করোনাভাইরাস বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এমন খবর বের হওয়া মাত্র বাজারে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটিস উপর চাপ পড়েছে তা হলো স্যানিটাইজার। যেকোন প্রকার স্যানিটাইজার এখন বাজারে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিভিন্ন স্থানে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম ৩০০ থেকে ৪০০ পর্যন্ত রাখা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অনলাইন শপিং ওয়েবসাইটেও দেখা মিলেছে চড়া দামের স্যানিটাইজার।
যেহেতু বিভিন্ন সংক্রামক ভাইরাস, হোক সেটি সাধারণ কোন ফ্লু বা করোনাভাইরাসের মত প্রাণঘাতী কোন ভাইরাস, হাত থেকেই মূলত এসব ভাইরাস মুখ-নাকের মাধ্যমে মানব দেহে প্রবেশ করে। অসুস্থ ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে কিংবা তার হাঁচি কাশির মিউকাস বাতাসে ভেসে কোন স্থানে পড়লে কেউ যদি তাতে হাত রাখে তবে তার দেহে করোনাভাইরাস প্রবেশের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
একারণেই কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সুরক্ষা প্রশ্নে সবার আগে যার নিরাপত্তা দরকার তা আমাদের হাত। আর হাতের সুরক্ষায় দরকার স্যানিটাইজার বা সাবান। বিগত দুই সপ্তাহে রীতিমতো পাল্লা দিয়ে বেড়েছে স্যানিটাইজারের দাম। এবং তা কেবল বাংলাদেশে না বরং সারা বিশ্বের ক্ষেত্রেই সত্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন শপিং ওয়েবসাইট e-bay থেকে ১৩৮ ডলারেও স্যানিটাইজার বিক্রির ঘটনা ঘটেছে। স্যানিটাইজারে থাকা ৬০ শতাংশ অ্যালকোহল ভাইরাসের বিপক্ষে ব্যাপক কার্যকরী প্রমাণিত হবার কারণে স্যানিটাইজার বেশ জনপ্রিয় হয়ে পড়েছে।
কিন্তু আমেরিকার ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন সেন্টার, যা আমাদের দেশে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা কেন্দ্রের মতোই কাজ করে তাদের মতে, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের চেয়ে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে ভাল সুরক্ষা দিতে পারে সাবান। প্রাচীন এবং কিছুটা প্রথাগত হবার কারণে অনেকেই সাবানকে খুব বেশি গুরুত্ব না দিলেও তারা মার্কিন জনগণকে আহ্বান করেছেন সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে। সাবান বলতে কেবল যে প্রচলিত অর্থে শক্ত সাবান বোঝানো হয়েছে তাই নয়, এটি তরল হ্যান্ডওয়াশ সাবানও ইঙ্গিত করে। কারণ আপনি যখন সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করছেন তখন আপনি কেবল হাত পরিষ্কারই করছেন না বরং ভাইরাসকে একেবারেই ধ্বংস করে দিচ্ছেন।
সাবান কি?
প্রথমেই দেখা যাক আসলে সাবান কি? সাবান এমন একটি রাসায়নিক বস্তু যাকে রসায়নের ভাষায় বলা চলে ‘অ্যাম্পিফিলিস’। এটি এমন একটি মলিকুল যা দ্বৈত আচরণ প্রকাশ করে। এর একপ্রান্ত পানিতে আকর্ষিত হয় এবং অন্যপ্রান্ত আকর্ষিত হয় তেল বা চর্বি জাতীয় উপাদানের ক্ষেত্রে।
সাবানের এই দ্বৈত আচরণই মূলত সাবানকে বেশ কার্যকরী করেছে। ধরুন আপনার হাতে তেল আছে। এই অবস্থায় সেটি পরিষ্কারের ক্ষেত্রে সাবানই কার্যকরী। কারণ তেল কখনোই পানিতে মেশে না। সুতরাং এমন অবস্থায় সাবান ব্যবহার করা হলে তেল হাতের পৃষ্ঠতল থেকে আলগা হয়ে যাবে যার ফলে পয়ানি দিয়ে ধুয়ে নিলেই তা চলে যাবে। আর কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে সাবান ঠিক এভাবেই কাজ করে থাকে।
কোভিড-১৯ সহ যেকোন প্রকার করোনা প্রজাতির ভাইরাস জিনগত ভাবেই একটু তৈল ধর্ম প্রদর্শন করে। যেহেতু এটি আরএনএ(RNA) ঘটিত ভাইরাস এবং এর আবরণ প্রোটিন এবং ফ্যাট দিয়ে তৈরি তাই সাবান ব্যবহার করা হলে এর উপরের লিপিড ও প্রোটিনের স্তর ভেঙ্গে যায়, যা আপনাকে সরাসরি ভাইরাস থেকে মুক্ত করতে সক্ষম। তাই হাতের কাছে পানি ব্যবহারের সুবিধা থাকলে অবশ্যই সাবান ব্যবহার করুন।
