বিনোদন

When They See Us: বর্ণবাদের নগ্ন সত্য দেখায় যে সিরিজ1 min read

জুন ১৯, ২০২০ 9 min read

author:

When They See Us: বর্ণবাদের নগ্ন সত্য দেখায় যে সিরিজ1 min read

Reading Time: 9 minutes

পরিসংখ্যানে অক্রম নির্বাচন বা র‍্যান্ডম সিলেকশন বলে একটা টার্ম বেশ পরিচিত। অজস্র উপাত্ত থেকে চোখ বুজে গুটিকয়কে বেছে নেয়াই হলো র‍্যান্ডমলি সিলেক্ট করা।

গবেষণায়, আড্ডাচ্ছলে র‍্যান্ডম সিলেকশনের প্রসঙ্গ আসতেই পারে। কিন্তু ভেবে দেখুন তো শাস্তির বেলায় টুক করে একরাশ ব্যক্তিকে বসিয়ে দিলেন গিলোটিনে। অথচ এদের কেউই দোষী নয়, ঘটনা সম্পর্কে নিদেন ধারণাও তাদের নেই।

তবে হ্যাঁ, দোষের হিসেব যদি করতেই হয়- দৈহিক বর্ণকেই আমলে নিন। চমকে উঠছেন কেন? বর্ণবাদের গপ্পো বুঝি শোনেননি? দাসপ্রথার গুটিকয় কাহিনী যে আদতেই মনগড়া নয় সে বিষয়ে সন্দেহ নিশ্চয়ই নেই!

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে গোটা আমেরিকা ফুঁসে উঠেছে ৪৬ বছর বয়সী জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর। ‘Black Lives Matter’ শিরোনামে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের লেলিহান শিখা। দীর্ঘ বঞ্চনার প্রতিবাদস্বরূপ কড়ায় গণ্ডায় মানবাধিকার আদায়ে সরব গোটা বিশ্ব।

সেই প্রবর্তনায় নতুন করে সামনে এসেছে নেটফ্লিক্সের ২০১৯ সালের মিনি সিরিজ ‘When They See Us’। ১৯৮৯ সালে সংঘটিত এক অপরাধের ত্রুটিপূর্ণ তদন্তের ফলশ্রুতিতে পাঁচ নিরপরাধ কিশোরের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাই এর উপজীব্য। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত চার পর্বের এই সিরিজ ওয়েব প্লাটফর্মে মুক্তি পায় গত বছরের ৩১ মার্চ।

প্রচারের পর থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে এই চার পর্বের সিরিজটি। ৬৪-৮৮ মিনিট ব্যাপ্তির প্রতিটি পর্বেই সেন্ট্রাল পার্কের ঘৃণ্য অপরাধ থেকে মামলা চলাকালীন তদন্তের হকিকত এবং পরবর্তীতে দোষী সাব্যস্ত হওয়া পাঁচ কিশোরের প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে।

আভা ডুভারনের নির্মাণে এতে অভিনয় করেছেন জেরেল জেরোম, আসান্টে ব্লাক, কালেল হ্যারিস, মার্কাস রড্রিগেজ, ইথান হ্যারিস প্রমুখ। ব্রাডফোর্ড ইয়ং সিঙ্গেল ক্যামেরার কারিগরিতেই তুলে এনেছেন গত শতকের অন্যতম আলোচিত প্রহসনকে।

Photo: Pinterest

অভিশপ্ত সেন্ট্রাল পার্ক 

১৯৮৯ সালের ১৯ এপ্রিল, ঘড়ির কাটা তখন আট ছুঁইছুঁই। পরিচিত যেকোনো গ্রীষ্মের রাতই ছিল সেটা। কে জানতো মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে বদলে যাবে পাঁচ কিশোর আর এক নারী ব্যাংকারের জীবন!

