Site icon Bangla Info Tube

চীন থেকে কেন নতুন সব ভাইরাস ছড়ায়

করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চায়নার উহান শহরের বন্যপ্রাণী কেনাবেচার এক বাজার থেকে ; Photo Credit: Robert Ng/South China Morning Post/Getty

Reading Time: 4 minutes

সবখানে আলোচনার বিষয় যেন এখন একটাই । করোনা ভাইরাস! সাধারণ জ্বর, শুকনো কাশি আর শ্বাসকষ্ট থেকে ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে ওঠা এই ভাইরাস হয়ে উঠেছে প্রাণঘাতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ১৫২টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। এসব দেশে আক্রান্ত হয়েছে অন্তত ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩৪৪ জন। আর মৃতের সংখ্যা ৭ হাজার ১৯। এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করে সতর্ক করেছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে ছড়িয়ে পড়ে এই প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস যার আরেকনাম কোভিড-১৯। এর আগে চীনে ২০০২ সালে মহামারির মত করে ছড়িয়ে পড়েছিল সার্স (সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রম) ভাইরাস। যার কবলে প্রাণ হারিয়েছিল ৭৭৪ জন আর আক্রান্ত হয়েছিল ৮০৯৮ জন মানুষ। প্রায় ৩০টির মত দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল সার্স।

কেন চীনেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ?

প্রাথমিকভাবে করোনভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসেবে উহানের সামুদ্রিক ও বন্য প্রাণীর বাজারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। চায়নায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম ৪১ জন রোগীর ২৭ জনই এই বাজারের লোক কিংবা এই বাজারে এসেছিল। অবস্থা বুঝতে পেরে চীন সরকার অতি দ্রুততার সাথে এই বাজারটি বন্ধ করে দেয় ।

২০০২ সালের মহামারি সার্স ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসেবে দক্ষিণ চীনের গুয়াংজু শহরের এমন একটি বাজারকেই শনাক্ত করা হয়েছিল। প্রায় দেড় যুগ পর আরেকটি প্রাণঘাতী ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসেবে আবারও চায়নার বন্যপ্রাণি কেনাবেচার বাজারের দিকেই আঙুল তোলা হল ।

বিভিন্ন পশুপাখি থেকে মানব শরীরে নানান রোগের প্রাদুর্ভাব হওয়ায় ঘটনা বেশ পুরোনো। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন পাখি এবং শূকর থেকেই এসেছে বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু। ইবোলার সংক্রমণ এসেছে বাদুর থেকে, এইচআইভির ভাইরাস এসেছে শিম্পাঞ্জি থেকে। এসব বন্যপ্রাণী থেকে মানবদেহে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে চায়নার নিষিদ্ধ বন্যপ্রাণী কেনাবেচার এই বাজারগুলো।

প্রফেসর পিটার লি চীনের বন্যপ্রাণি ব্যবসা বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, “বিজ্ঞানীদের কাছে বন্যপ্রাণির বাজার থেকে প্রাণঘাতি ভাইরাস ছড়ানোর বিষয়টি মোটেও আনকোরা বিষয় নয়। এসব বাজারে একটি খাঁচার উপর আরেকটি খাঁচার অবস্থান। বন্যপ্রাণির মল, বিষ্ঠা আর শরীরের রোগাক্রান্ত অংশ এরকম এক পরিবেশে ভাইরাস ছড়ানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। প্রাণি থেকে প্রাণিতে রোগ ছড়ানো তখন যেন কেবলই সময়ের ব্যাপার। আর প্রাণির মাংস বিকিকিনির সময়টাতে ক্রেতা বিক্রেতার হাতের সংস্পর্শে তা সহজেই ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। গোটা বিশ্বজুড়ে যে এমন পরিবেশের বাজার আর নেই তা নয় কিন্তু চীনা বাজারগুলোই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে কারণ সবচেয়ে বেশি প্রকারের মাংস বিশেষ করে বন্যপ্রাণির সরবরাহ যে চীনা বাজারেই অনেক বেশি দেখা যায় ! ”

Teh Eng Koon/AFP via Getty

আর বন্যপ্রাণীর বাজার সম্প্রসারণে প্রত্যক্ষভাবে রয়েছে চীন সরকারের হাত। পুরো ব্যাপারটি বুঝতে হলে আমাদের যেতে হবে সত্তরের দশকে। সত্তরের দশকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে চীন। যার ফলে ৩৬ মিলিয়নেরও বেশি লোকের মৃত্যু হয়। তখনকার কমিউনিস্ট সরকার প্রায় ৯০০ মিলিয়ন লোকের খাদ্যের প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিল। ১৯৭৮ সালে এসেও যখন সরকার সবার খাদ্য সরবরাহ করাতে ব্যর্থ হল এক প্রকার বাধ্য হয়েই তখন তারা ব্যক্তি পর্যায়ে খামার করার অনুমতি দেয়।