সাবান যে কেবল করোনাভাইরাস থেকেই সুবিধা দিবে তাই নয়। এটি ক্ষারীয় হবার কারণে যেকোন জীবাণু থেকেই সুরক্ষিত রাখবে আপনাকে। তবে ভাইরাস দূর করার পুরো কাজটা করতে সাবানের খানিক সময় লাগে। তাই কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সময় নিন।
সময় লাগার পেছনে কারণও আছে। আপনার হাত একেবারেই সমান কোন পৃষ্ঠতল নয়। হাতের ভাঁজ, এবং বিভিন্ন রেখার ভাঁজে, আঙ্গুলের ফাঁকে যেতে সাবানের কিছুটা সময় দরকার। এরপর কিছুটা সময় লাগে রাসায়নিক বন্ধন গঠনের ক্ষেত্রে যা আপনার হাত থেকে ভাইরাসের তৈলাক্ত আবরণকে উঠিয়ে আনবে। সেই সাথে এসময় ভাইরাসের প্রোটিন আবরণ ভাঙনের কাজও চলতে থাকে। তবে সব মিলিয়ে ২০ সেকেন্ড বেশ যথেষ্ট সময়।
অন্যদিকে স্যানিটাইজারের মূল উপকরণ অ্যালকোহলও অ্যাম্পিফিলিক বলা চলে। এর কাজের ধারাও প্রায় সাবানের মতোই। তবে এক্ষেত্রে অ্যালকোহল বিশুদ্ধতা এবং এর ব্যবহার মাত্রা খুবই নিঁখুত হবার দরকার পড়ে। স্যানিটাইজারের প্রধান উপকরণ লাইসল সাবানের মতই কাজ করে তবে সেটি ত্বকের জন্য খানিক ক্ষতিকর। তাই স্যানিটাইজার কেনার সময় আগে যাচাই করে নিন।
স্যানিটাইজার সাবানের মতই কার্যকরী হলেও এর একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আপনার হাত যদি ভেজা থাকে কিংবা ঘর্মাক্ত থাকে তবে স্যানিটাইজারের কার্যকারীতা খানিক কমে যেতে পারে। এছাড়া স্যানিটাইজার আপনার হাতের গ্রিজ বা তৈলাক্ত ভাব দূর করেনা তাই ভাইরাসের আশঙ্কা খানিকটা থেকেই যায়।
মার্কিন ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন সেন্টার এর পালি থরডারসন বলেন,
“সাবান আসলে কখনোই ব্যর্থ হচ্ছেনা। সাবান কিভাবে তৈরি সেটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনার ব্যবহার্য সাবান যে অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল হতে হবে এমন কোন বাধ্যতা নেই। ঠিক একইভাবে খুবই শক্তিশালী ডিটারজেন্ট হতে হবে তাও না। সাধারণ শরীরে ব্যবহার উপযোগী সাবানই যথেষ্ট। আপনি যদি খানিক সময় দিয়ে থাকেন তবে সাবান নিজের কাজ করে নিতে সক্ষম।“
তাই স্যানিটাইজারই যে ব্যবহার করতে হবে এমন কোন কথা নেই। বরং এর পরিবর্তে সাবান ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। আপনার কাছে মনে হতে পারে আপনি কেবলই হাত ধুচ্ছেন, কিন্তু মনে রাখবেন এই পুরো সময়টা জুড়ে আপনার হাতের বিভিন্ন ভাঁজে একেবারেই ন্যানো পার্টিকেলের আকারে এক যুদ্ধ চলছে। যে যুদ্ধে আপনার হয়ে সাবান হারিয়ে দিচ্ছে করোনাভাইরাস সহ সকল রোগ জীবাণুকে। সেই সাথে দূর করছে আপনার হাতের তৈলাক্ত ভাব। আর বিশ সেকেন্ডের এই যুদ্ধে আপনার জয় আগে থেকেই নিশ্চিত।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ
আরও পড়ুন- করোনা সংকটে যত জানা অজানা
আরও পড়ুন- করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যত ভ্রান্ত ধারণা
আরও পড়ুন- করোনা ঠেকাতে করণীয়
আরও পড়ুন- করোনাভাইরাস নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কেন বিশ্বাসযোগ্য নয়
আরও পড়ুন- স্প্যানিশ ফ্লুঃ পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল যে ভাইরাসে
আরও পড়ুন- একটি মৃত্যু জন্ম দিয়েছে হাজারো প্রশ্নের
আরও পড়ুন- ভয়াবহ কোন সংক্রামক ভাইরাস সম্পর্কে বারবার সতর্ক করেছিলেন বিল গেটস
আরও পড়ুন- ঘরবন্দি দিনও কাটুক আনন্দে
আরও পড়ুন- চীন যেভাবে করোনাভাইরাস জয়ের পথে
আরও পড়ুন- চীন থেকে কেন নতুন সব ভাইরাস ছড়ায়
আরও পড়ুন- বাদুড়েই কেন এত সব ভাইরাসের বাস
আরও পড়ুন- সিনেমায় ভাইরাস