ম্যানহাটনের সেন্ট্রাল পার্কে ৩০-৩৫ জনের এক কিশোর দল বেরিয়েছিল সেদিন রাতে। হইচই আর পথচারীদের বিরক্ত করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। স্রেফ মজার ছল থেকে ক্রমে ছিনতাই ও বিচ্ছিন্ন হামলায় রূপ নেয় তাদের কর্মকাণ্ড। অনেকটা কৌতূহলের বশেই সেই দলের সাথে মিশে যায় ১৪ থেকে ১৬ বছরের পাঁচ কিশোর- রেমন্ড সানটানা, কোরে ওয়াইস, কেভিন রিচারডসন , এন্ট্রন ম্যাকক্রে, ইউসেফ সালাম।

অন্যদিকে ২৮ বছরের ট্রিশা মেইলি বেরিয়েছিলেন রাত্রিকালীন জগিংয়ে। পার্কের খুব কাছেই ছিল তাঁর দৌড়ের ট্র্যাক। সেদিকে পৌঁছুতেই তাঁর উপর নেমে আসে আকস্মিক ও পাশবিক হামলা। মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করে প্রথমে তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলে হামলাকারী, এরপর ৩০০ ফুট দূরে জঙ্গলের ভেতর টেনে নিয়ে যায় তাঁর নিথর দেহ। ঘণ্টা খানেক পৈশাচিক উপায়ে ধর্ষণের পর তাকে হত্যার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই ঘটে যায় এই নারকীয় হামলা।

চার ঘণ্টা বাদে পুলিশ খুঁজে পায় রক্তাক্ত ট্রিশার দেহ। ততক্ষণে দেহের সত্তর ভাগ রক্তক্ষরণ হয়ে যায় তাঁর, মাথার খুলির কিছু অংশও ছিল ভাঙা ।

গণমাধ্যমে এই বীভৎস হামলার খবর আসতেই ফুঁসে ওঠে নাগরিক সমাজ। সেই সময়ের হট কেকে পরিণত হয় এই মামলা, যার ফায়দা লুটে নেয় বৃহৎ একটি পুঁজিবাদী গোষ্ঠী ও অভিজাত দল।

অকুস্থলের কাছেই যেহেতু একরাশ কৃষ্ণাঙ্গ ও ল্যাটিন কিশোর বেলেল্লাপনায় ব্যস্ত ছিল, দ্রুতই দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিলো পুলিশ। ঘণ্টা খানেকের মাথায় সমন পাঠানো হলো দুই কিশোরের বাড়িতে- এন্ট্রন আর কেভিন। তাদের সূত্র ধরেই রেমন্ড ও ইউসেফের নাম যুক্ত করলো পুলিশ।

প্রাথমিকভাবে কোরেকে তলবই করেনি প্রশাসন। বন্ধু ইউসেফের নির্দোষ অবস্থান প্রমাণ করতে স্টেশনে এসেছিল বছর ষোলোর এই কিশোর। তাঁকেও রেহাই দেয়নি বর্ণবাদের দানবেরা। মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয় নিষ্পাপ ওয়াইসকে; যার পরিণাম ছিল অন্যদের থেকে অনেক বেশি ভয়াবহ।

কলুষিত প্রশাসন এবং নির্দয়ের বিজয়

প্রশাসনিক মদদে তড়িঘড়ি তদন্তে নামে পুলিশ। আটক করা পাঁচ কিশোরকে উপর্যুপরি প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে থাকে তারা। টানা ২৪ ঘণ্টা মানসিক অত্যাচারের চাপে অবশেষে প্রত্যেকেই বাধ্য হয় পুলিশের মনগড়া জবানবন্দি দিতে। এই সময়ে কোন প্রকার খাদ্য বা বিশ্রামের সুযোগও দেয়া হয় নি তাদের।

হামলার স্থানে প্রাপ্ত ডিএনএর সঙ্গে ন্যূনতম মিল না পাওয়া সত্ত্বেও ফাঁসিয়ে দেয়া হয় ইউসেফ, সানটানাদের। আইনানুসারে কিশোর অপরাধীদের জিজ্ঞাসাবাদকালে অভিভাবকের উপস্থিতি আবশ্যক হলেও এক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।