তখন চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ক্রমশ পোল্ট্রি আর শূকরের মাংস উৎপাদনের পাশাপাশি ছোট ছোট খামারিদের উদ্যোগে বন্যপ্রাণির মাংসের বাজারের বিস্তৃতি বেড়ে যেতে থাকে। প্রাথমিকভাবে মানুষ নিজ বাড়িতে, উঠোনে কাছিম, সাপ এগুলোর চাষ করতে থাকে। আর সরকারও মানুষের আয়ের উৎস হিসেবে একপ্রকার বাধ্য হয়েই এর সম্প্রসারণে সহায়ক হয়ে ওঠে । কারণ প্রবল দারিদ্রের সে সময়টায় মানুষ যে করেই হোক নিজের দারিদ্র দূরীকরণে কাজ করলে সরকারের তাতে সায় প্রদান না করে উপায় ছিল না। ১৯৮৮ সালে চীন সরকারের কিছু পদক্ষেপ চীনে বন্যপ্রাণির বাজারকে একেবারে বদলে দেয়। তারা বন্যপ্রাণি সংরক্ষন আইন যেটি কিনা রাজ্য সরকারের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত, সেটিকে সংশোধন করে ‘বন্যপ্রাণি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার’ করার আইনে পরিণত করে।

প্রফেসর লি মনে করেন এটি ছিল অন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যদি কেউ বন্যপ্রাণিকে প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করে তার মানে দাঁড়ায় এটি মানুষের স্বার্থেও ব্যবহারযোগ্য। এই আইনে বন্যপ্রাণি গৃহে উৎপাদন এবং উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়ার কথা বলা হয়। আর এভাবেই বন্যপ্রাণীর এক বিশাল বাজার চায়নায় গড়ে উঠে। ছোট ছোট খামারগুলো পরিণত হয় অতিকায় কোম্পানিতে। যার ফলে দেখা যায় মাত্র ৩ টি ভাল্লুকের খামারে এক সময় হাজারের ও বেশি ভাল্লুক পালন করা হচ্ছে। এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে।

David Wong/South China Morning Post/Getty

ধীরে ধীরে খামারিরা নানান প্রজাতির বন্যপ্রাণি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করা শুরু করে। একে একে বাঘ, বন্য শুয়োর, বনরুই আসতে থাকে চীনের বাজারে। আর এটি অনেক ভাইরাসের আগমনের পথকে সুগম করে দেয়। ২০০০ সাল নাগাদ যার কারণে শেষমেষ অনিবার্য ঘটনাটিই ঘটে। ঘটে সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ! বিজ্ঞানীরা খুজে বের করেন যে গন্ধগোকুলই সার্স ভাইরাসের উৎস। চীন সরকার দ্রুত বাজারটি বন্ধ করে এবং বন্যপ্রাণির বাজারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞার মাত্র কয়েকমাস পরেই চীন সরকার ৫৪ প্রকারের বন্যপ্রাণির উৎপাদনের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। বলা বাহুল্য সে তালিকায় গন্ধগোকুল ও ছিল !

২০০৪ সালের মধ্যে এই বন্যপ্রাণির ইন্ডাস্ট্রি ১০০ বিলিয়ন চাইনিজ ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়। আর এই বিষয়টি চীন সরকারকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। চীনের মোট জিডিপিতে এর অবদান অতি ক্ষুদ্র অংশ। ২০১৮ সালে এসে এই বাজারের অর্থমূল্য দাঁড়ায় ১৪৮ বিলিয়ন ইউয়ানে। শরীর গঠন, যৌন শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এসব বন্যপ্রাণির মাংস উপকারী এ ধরণের চটকদার কথা বলা হয় এর বাজার ধরে রাখতে।  যদিও অধিকাংশ চাইনিজরা বন্যপ্রাণির মাংস খায়না। কিন্তু যে স্বল্পসংখ্যক এর প্রধান ভোক্তা তারা ধনী ও ক্ষমতাশীল। যার ফলে চীন সরকার এই ছোট্ট গোষ্ঠীর সুবিধার্তে বাকী বিশাল জনগোষ্ঠীকে একপ্রকার হুমকির মধ্যে রেখেই এই ইন্ডাস্ট্রির চলার ইন্ধন যোগাতে থাকে।

শেষমেষ করোনা ভাইরাসের প্রাদূর্ভাবে আবারো একে নিষিদ্ধ করে চীন। সে কাহিনী তো গণমাধ্যমের কল্যাণে সবারই জানা । গোটা বিশ্বজুড়েই এই বাজার স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধের জন্য চীনকে চাপ দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। পিছিয়ে নেই চাইনিজরাও।  চীনা লোকজন তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এর স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধের জন্য জনমত জানাচ্ছে ।

আপাতত চীন সরকার ও তাদের বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন পুনরায় সংশোধনের কথা ভাবছে। কিন্তু স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ না হলে এরকম অন্যকোনো প্রাণঘাতি ভাইরাস আবারো ছড়িয়ে পড়ার যে সম্ভাবনা যে বেড়ে যাবে তা বলা বাহুল্য।

লেখক- মাহের রাহাত 

Exit mobile version