে। কারো কারো মতে, শেমেলউইস ভিয়েনার সব হাসপাতালেই পরিচ্ছন্নতার উপর জোর দিয়ে থাকেন এবং সবাই তা মেনে নেয়। আবার অনেকের মতেই, ডাক্তাররা কোনভাবেই নিজেদের জায়গা থেকে মায়েদের মৃত্যুর দায় নিতে চাইতেন না। বেশ একটি বিতর্ক তাদের মাঝে দেখা দেয়।
কিন্তু শেমেলউইস বিশ্বাস করতেন, সকল চাইল্ডবেড ফিভারই ইনফেকশনজনিত কারণেই ঘটে থাকে। যদিও তা পুরোপুরি সত্য ছিল না। কারণ, চাইল্ডবেড ফিভার ধাত্রী ওয়ার্ড তো বটেই, বাড়িতে সন্তান জন্ম দেয়া মায়েদের মাঝেও দেখা যেত।
আরও পড়ুন- বাদুড়েই কেন এত সব ভাইরাসের বাস
আরও পড়ুন- চীন থেকে কেন নতুন সব ভাইরাস ছড়ায়
তবে শেমেলউইসই এই ব্যাপারে প্রথম ছিলেন না। ১৮৪৩ সালে মার্কিন চিকিৎসক অলিভার উইন্ডেল হোমসও দাবী করেন ডাক্তারদের অপরিচ্ছন্ন হাত চাইল্ডবেড ফিভারের জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী। যদিও সে সময়ে ডাক্তারগণ এই কথায় কোনভাবেই বিশ্বাস করতেন না। এছাড়া আধুনিক নার্সিং জগতের কিংবদন্তী ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল তার ১৮৬০ সালে প্রকাশিত ‘নার্সিং’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “প্রত্যেক নার্সকেই কাজের সময় নিয়মিতভাবে তাদের হাত পরিষ্কার করার ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত।“
যদিও এসব কিছুই ডাক্তারদের মাঝে পরিবর্তন আনেনি, যতদিন না বিজ্ঞানীরা জীবাণু ধ্বংস নিয়ে একেবারেই নিখুঁত তথ্য উপস্থাপন করেন। ব্রিটিশ সার্জন জোসেফ লিস্টার সার্জনদের হাত ধোয়ার অভ্যাস এবং দুই অপারেশনের মাঝে যন্ত্রপাতি স্টেরিলাইজ করার মাধ্যমে রোগী মৃত্যুর হার অনেকটা কমিয়ে এনেছিলেন।
আর বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধোঁয়া। যা আপনাকে এই মরণব্যাধী থেকে সুরক্ষা দিবে। আজকের আধুনিক যুগে তাই ধন্যবাদ জানাতেই হয় সেসব ডাক্তারদের যারা সহকর্মীদের বিরোধীতার মুখেও বারবার বলে গিয়েছেন সামান্য এই পরিচ্ছন্ন হাতের ব্যাপারে।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ
আরও পড়ুন- করোনা সংকটে যত জানা অজানা
আরও পড়ুন- করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যত ভ্রান্ত ধারণা
আরও পড়ুন- করোনা ঠেকাতে করণীয়
আরও পড়ুন- একটি মৃত্যু জন্ম দিয়েছে হাজারো প্রশ্নের
আরও পড়ুন- ভয়াবহ কোন সংক্রামক ভাইরাস সম্পর্কে বারবার সতর্ক করেছিলেন বিল গেটস
আরও পড়ুন- ঘরবন্দি দিনও কাটুক আনন্দে
আরও পড়ুন- সিনেমায় ভাইরাস
আরও পড়ুন- কোয়ারেন্টিনের অতীত থেকে বর্তমান