ট্রাম্পের বর্ণবাদী অবস্থান 

পাঁচ কিশোরের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছিল ট্রাম্প; Photo: VOX

১৯৮৯ সালে সালেমের বয়স ছিল মাত্র ১৪। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজও কেঁপে ওঠেন। মিডিয়া আর জনগণের রোষের পাশে তীব্রভাবে আঘাত করেছিল আরেকজনের অবস্থান; আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

সে বছর পহেলা মে তৎকালীন রিয়েল এস্টেট ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশ ঘটা করে বিজ্ঞাপন ছাপালেন চারটি পত্রিকায়। ৮৫,০০০ ডলার খরচা করে দেয়া এই বিজ্ঞাপনের মূল ভাষ্যই ছিল সেন্ট্রাল পার্কের ঘটনায় আটককৃত পাঁচ কিশোরকে মৃত্যুদণ্ডের আওতায় আনা।

 “BRING BACK THE DEATH PENALTY. BRING BACK OUR POLICE!” 

শিরোনামে লেখা এই বিজ্ঞাপনের চুম্বক ভাষ্য তুলে দিচ্ছি এখানে,

‘আমি এই খুনিদের আজীবন ঘৃণা করে যাবো । এই ঘটনার পেছনের কোন ভিত্তি নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে নেই। আমি শুধু এদের শাস্তি চাই। এদের রাগ, ক্ষোভ বোঝার কোন দায় নেই আমার, আমি শুধু চাই এরা জন্মের মতো শিক্ষা পাক, ভীত হোক।‘

এতেই ক্ষান্ত ছিলেন না ট্রাম্প। লাগাতার টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দিয়ে বেড়িয়েছেন। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তার মুখে ছিল এক সুর। ‘মৃত্যুদণ্ড ফিরিয়ে আনাটা জরুরি, আর তার আরম্ভ হতে পারে এই কিশোরদের দিয়েই।‘

সন্দেহাতীতভাবে নির্দোষ প্রমাণিত হবার পরেও ট্রাম্পের পক্ষ থেকে কোন বার্তা আসেনি। উল্টো ২০১৪ সালে এক টুইটার মন্তব্যে সেন্ট্রাল পার্কে সংঘটিত অন্যান্য অপরাধের দায় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায় তাকে।

বর্ণবাদ প্রসঙ্গে মার্কিনীদের অবস্থান প্রসঙ্গে সালেম বলেন, ‘বর্ণবাদ আসলে মজ্জাগত। ট্রাম্পের দিকে তাকালেই আমি বুঝতে পারি, সে আসলে গোটা যুক্তরাষ্ট্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে। আমাদের বিরুদ্ধে শুধু অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু সেই অভিযোগকে জনরোষে পরিণত করায় মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল কিছু নিউ ইয়র্কের কিছু নাগরিক; বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প।‘

সেন্ট্রাল পার্কের ঘটনায় ট্রাম্পের অবস্থান নিয়ে মিডিয়া পরবর্তীতে প্রশ্ন তুললেও খুব একটা আমলে নেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্যাম্পেইন চলাকালে ব্যক্তিগত অবস্থানের সাফাইয়ে বলেন,’ তখন তাঁদের প্রত্যেকই দোষী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। পুলিশি তদন্তের ভিত্তিতেই আমি তাঁদের শাস্তি চেয়েছিলাম। অপরাধের ভয়াবহতার জন্যই তারা জনগণের কাছে ভিলেনে পরিণত হয়েছিল।‘

ভিক্টিমের জবানবন্দি 

বিচারকালীন সময়টায় ট্রিশা মেইলির পরিচয় গোপন রাখা হয়েছিল। দীর্ঘদিন জনসমক্ষে প্রকাশ পায়নি তাঁর তথ্য। পুরো সময়টায় মিডিয়ার কাছে তাঁর পরিচয় ছিল ‘সেন্ট্রাল পার্ক জগার’ হিসেবে।

ঘটনার ১৪ বছর পর, ২০০৩ সালে মেইলি জনসমক্ষে নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন। সে বছরেই তাঁর অভিজ্ঞতা ও গোটা ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেন ‘I Am The Central Park Jogger’ বইয়ে। দুর্ঘটনার পর মোট ১২ দিন কোমায় ছিলেন তিনি। সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে উঠে আসার পর দীর্ঘদিন স্মৃতিবিভ্রমে ভুগতে হয়েছিল তাঁকে।

ট্রিশা মেইলি: যুদ্ধজয়ী এক নারী; Photo: Hollywood Reporter

ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকারের চাকরি থেকেও অচিরে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন সেসময়। তিন যুগ পরেও সেই ভয়ংকর হামলার আঘাতের চিহ্ন বহন করতে হচ্ছে মেইলিকে, ঘ্রাণশক্তিও হারিয়েছেন চিরতরে।

অপরাধের মাত্রা ও বয়স অনুসারে পাঁচ কিশোরকে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সাজার সুপারিশ করা হয়। পরবর্তীতে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ১৯৭৮ সালের কিশোর অপরাধ আইন অনুযায়ী তাঁদের শাস্তির নির্দেশ দেয় উচ্চ বিচারিক আদালত। তবে কোরের বয়স ষোল হওয়ায় তাঁকে পাঠানো হয় প্রাপ্ত বয়স্কদের কারাগারে।

ধর্ষণ অভিযোগের বিপরীতে সেবছরই আপিল করে সানটানা ব্যতীত বাকি চারজন। ১৯৯০ থেকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ভোগ করতে হয় এই ‘সেন্ট্রাল পার্ক ফাইভকে’।

ইউসেফ সালাম: ১৯৯০-৯৬ সাল পর্যন্ত মোট ৬ বছর আট মাস কিশোর সংশোধনাগারে সাজা কাটান এবং প্যারোলে মুক্তি পান।

রেমন্ড সানটানা: সালেমের মতো ১৯৯০-৯৬ অব্দি ৬ বছর ৮ মাস কাটান কিশোর সংশোধনাগারে। পরে প্যারোলে বের হলেও ১৯৯৮ সালে মাদক চোরাচালানের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন এবং সাড়ে তিন থেকে সাত বছরের সাজাপ্রাপ্ত হন। অবশেষে জেল থেকে ছাড়া পান ২০০২ সালে।

কেভিন রিচার্ডসন: ১৯৯০-৯৭, মোট সাত বছর কিশোর সংশোধনাগারে শাস্তি ভোগ করেন। পরে প্যারোলে মুক্তি পান।

এন্ট্রন ম্যাক্ক্রে: বিচারে দশ বছরের সাজা হয় তাঁর। তবে ৬ বছর বাদেই প্যারোলে বেরিয়ে আসেন।

কোরে ওয়াইস: কোরের বিরুদ্ধে অভিযোগনামা ছিল দীর্ঘ। ৬-১৫ বছর সাজার আদেশ প্রাপ্ত হন তিনি। দাঙ্গা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের অভিযোগে মোট ১৩ বছর ৮ মাস কারাভোগ করতে হয় তাঁকে। তবে অন্যদের মতো কিশোর সংশোধানাগারে ঠাই মেলেনি তাঁর। প্রাপ্ত বয়স্ক, দাগী আসামীদের সাথে রাইকার দ্বীপের কারাগারে পাঠানো হয় প্রথমে। ১৯৯১ সালে অ্যাটিকা সংশোধানাগারে , ১৯৯৩ সালে ওয়েন্ডে স্টেট কারাগারে এবং সর্বশেষ অবার্ন স্টেট সংশোধানাগারে স্থান মেলে ২০০১ সালে। শেষোক্ত স্থানেই ঘটনার মূল অপরাধী ম্যাটিয়েস রেইসের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে কোরের। অবশেষে ২০০২ সালে মুক্তি পান তিনি।

লোকচক্ষুর আড়ালে মূল অপরাধী

মূল ঘটনার ১৩ বছর বাদে খোঁজ মেলে আসল অপরাধীর। প্রকৃতপক্ষে ম্যাটিয়েস রেইস নামী এক সিরিয়াল ধর্ষকই ছিল এর মূল হোতা। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্ত এবং একপাক্ষিক বর্ণবাদী মনোভাবের জন্য দীর্ঘদিন সামনেই আসেনি ম্যাটিয়েসের নাম।

২০০২ সালে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে রেস জানায়, এককভাবেই ধর্ষণ ও হত্যাজনিত দুষ্কর্মগুলো করতো সে। সেন্ট্রাল পার্কের ঘটনার ঠিক দুইদিন আগেও ২৬ বছরের এক নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে।

সারাদেশ যখন পাঁচ কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরের ভাগ্যের ছক কষায় ব্যস্ত, তখনই ধরা পড়েছিল ম্যাটিয়েস। ’৮৯ এর ৫ আগস্ট এক নারীর শয়নকক্ষে ধুকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় সে। ভাগ্যক্রমে সেই নারীর আর্তচিৎকারে এগিয়ে আসে প্রতিবেশিরা। পুলিশের হাতে সোপর্দ করতেই বেরিয়ে আসে একটি খুন, পাঁচ নারীকে ধর্ষণ এবং দুইটি ধর্ষণ চেষ্টার রোমহর্ষক বিবরণ। দ্রুতই তদন্ত হয় এই অপরাধের, ৩৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশও মেলে তার।

কারাভোগের সময়েই কোরে ওয়াইসের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে ম্যাটিয়েসের। বার দুয়েক কথা বলেই টের পায়, তার অপরাধের সাজাই ভোগ করছে নির্বিবাদী কোরে। শীঘ্রই জেলা জজ রবার্ট মরগেন্থর কাছে নিজের দোষ স্বীকার করে সে। ততদিনে পঞ্চ কিশোরের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে তেরোটি গ্রীষ্মের জীবন।

জবানির ভিত্তিতে দ্রুত তদন্তে নামে পুলিশ। এক মাসের মাথায় বেরিয়ে আসে সত্য। ঘটনাস্থলে পাওয়া মোজায় মেলে ম্যাটিসের ডিএনএ স্যাম্পল। অপরাধের নির্ভুল বর্ণনা এবং ফরেনসিক রিপোর্টের ভিত্তিতে ৫৮ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পিটার কাসলারো এবং ন্যান্সি রায়ান।

When They See US এর একটি দৃশ্যে পাঁচ অভিনেতা; Photo: Netflix

এতদিন পর দোষ স্বীকার করলেন কেন?’ প্রশ্নের জবাবে ম্যাটিয়েস জানায়, ‘বারো বছর দীর্ঘ সময়। তবুও এতদিন বাদে স্বীকার করার কারণ একটাই, দেরিতে হলেও মনে হয়েছে এটাই সঠিক। এই ঘটনা নিয়ে তখন এত তোলপাড় হয়েছিল, অপরাধ স্বীকারের সাহসটা পাইনি।‘

পাঁচ কিশোর ততদিনে পরিণত যুবক। মামলার সকল এজাহার থেকে নিষ্পত্তি মিললেও পরিবর্তন ঘটেছে তাঁদের চেনা জগতের। বিনা দোষে পূর্ণ সাজা ভোগ করতে হয়েছে প্রত্যেককেই।

মামলার তর্জনী

আভা ডুভারনের ‘When They See Us’ জনতার কাছে পাঁচ কিশোরের প্রতি অন্যায়ের বার্তা পৌঁছানোর সাথে আঙুল তুলেছে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ভূমিকার প্রতিও।

সিরিজে লিন্ডা ফেয়ারস্টেইনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ফ্যালিসিটি হফম্যান। ১৯৭৬ সালে এই ফেয়ারস্টেইন যৌন অপরাধ ইউনিটের দায়িত্ব পান, পরে তাঁর হাতে ভিকটিম ইউনিটের দায় সঁপে দেয়া হয়।

সেন্ট্রাল পার্কের ঘটনাকালে জেলা জজ হিসেবে মামলার তদন্ত ও রায়ে প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল তাঁর। দীর্ঘদিন সুনামের সাথে কাজ চালিয়ে গেলেও সিরিজ প্রচারের পর থেকেই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে লিন্ডার অবস্থান। উপন্যাস লেখিকা এবং আইনজীবী হিসেবে কর্মরত থাকলেও সম্মানের আসন থেকে ছিটকে পড়েছেন।

২০১৮ সালে আজীবন সম্মাননা পেয়েছিলেন ‘Mystery Writers of America’র বরাতে। সেন্ট্রাল পার্ক মামলায় তাঁর প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান জনতার সামনে আসায় সেই সম্মানও প্রত্যাহার করে নিয়েছে লেখকদের এই অংশ। বহু প্রকাশনা সংস্থা এবং আইনজীবী বোর্ড থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে এই বিতর্কিত জজকে।

এহেন সম্মানহানিতে ক্ষেপেও উঠেছেন এই সাবেক জজ। আভার নামে ঠুকে দিয়েছেন মামলা। সিরিজে দেখানো হয়, কিশোরদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে মামলা ঠোকা, ভিত্তিহীন জিজ্ঞাসাবাদ এবং আলামত সরিয়ে নেয়াসহ নানা কাজে লিপ্ত ছিলেন ম্যানহাটনের সাবেক জেলা জজ লিন্ডা।

প্রতিবেদনে যেসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়, সেগুলো হলো-

  • আইন অমান্য করে অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে কিশোরদের জিজ্ঞাসাবাদ করা।
  • ‘ব্ল্যাক, গুন্ডা’ প্রভৃতি অসম্মানজনক শব্দ ব্যবহার করা।
  • কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরদের ‘পশু’ বলে সম্বোধন করা।
  • নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের তদন্তে প্রভাব খাটানো এবং নির্যাতনের নির্দেশ দান।
  • ডিএনএ আলামতকে আমলে না নেয়া।
  • অপরাধ সংঘটনের সময় নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি এবং সহকর্মীকে অন্যায়ভাবে চাপ প্রদান করা।

দ্য দেইলি বিস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অভিযোগ অস্বীকার করেন আভা, ‘মিস ফেয়ারস্টেইনের সাথে বহুবার যোগাযোগ চেষ্টা করেছি। সিরিজ নির্মাণের আগে তাঁর থেকেও তথ্য সংগ্রহ করতে চেয়েছি আমরা। তাঁকে আমন্ত্রণ জানাবার পরেও দেখা দেননি। অগত্যা চিত্রনাট্যকার ও সংগৃহীত উপাত্তের ভিত্তিতেই চিত্রনাট্য লিখতে হয়েছে আমাদের।‘

আভা যোগ করেন, ‘পরবর্তীতে লিন্ডা আমাদের সাথে মধ্যস্থতা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর অংশ ঘষেমেজে দেখাবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, বিনিময়ে আমরাও লাভবান হতে পারতাম। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্যই আমার ভালো মনে হয়নি। এর ফল তো চোখের সামনেই বর্তমান।‘ নেটফ্লিক্সও আভার পক্ষেই শক্ত খুঁটি টেনেছে।

তৎকালীন অভিশংসক এলিজাবেথ লেডেরারও এই অন্যায়ে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিলেন। শ্রদ্ধার আসন থেকে স্খলন হয়েছে তারও। কলম্বিয়া ল স্কুলে অধ্যাপনা থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন এই সিরিজ প্রচারের পর।

সেন্ট্রাল পার্ক ফাইভের বর্তমান

বাম থেকে: এন্ট্রন ম্যাকক্রে , রেমন্ড সানটানা , রিচার্ডসন , ইউসেফ সালাম, কোরে ওয়াইস ; Photo: Film

সময়ের প্রবর্তনায় অনেকটাই এগিয়ে গেছেন সেন্ট্রাল পার্কের পঞ্চপাণ্ডব। রিচার্ডসন বর্তমানে ফৌজদারি বিভাগে আইনজীবী হিসেবে কর্মরত আছেন। নিউ জার্সিতে সংসারও পেতেছেন স্ত্রী আর দুই কন্যাকে নিয়ে। জর্জিয়ার ভূমিতে এন্ট্রন ম্যাকক্রেও সুখী জীবন যাপন করছেন স্ত্রী আর ছয় কন্যার সাথে।

রেমন্ড সানটানা ৪৫ বছরে বয়সেও বেশ চনমনে আছেন। জর্জিয়ায় দীর্ঘদিন যাবত বাস তাঁরও। ২০১৮ সালে একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকে নিজের যাত্রাটা শুরু করেন তিনি। সম্পূর্ণ স্বকীয় নকশায় ‘পার্ক ম্যাডিসন নিউ ইয়র্ক’ নামক পোশাক ব্যবসায় নেমেছেন রেমন্ড।

কোরি ওয়াইস নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন তাঁর মতো নিপীড়িতের স্বার্থে। নিউ ইয়র্কেই আইনজীবী হিসেবে কর্মরত আছেন, সাথে নিয়মিত বক্তব্যও রাখছেন মানবাধিকার ও বিচারিক প্রেক্ষাপট নিয়ে।

ইউসেফ সালামও আইনকেই জীবিকার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। পাশাপাশি কবিতাকেও করেছেন আপন, বক্তা হিসেবেও নাম কুড়িয়েছেন তিনি।জর্জিয়ায় স্ত্রী ও দশ সন্তানকে নিয়ে গুছিয়ে নিয়েছেন আপন স্বর্গ।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের বরাতে জানা যায়, পাঁচ ভুক্তভোগী কিশোরের মামলার প্রেক্ষিতে নিউ ইয়র্ক নগর কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৪১ মিলিয়ন ডলার প্রদান করে । এদের মধ্যে কোরে ওয়াইস পান সর্বোচ্চ ১২ মিলিয়ন ডলার।

২০১২ সালে মুক্তি পায় ‘The Central Park Five’ প্রামাণ্যচিত্রটি।  মামলার আদ্যোপান্ত উঠে আসে এই দুই ঘণ্টার চিত্রায়নে। ভিক্টিমদের প্রবঞ্চিত জিজ্ঞাসাবাদ এবং বর্তমান সাক্ষাৎকার- উভয়ই জানান দেয়, অন্যায়টা শুধু পাঁচ কিশোরের প্রতিই হয়নি, মানবতাও ভুগেছে এর সাথে।

কোরে বলেন, ‘ অনেকদিন পেরিয়েছে। আমরা ক্ষমা হয়তো করেছি, কিন্তু ভুলিনি। টাকা বা অন্য কিছুর বিনিময়ে সেই সময়টাকে আমরা আর ফিরে পাবো না। যা হারাবার আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের কৈশোর,সময়, পরিবার আর নিষ্পাপ জীবন চিরতরে হারিয়ে গেছে।‘

‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের স্রোতে ফের উঠে আসছে বুর্জোয়া শ্রেণির দীর্ঘ শোষণ ও দুঃশাসনের ইতিহাস। পুঁজিপতি সাদাদের গদি হয়তো এবার কেঁপে উঠবে আজন্ম বঞ্চিতদের আঘাতে। প্রতিটি বিশ্ব নাগরিকের প্রত্যাশা এখন শুধু বৈষম্যহীন সুশাসিত এক সমাজ প্রতিষ্ঠার, যেখানে অজস্র শিশুকিশোরের জীবন হবে সরল, নিষ্কলুষ- বৈষম্যের কালি লেপা নয়।

লেখক- সারাহ তামান্না 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *