বিনোদন

সৌমিত্রের প্রস্থান: বাঙালি নবজাগরণের দীপ-নেভা দিন 1 min read

নভেম্বর ১৮, ২০২০ 9 min read

author:

সৌমিত্রের প্রস্থান: বাঙালি নবজাগরণের দীপ-নেভা দিন 1 min read

Reading Time: 9 minutes

নক্ষত্রের পতন বা মৃত্যু হলে কী হয়? ব্ল্যাক হোল? যা ক্রমে গ্রাস করে নেয় আশেপাশের সমস্ত জগতকে, যেখানে বিসর্জিত হয় জীবন। এখানেই আমার আপত্তি। সৌমিত্র নক্ষত্র ছিলেন না, তারকা ছিলেন না- ঘরের ছেলে অপু, উদয়ন মাস্টার বা ক্ষিদ্দা ছিলেন; আটপৌরে ভেতো বাঙালির মাঝে থেকেও ‘ক্লাস’ হয়ে উঠেছিলেন।

মার্জনা করুন- সকল আদর্শ, রুই-কাতলা গুণীজনের সর্বনাম পরিত্যাগ করে বলছি- পুলু ছিলেন বসুন্ধরা। গনগনে সূর্য নন, মহানায়ক নন, কিন্তু প্রাণের অনিঃশেষ সঞ্চয়। নীল-সবুজ গ্রহের সাথেই যেন মানায় তাঁর প্রাণশক্তি। বাঙালিকে তিনি দুহাত ভরে দিয়েছেন- সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, মননে, শিল্পে। তবুও অশ্রুসিক্ত নয়নে ভাবতেন, অনেক ঋণ তাঁর এ জাতির কাছে।

পর্দার প্রথম ফেলু মিত্তির জীবনের মায়া ত্যাগ করেছেন-তা দিন তিনেক। অথচ প্রতি সেকেন্ডে যেন লিখিত হচ্ছে, পঠিত হচ্ছে তাঁর অজস্র গুণগ্রাহীর নিবেদন।

দোলনায় বসে হাসিছে জীবন

রূপালি রিলের জগতে একষট্টি বছর কাটিয়ে গেলেন অপু, অর্থাৎ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। উনিশশো পঁয়ত্রিশের ১৯ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে ক্ষণজন্মা এই মহীরুহের জন্ম। বাংলা চলচ্চিত্র তথা বাঙালির নায়ক হয়ে আবেগে-হাসিতে কাটালেন বছর পঁচাশি। এরপরই মুড়োল অক্ষয় বট। ১৫ নভেম্বর কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে দুপুর বারোটা পনেরোয় চিরপ্রস্থান তাঁর, লড়েছিলেন ৪১ দিন। করোনা, ক্যান্সার আর বার্ধক্য দেহ বধ করলেও আত্মা ছিল চির অম্লান।

মজার কথা কি জানেন, বাংলাদেশের সাথেও নাড়ির টান রয়ে গেছে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র অসীমের। আদিবাড়ি ছিল কুষ্টিয়ায় শিলাইদহের কয়া গ্রামে। দেশভাগের পূর্বেই দাদা পাড়ি দেন ওপারে।

স্কুলের হাতেখড়ি কৃষ্ণনগরেই। পরবর্তীতে হাওড়া জিলা স্কুল পেরিয়ে কলকাতার সিটি কলেজ এবং অবশেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। স্নাতকের বিষয় ছিল বাংলা সাহিত্য।

বাবা ভালোবাসতেন নাটক, কবিতা। সেই হাওয়া লাগলো তাঁর গায়েও। ‘কৃষ্ণনগরে তার বাবা সেখানে শৌখীন নাট্য দলে নাটক করতেন, বাড়িতেও কবিতা আবৃত্তি এবং নাটকের একটা আবহ ছিল। স্মৃতিচারণে তাই বারবারই এই প্রসঙ্গ তুলেছেন,

শৈশবকালে আমরাও বাড়িতে তক্তপোশক দিয়ে মঞ্চ তৈরি করে, বিছানার চাদর দিয়ে পর্দা খাটিয়ে ভাইবোন বন্ধুবান্ধবরা মিলে ছোট ছোট নাটিকার অভিনয় করতাম। বাড়ির বড়রাও প্রচুর উৎসাহ দিতেন। ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ার সময় থেকেই আমার নাটকের নেশা প্রচুর বেড়ে গেল।

স্কুলের মঞ্চে প্রথম অভিনয় করেছিলেন ইংরেজি একটি নাটক- ‘স্লিপিং প্রিন্সেস’, তখন সবে ক্লাস ফোরে। কৃষ্ণনগরের সি এম এস কলেজের প্রিন্সিপাল মিস ম্যাকার্থারই প্রথম বুনে দিয়েছিলেন অভিনয়ের বীজ। সেবার পদক ও মেডেলও পেয়েছিলেন তিনি। ওতেই খিদেটা বেড়ে গেল।

কলেজে নবীনের উত্তাল বাতাস। এর মধ্যেই অগ্রজ এক বন্ধুর প্ররোচনায় দেখতে গেলেন শিশির ভাদুড়ির থিয়েটারে। নেশা ধরে গেল। প্রায়ই রিহার্সালের বেলায় কোণে দেখা যেতে লাগলো ছিপছিপে এক তরুণকে। কলেজের শেষভাগে কোমর বেঁধে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, অভিনয়েই পেশাদারিত্বের ভেজাল সাড়বেন।

প্রতিবার স্বীকার করেছেন, মঞ্চে অভিনয়ের খুঁটিনাটি শিখলেও ওতে বিশেষ কোন লাভ হয়নি ফিল্মের পাতায়। এর উপর ছিল হীনমন্যতার মূর্তিমান আতঙ্ক। তবে গলার জোর, উচ্চারণে আয়ত্ত,নিজের খোলস ভাঙায় বেশ সুবিধে হয় ওতে। আর কে না জানেন, সত্যজিতের অভিনেতাদের উচ্চারণ হওয়া চাই খাসা, পরিচ্ছন্ন!

অপুর অরণ্যে

কিংবদন্তী যেই মানুষটা ২৫০ এর বেশি চলচ্চিত্রে মেধার স্ফুরণ বইয়েছেন প্রথমে তাঁর নাকি আগ্রহই ছিল না সিনেমায়! ভাবা যায়?

যখন তাঁর তরুণ বয়স, বাংলা সিনেমা তখন কিশোর। স্বভাবতই কৈশোরের ভুল-ভ্রান্তিতে মাখা ছিল ও পাড়া। চলচ্চিত্র নিয়ে উচ্চকিত ভাবনা রাখেননি পঞ্চাশের দশকে, কিন্তু দেখে ফেলেছেন ‘বাইসাইকেল থিভস’, ‘ফল অফ বার্লিন’, ‘মিরাকল ইন মিলান’। কিন্তু ‘পথের পাঁচালী’র অতুলস্পর্শী সৌষ্ঠব বিশ্বসহ মুগ্ধ করে তাঁকেও। হলে আসবার পর কদিনের ভেতর দেখে ফেলেন অগুনতি শো। তখন কে জানতো, এই দুর্গার কনিষ্ঠ ভাইয়ের পরিণত রূপই হবেন তিনি!

নবীন কুঁড়ি ছিলেন শর্মিলা-সৌমিত্র যুগল, সেটে সিন বুঝিয়ে দিচ্ছেন সত্যজিৎ; Photo: আনন্দবাজার

বন্ধু অরুণের হাত ধরে সত্যজিৎ রায়ের ইউনিটের নিত্যানন্দ দত্তের সাথে পরিচয়। মানিকবাবু তখন হন্যে হয়ে খুঁজছেন ‘অপরাজিত’র অপুকে। সৌমিত্রকে দেখে হা রে রে করে ওঠেন প্রথম দেখাতেই, ’এঃ হে আপনি যে বড্ড লম্বা হয়ে গেলেন।‘ সেবার অপুর রোল জোটেনি, কিন্তু জহুরির চোখ মেপে নেয় বাচনভঙ্গি, বাংলা উচ্চারণ আর আভিজাত্যের সরলতা। স্মরণ ঘোষালের কাছে চরিত্রটা খুইয়ে হতোদ্যমই ছিলেন।

ফের ডাক পড়ে ‘জলসাঘর’ আর ‘পরশপাথর’ এর শুটিং সেটে। ইতোমধ্যে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও স্টেশনে’ চাকরি হয়ে যায়। তাই কাজ আর অবসরে শুটিং সেটে ঘুরেই সময় কাটতে থাকে। সত্যজিৎ অবশ্য আভাসে জানিয়ে দিয়েছিলেন ‘অপুর সংসার’ এ ‘রোল’ মিলতে পারে। ওদিকে অস্থির চিত্তে অপেক্ষমাণ তিনি।

এমনই একদিনে ‘জলসাঘর’ এর শুটিং শেষে ছবি বিশ্বাসের কাছে সৌমিত্রকে নিয়ে আলাপ করিয়ে দেন ‘মানিকদা’। ‘ছবিদা! এঁর নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ইনিই আমার পরের ছবি ‘অপুর সংসার’ এর অপু।‘

সে এক বাঁধভাঙ্গা উল্লাসের অনুভূতি! চলুন জানি অপুর মুখেই,

‘আমার চোখের সামনে যেন জলসাঘরের সেটের ঝাড় লন্ঠন দুলে উঠলো, পায়ের তলায় মাটি নেই, নক্ষত্রের হাত ধরে উড়ছি। তখনই প্রথম বুঝলাম- উনি আমাকে বরাবর ‘অপু’র জন্যেই ভেবেছিলেন।‘  

অপুর পাট পেয়েই যে শুন্যে ডানা মেলেছিলেন তা নয়। আজকালের মত মিডিয়ার হরকরা ছিল না, বরং শুদ্ধতার চর্চা ছিল প্রবল। তাই মানিক বাবুর হাত ধরেই নিজেকে গড়ে পিটে নিলেন বাঙালির ঘরের ছেলে।

আচ্ছাসে ‘অপরাজিত’ পড়তে বললেন আবার, স্ট্যানসিলভস্কির ‘মাই লাইফ ইন আর্ট’, ‘বিল্ডিং এ ক্যারেক্টার’ নিয়ে আলোচনার পর নিজের সেলফ থেকে নামিয়ে দিলেন ‘এ আক্টর প্রিপেয়ারস’।

৯ আগস্ট, ১৯৫৮। প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবার সাথে সাথে রচিত হল নবজন্মের ইতিহাস। বাঙালির সাহিত্য-চলচ্চিত্র-মননে সেই পঞ্চাশ- ষাট দশকের রেনেসাঁ যে এদের হাত ধরেই এসেছে –তা লুকোবার জো কই!

প্রথম শটে হীনমন্যতায় ভুগেছিলেন। কিছুদিন আগেই বসন্তে ভোগা, শীর্ণ দেহ, হালকা ছোপের আভাস, তাছাড়া নিজেকে ফটোজেনিক ভাবতেন না। তাই ছেড়ে দিয়েছিলেন মানিকদা আর সুব্রত মিত্রের উপর।

বেলাশেষে শুরু করেছিলেন ফের; Photo: The Times of India

সত্যজিতের নায়ক

অপুর সংসার (১৯৫৯) দিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ শুরুর পর ষাট ও সত্তরের দশকে অস্কারজয়ী পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন ১৪ টি চলচ্চিত্রে। পুলুর অবিসংবাদিত ‘মানসপিতা’ হয়ে গেলেন সত্যজিৎ রায়। বার্ধক্যে এসেও তাঁর ‘ছায়া’ অনুভব করতেন তিনি।

চারুলতা’র সেটে গোল বাঁধল, চারুকে অমলের চিঠি লেখার কথা। শ্যুট করতে গিয়েই থামিয়ে দিলেন সত্যজিৎ। জলদ স্বরে বললেন, “তোমার এই হাতের লেখায় হবে না। সেই সময়ের হাতের লেখার মতো করে চিঠি লিখতে হবে।”

সত্যজিৎ ক্যালিগ্রাফি শেখান সৌমিত্রকে। সেবেলা বেশ চ্যালেঞ্জিং চরিত্রই ছিল অমলের। কেননা, ‘নষ্টনীড়’ এর পটভূমি রবীন্দ্র যুগের আগে। তাই হাতের লেখা নিয়ে বিশদ অনুশীলন ছিল অনিবার্য।

সত্যজিতের ঘনিষ্ঠ এবং তথ্যচিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদারের হাতে মেলে অকাট্য প্রমাণ। সৌমিত্রের পাঠাগারে পুরনো খাতা খুঁজে পান তিনি, সেটা চারুলতা ছবির শুটিং কালের।

কবিতা-ছবির খাতা; Photo: The Wall.in

সত্যজিতের সাথে দেবী (১৯৬০), অভিযান (১৯৬২), চারুলতা (১৯৬৪), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৬৯), অশনি সংকেত (১৯৭৩), সোনার কেল্লা (১৯৭৪), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮), ঘরে বাইরে (১৯৮৪), গণশত্রু (১৯৮৯), শাখা প্রশাখা (১৯৯০) চলচ্চিত্রে কাজ করেন।

তাঁর প্রয়াণের পর স্মৃতিচারণ মূলক ‘মানিকদার সঙ্গে’ নামে বইও লেখেন । তার ইংরেজি অনুবাদটির নাম “দা মাস্টার অ্যান্ড আই”।

থিয়েটারে সঁপেছি প্রাণ

মঞ্চ অভিনয় এবং নাট্য নির্দেশনায় অন্যতম সফল নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বলেছিলেন নাটক ছিল তার প্রথম প্রেম। কঠিন শিডিউলের পরেও ছুটে যেতেন মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে।

ফিল্মের দুনিয়ায় পদার্পণের পূর্বে মঞ্চের দীক্ষা পেলেও পেশাদার রঙ্গমঞ্চে নাট্যজীবন শুরু হয় কলকাতার স্টার থিয়েটারে; ১৯৬৩ সালে ‘তাপসী’ নাটকে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে। মৃত্যুঞ্জয় শীলের স্থলে অভিষিক্ত হয়ে ক্রমে নাম জীবন, রাজকুমার, ঘটক বিদায়, হোমাপাখি প্রভৃতিতে অভিনয় করেন।

উত্তম কুমারকে ছাড়িয়ে যাবার প্রেরণা পেতেন তাঁর থেকেই;

অদ্ভুত শৃঙ্খলতাবদ্ধ ছিল তাঁর জীবন। শুটিং বা রঙ্গমঞ্চে, সময়ের এদিক ওদিক সহ্য করতেন না। সমসাময়িক বাণিজ্যিক ধারায় যেমন কাজ করেছেন, তেমনি মঞ্চের শৈল্পিক আবহাওয়াতেও ছিলেন প্রাঞ্জল। এমনকি ‘নীলকণ্ঠে’ মদ্যপ যুবা হিসেবেও ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রপ্ত করে নিতেন ‘টিকটিকি’ কিংবা ‘ফেরা’র মত নাটকের জটিল চালচিত্র। এককালে যাত্রা দলেও ভিড়েছিলেন।

থিয়েটারের জন্য আমার নেশাই বলুন বা ভালবাসাই বলুন, সেটা এত প্রবল ছিল যে সেই কষ্ট আমি খুবই সানন্দে বরণ করে নিয়েছিলাম।

মঞ্চে কিং লিয়ারের সমার্থক সৌম্য বাবু। তবে আজন্ম সাধ ছিল ‘হ্যামলেটে’র। খেটে দাঁড়ও করান এর অনুবাদ, কিন্তু ততদিনে বয়সের চুলে পাক ধরে গেছে। শেক্সপিয়ারের অবিভক্ত অনুরাগী বজ্রকন্ঠে আবির্ভূত হয়েছেন তাই কিং হয়েই।

তার নাট্যরূপ দেওয়া গোয়েন্দা কাহিনী “টিকটিকি” তিনি বিবিসি বাংলা স্টুডিওতে রেকর্ড করেন ১৯৯৭ সালে।

১৯৮৩ সালে ‘রাজকুমার’ নাটকের মঞ্চে সুপ্রিয়া দেবীর সাথে; Photo: আনন্দবাজার

নাটকের জীবনকে সজল রাখতে হাড়ভাঙা শ্রম দিয়েছেন। সিনেমার মত মঞ্চ থেকেও অবসর নেননি শেষ দিন অব্দি।

সমালোচক ছিলেন রাজনীতিরও। বাবরি মসজিদ, দাঙ্গার প্রসঙ্গে বরাবর বলিষ্ঠ মত দেন। বিজেপির নির্বাচনে জয়ের সময় বলেন,

’যেই লোকের মদদে গুজরাট দাঙ্গা হল, তাকেই দেশের লোক ভোট দিচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে মোক্ষম বিকল্পের অভাব।‘ 

নম্রতার সলিল ছিলেন যেন তিনি; Photo: Scroll.in

আপাদমস্তক বিনয়ী বট

কুরোসওয়ার নায়ক যেমন ছিলেন তোশিরো মিফুনে, বার্গম্যানের ম্যাক্স ভন সিডো তেমনইসত্যজিতের নায়কবললে প্রথমেই মাথায় আসবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম। আসলে কিছু অভিনেতারা পরিচালকদের জন্যই হয়তো পৃথিবীতে আসেন।   -প্রথম ছবির ‘ওয়াইফ’ শর্মিলা ঠাকুরের লেখায় এভাবেই ঝরে স্তুতি।

প্রিয় চরিত্র কোনটা? সে বড় কায়দার প্রশ্ন। তাই স্বভাবসিদ্ধ সুষমায় বলেছিলেন,

অভিযান’-এর নরসিং আমার ভালো লেগেছিল। আবারকাপুরুষ’-এর চরিত্রের মধ্যে বাঙালি মধ্যবিত্তের ভীরুতাদ্বন্দ্ব আমার সত্য বলে মনে হয়েছিল। আবার গঙ্গাচরণকে ভালো লাগার কারণ হলো যে ইতিহাসের একটি বিশেষ সময়ে অনেক মানুষের সে প্রতিনিধিস্থানীয়। আমাদের দেশে শিল্পসাহিত্যে, চলচ্চিত্রে তো বটেই, সাহিত্যেও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সংকটেরই প্রাধান্য। সেখানেঅশনি সংকেত’-এর কাহিনির মধ্যে সমস্ত সমাজকে বিড়ম্বিত করেছিল এমন একটি ঘটনা মন্বন্তর, যা নাকি ভারতবর্ষের বুকে কত দিনের অভিশাপের মতো চেপে রয়েছেস্বভাবতই এই কাহিনির নায়ক চরিত্র তাই একটা সামাজিক অবস্থার অত্যন্ত জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।

অভিনয়ে কাব্যের সুর ছিল সাহিত্য আহরিত, চারুলতায় মাধবী মুখোপাধ্যায়ের পাশে; Photo: Wikipedia

ছবিও আঁকতেন নিজমনে। রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার, ভ্যান গঘ সহ নানা মনীষীর প্রতিকৃতি এঁকেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা কারণে নয়, বই পড়ার সুবিধার জন্য বুকমার্ক হিসেবে শেক্সপিয়ারের, রবীন্দ্রনাথ ছোট লম্বা কাগজে আঁকতেন।

নবীন পরিচালকের সাথে অভিজ্ঞতা কেমন? শিবপ্রসাদের কণ্ঠে তৃপ্তি,

 ‘একটা লাল ডায়রি পুষতেন, পাতায় লেখা থাকতো শুটের শিডিউল। একটা লাল রঙের সরু ডায়েরি, যার সমস্ত দিক সবসময় ভর্তি থাকত। ২০১২ নভেম্বর থেকে ওই ডায়েরিতে আমাদের জায়গা হয়।অলীক সুখ’, পোস্ত, বেলাশেষে, প্রাক্তনের ইতিহাস তো জানাই।‘  

সত্যজিতের মাথায় গোয়েন্দা মিত্তির ছিলেন সৌমিত্র; Photo: আনন্দবাজার

গোয়েন্দা ফেলু মিত্তির যখন সত্যজিৎ লেখেন তখনই আগ্রহ ছিল সৌমিত্রের। তবে তাঁকে বাছাই করা পুরোই ছিল মানিকের সিদ্ধান্তের উপর।

সাহিত্যের চরণতলে 

একষট্টিতে নির্মাল্য আচার্যের সাথে মিলে শুরু করেছিলেন লিটল ম্যাগাজিন। নাম খুঁজতে বসে ফের দ্বারস্থ হন মানিকদার। মলাটের ইলাস্ট্রেশনের সাথে সাথে নামটাও ঠাওরে দেন তিনি- ‘এক্ষণ’। প্রিয় পাত্রের ভীষণ স্নেহের ছিল পত্রিকাটি, তাই বোধয় সৌমিত্র সম্পাদনা থেকে সরে এলেও মলাট এঁকে দিতেন সত্যজিৎ।

সম্পাদনার টেবিলে সৌমিত্র; Photo: আনন্দবাজার

কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প আর নাটকে ছিল অবাধ বিচরণ। স্ত্রী দীপাকে চিঠিতে কবিতা লিখে পাঠাতেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জীবনানন্দে প্রভাবিত ছিল লেখনী। আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো ছিলেন বন্ধুসম।

বৃক্ষ শুধু বৃক্ষের মতো নয়

স্থানু হয়ে থাকে না সে

তাঁকে নভোস্পর্শী হতে হয়

আকাশ পাড়ি না দিলে

মর্মস্পর্শী না হলে চলে না।

কবিতায় ছাপ পড়েছে তাঁর ‘বেসিক হিউম্যানিজম’এর। ৪০ বছরে ছাপেন প্রথম কাব্যের বই, শক্তির প্রেরণায়।

কবিতায় প্রকাশ-আড়ালের লুকোচুরি রাখতেন, ভালোবাসতেন পড়তে। তাঁর পড়া শেষ বই ছিল জেমস স্যাপিরোর লেখা ‘১৬০৬: উইলিয়াম শেক্সপিয়র অ্যান্ড দ্য ইয়ার অফ লিয়ার’ ।

অচলায়তন ভাঙা উদয়ন পণ্ডিত; Photo: দৃষ্টিভঙ্গি

মহানায়কের পাড় ভক্ত ছিলেন সৌম্য, লোকে পাল্লা দাঁড় করালেই হেসে বলতেন,

এই তোদের এক কথা! ইস্টবেঙ্গলমোহনবাগানের মতো যেন আমাদের লড়াই! জানিস, উত্তমবাবু অসম্ভব স্নেহ করতেন আমায়। আমি যে কত কী পেয়েছি ওঁর থেকে। তুই যেমন ফ্যান, আমিও তেমনই উত্তমকুমারের ফ্যান!’

মানিকের বাইরেও হীরক

‘অপুর সংসার’ দিয়ে জগতজয়ের আরম্ভ। সত্যজিতের ক্যামেরায় এরপরেই ধরা দেন উমাপ্রসাদ হয়ে, ‘দেবী’ তে। এরপর বদলাতে থাকেন বহুরূপী হয়ে। সত্যজিতের সাথে হ্যাট্রিকের আগেই তপন সিংহের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ (১৯৬০) নাক গলিয়ে বসলো।

এরপরের যাত্রাটা সাহসী। ‘তিন কন্যা’র অমূল্য থেকে একেবারে’ঝিন্দের বন্দি’র ময়ুরবাহন। উত্তম কুমারের সাথে প্রথম স্ক্রিন ভাগাভাগি, তাও খল ভূমিকায়! শিখতে হল অশ্বচালনা।

নাসিরুদ্দিন শাহের সাথে শুটিংয়ে, তিনিও বরাবর গুরু মানেন সৌমিত্রকে; Photo: Bangle Asia

তপন সিনহার পরিচালনায় ক্ষুধিত পাষাণ (১৯৬০), ঝিন্দের বন্দী (১৯৬১), তরুণ মজুমদারের সঙ্গে সংসার সীমান্তে (১৯৭৫), গণদেবতা (১৯৭৮), মৃণাল সেনের পরিচালনায় পুনশ্চ (১৯৬১), প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৬৪), আকাশ কুসুম (১৯৬৫) , অজয় করের নির্দেশনায় সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘সাত পাকে বাঁধা’ (১৯৬২), শর্মিলার সাথে ‘বর্ণালী’তে কাজ করেছেন।

এর বাইরেও ঝাঁকে ঝাঁকে কাজ করেছেন। অপর্ণা সেনের পরিচালনায় ‘পারমিতার একদিন’, ’৬৪ তে ‘কিনু গোয়ালার গলি’, কোনি (১৯৮৬), লাঠি (১৯৯৬),  সৃজিতের ‘হেমলক সোসাইটি’ (২০১২), শিবপ্রসাদ-নন্দিতার বেলাশেষে (২০১৫), পোস্ত (২০১৭), সাঁঝবাতি (২০১৯), গৌতম ঘোষের ‘শূন্য অঙ্ক’, সুমন ঘোষের ‘পদক্ষেপ’, অতনু ঘোষের ‘ময়ূরাক্ষী’ , অসুখ উল্লেখযোগ্য কাজ।

তবে শিল্পিত পরচালকের বাইরেও ছিলেন সব্যসাচী। ‘পরিণীতা’, ‘দেবদাস’, ‘গণদেবতা’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘প্রথম কদমফুল’, ‘তিন ভুবনের পারে’, ‘মাল্যদান’, ‘স্ত্রী’, ‘বাক্স বদল’, ‘বাঘিনী’ প্রভৃতি বাণিজ্যিক বায়োস্কোপ ছিল ব্যবসাসফল ও নন্দিত।

হিন্দি ছবিতেও নাম লিখিয়েছিলেন। নিরুপমা (১৯৮৬) ও হিন্দুস্থানী সিপাই (২০০২) এই দুই হিন্দি ছবিতে করেছেন অভিনয়। পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন ‘স্ত্রী কা পত্র’ (১৯৮৬) তে।

‘ফাইট কোনি ফাইট’- এই মহান সংলাপ অমর হয়ে আছে। কিন্তু মতি নন্দীর লেখা ‘কোনি’তে শ্রীপর্ণা আর তাঁর কাজ করবার কথাই ছিল না।

‘ক্ষিদ্দা’ চরিত্রের জন্য প্রথম পছন্দ ছিল উত্তম কুমার। তাঁর প্রস্থানের পর নাসিরুদ্দিন শাহকে ভাবা হয়। তবে প্রিয় চরিত্রকে পাবার জন্য প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন সৌমিত্র। সহ অভিনেত্রী শ্রীপর্ণার কাছে শুনেছিলেন ক্ষিদ্দার সঙ্গে কোচ অনিল দাশগুপ্তের অনেক মিল আছে। এর পরদিন থেকেই ভোর সাড়ে ৫টায় উনি সুইমিং ক্লাবে হাজির থেকেছেন। পর্যবেক্ষণ করেছেন অনিলকে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আয়ত্ত করে নেন শেষতক।

পুরস্কারে উদাসীন 

অভিনয়ের সাড়ে চার দশক বাদে মেলে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ সম্মান, ২০০৪ সালে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন দুবার।

নাট্যশিল্পে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তা টের পেয়েই ফরাসি সরকারের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মাননা Commandeur de l’ Ordre des Arts et des Lettres প্রদান করা হয় ১৯৯৯ সালে। আর এর আঠারো বছর বাদে ২০১৭ সালে তিনি ফরাসি সরকারের বেসামরিক সম্মাননা লিজিয়ন অফ অনারে ভূষিত হন।

‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার গ্রহণ করেন ২০১২ সালে; Photo: আনন্দবাজার

মহীরুহের জীবন নিয়ে কেউ আলোকপাত করুক না করুক ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্যাথরিন বার্জ নির্মাণ করেন তথ্যচিত্র ‘গাছ’।

ওদিকে ইতালির সিনেমাপ্রেমীরা তাঁকে ভূষিত করেছে লাইফটাইম এচিভমেন্ট পুরস্কারে। ৮ বার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট পুরস্কার পান। অথচ দেশের বাঙালি বা ভারতীয়রা যেন তাঁর মূল্যটাই বুঝে উঠতে পারেনি।

নিপাট ভদ্রলোক হলেও পিছু হটেননি বামপন্থি আদর্শ থেকে। তাই ১৯৭০ সালে অগ্রাহ্য করেন পদ্মশ্রী, ২০০১ সালে ‘দেখা’ ছবিটির জন্য ‘স্পেশাল জুরি আওয়ার্ড’ ফেরান।

জাতীয় পুরস্কারের সম্মান জেতেন ২০০৮ সালে ‘পদক্ষেপ’ ছবিটির জন্য। ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পান ’১২ তে এসে। অতদিনে পুরস্কারের রাজনীতিকে অস্বীকার করতে শিখে গেছেন ‘বর্ণালী’র অশেষ রায়।

ফেলুদার সমার্থক ছিলেন তিনি, বুঝতেন মগজাস্ত্র-চোখের দ্যুতি ছড়াতে হবে চরিত্রে; Photo: আনন্দবাজার

সম্পাদকের দাবিতে তথ্যের ঘনঘটা আবশ্যক, কিন্তু বিষয় যখন সৌমিত্র আবেগকে পাশ কাটানো অসম্ভবেরই নামান্তর। তবু যবনিকা অবশ্যম্ভাবী।

মানুষের সঙ্গে মানুষের সাঁকো ভেঙে যায়

সে কি মানুষেরই উদাসীনতায়?’

কবিতার দীর্ঘশ্বাসের সাথে উবে গেল দীর্ঘ জীবন। বসন্তের অবহেলার আগেই হেমন্তে পাড়ি জমালেন ওপারে। স্নিগ্ধ, অপূর্ব যুদ্ধ শেষে ফিরলেন না ময়দানে। আমাদের মনের অসুখ বুঝি আর সাড়লো না।

– সারাহ তামান্না

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *