ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (দ্বিতীয় পর্ব): The Family Man- অপ্রতিরোধ্য বাজপাই1 min read
Reading Time: 6 minutes‘পানি হিন্দুস্তানেও আছে, পাকিস্তানেও আছে; তারপরও পানি কোথাও নেই। কেননা চোখের পানি পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। আর এই দুটি দেশ এখন ঘৃণার মরুভূমি।‘
দেশবিভাগের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে এভাবেই বলেন উর্দু লেখক কৃষণ চন্দর। সাতচল্লিশে দেশবিভাগের আগে যে হিন্দু-মুসলিম দ্বৈরথ একেবারেই ছিল না তা না, কিন্তু পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ ছিল মূর্তিমান নরকেরই নামান্তর। এসবেরই এক টুকরো জের উঠে এসেছে অ্যামাজন প্রাইমের অরিজিনাল সিরিজ ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’- এ।
কাহিনি সংক্ষেপ
আরব সাগরের বুকে ছোট্ট এক ট্রলার ভাসছে। আপাতদৃষ্টিতে একদম সিধেসাধা জেলে ট্রলার মনে হলেও ভেতরে তাকালেই চোখে পড়বে তরতাজা এক লাশ। সাথে তিন আইসিস ফেরত জঙ্গি- মুসা রেহমান আর তার দুই দোসর। ভারতীয় কোস্টগার্ডদের হাতে ধরা পড়ে তারা। পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার অধীনে থাকা ‘টাস্ক’ ( T.A.S.C.) এর হাতে তুলে দেয়া হয় তাদের। শুরু হয় তদন্ত। তদন্তের মাঝেই আচমকা দিল্লিতে স্কুটার বোম ফাটায় আইসিস জঙ্গিরা। এর মধ্য দিয়েই তদন্তে আসে নয়া মোড়। কী চাইছে তবে আইসিস?
ক্রমেই টাস্কের নজরে আসতে থাকে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা আতঙ্কবাদীদের টুকরো টুকরো প্রচেষ্টার কথা। পুরো তদন্তের দায় পড়ে টাস্কের সিনিয়র কর্মকর্তা শ্রীকান্ত তিওয়ারির কাঁধে, সাথে মেলে জেকে তালপাড়ে, ইমরান পাশা, অজিত আর জোয়া। আইসিসের নাটাইয়ের খোঁজে ধীরে ধীরে বের হয় ভিক্টোরিয়া কলেজের তরুণ করিমের সম্পৃক্ততার খবর। এদিকে শ্রীকান্ত কিন্তু শুধু গোয়েন্দা কর্মকর্তাই নন, ধৃতি- আথার্ভের বাবাও। আর সাথে তো আছেই মিষ্টি স্ত্রী সুচিত্রা। এত কাজের মাঝেও তাঁর অনন্য পরিচয় যেন একজন স্নেহময় পিতা আর প্রেমময় স্বামীর।
তবে পদে পদে ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। করিমের ছোট অপারেশন নিয়ে গোয়েন্দা দল এতটাই ভুল পথে পরিচালিত হয় যে ফাঁকতালে শীর্ষ দুষ্কৃতিকারী সাজিদ ও মুসা ছক কেটে ফেলে ভয়ানক এক হামলার। পাকিস্তানি মেজর সামির ও ফায়জানের দলের সাথে মিলে আরেক ট্র্যাজেডির ছক আঁটতে থাকে আইসিস। প্রশ্ন আসে, কী এই অপারেশন জুলফিকার? আর কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকবে কে তবে? সাজিদ না মুসা? শ্রীকান্ত কি বাঁচাতে পারবে দিল্লিকে? নাকি গোটা দিল্লি হয়ে উঠবে মৃতের শহর?
পরিপক্ব স্ক্রিপ্টে সফলতা
থ্রিলার সিরিজ হোক বা ছবি, অথবা গল্প-উপন্যাস, এর সবচেয়ে বড় সাফল্য লুকায়িত থাকে উপস্থাপন ভঙ্গিমায়। ক্লিফ হ্যাঙ্গারের যথার্থ ব্যবহার, সাসপেন্সে দর্শককে আটকে রাখার ক্ষমতার উপর ভিত্তি করেই মাপা হয় থ্রিলারকে।
‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’- এর প্রতি পর্বের শুরুতেই পর্দায় ভেসে ওঠে ‘ Inspired from daily newspaper.’। এটাই সম্ভবত সিরিজের প্লাসপয়েন্ট। পুরোপুরি কল্পনার উপর ভিত্তি না করে দৈনিক ঘটনা প্রবাহকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এর চার চিত্রনাট্যকার রাজ নিদিমোরু, সুমন কুমার, সুমির অরোরা এবং কৃষ্ণা ডিকে। পরিচালনায়ও ছিলেন রাজ নিদিমোরু-কৃষ্ণা ডিকে। ‘Stree’, ‘Go Goa Gone’, Shor in The City’ র মতো চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন এই জুটি।
আজিম মুলান আর নিগাম বোমজানকে সাথে নিয়ে সিনেমাটগ্রাফিতেও মুনশিয়ানা দেখিয়েছে গোটা দল। কাশ্মিরি আবহের এমন কিছু দৃশ্য উঠে এসেছে এতে যে মাঝপথে ধন্দে পড়ে যাবেন –এ সিরিজ না তথ্যচিত্র! কাশ্মিরি লোকসঙ্গীত ‘হুকুস বুকুস’ ও ‘হারমুক বারতাল’ এর যথাযোগ্য ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। দিল্লীর গলিঘুঁজিতেও যেমন চৌকস ছিল ক্যামেরা, তেমনি ছিল বেলুচিস্তান-শ্রীনগরের ময়দানেও। তবে সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, বাইরের দৃশ্যায়নে পরিচালক যতটা যত্নশীল ছিলেন ততটাই গুরুত্বের সাথে ঘরের গল্পও তুলে এনেছেন।
১০ পর্বের প্রতিটির ছিল টুইস্ট ও গল্পের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নাম। ‘The Family Man’, ‘Sleepers’, ‘Anti National’, ‘Patriots’, ‘Pairah’,’ Dance of Death’, ‘Paradise’, ‘Act of war’, ‘Fighting Dirty’ এবং ‘The Bomb’-প্রতি পর্বেই ছিল শ্বাসরুদ্ধকর রোমাঞ্চ আর অসীম উত্তেজনা।
হিন্দু এমপির বাড়িতে অপারেশনের সময় করিম ও গোয়েন্দা পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার চার মিনিট দীর্ঘ শটের বাস্তবতা ছিল অবিস্মরণীয়। কিছু ক্ষেত্রে দর্শকও করিমের ভীতিটাকে নিজের মধ্যে টের পাবেন। আর ‘আল কাতিল’ তথা মুসার সেই হাসপাতাল হত্যাযজ্ঞ? যেকোনো হরর ছবিকেও টেক্কা দেবার ক্ষমতা রাখে দশ মিনিটের সেই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য। ক্যামেরার এঙ্গেলের সাথে নিরাজের খুনে চেহারা ছিল বোনাস!
তবে মনোজ বাদেও চারজনের কথা ভিন্নভাবে বলতেই হয়- জেকে চরিত্রে শারিব হাশমি, মুসা রেহমান চরিত্রে নিরাজ মাধব, সাজিদ চরিত্রে শাহাব আলী এবং সালোনি চরিত্রে গুল পানাগ।
মালায়ালি নিরাজ মাধবের ক্যারিয়ারের বয়স মাত্র পাঁচ। এর মধ্যেই বিখ্যাত মালায়লাম চলচ্চিত্র ‘চার্লি’, মোহনলালের ‘দৃশ্যম’, ‘পিপিন চুভাতিলে প্রাণায়াম’ প্রভৃতিতে কাজ করে ফেলেছে সে, এবার তার সাথে যোগ হলো ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’। অডিশনে হিন্দিটাও নতুন করে ঝালাই করে নিতে হয়েছে তাকে। শারিব হাশমি ছিলেন সিরিজের দ্বিতীয় প্রাণের মতোই। মনোজের সাথে তাঁর জুটি দর্শক বহুদিন মনে রাখবে। সামান্য মেকানিক বাবা আর রূপসজ্জাকর মা’র সন্তান শাহাব আলী অভিনয় জগতে এসেছেন বছর কয়েক হলো। এর মধ্যেই এই বিশাল প্ল্যাটফর্মে কাজ করে নিজের জাত চিনিয়েছেন। গুল পানাগ পরীক্ষিত অভিনেত্রী। হতাশ করেন নি তিনিও। কাশ্মিরি কন্যা হয়ে যেমন মিশে গেছেন তেমনি পুরোদস্তুর গোয়েন্দা হিসেবেও নিজেকে দাঁড় করেছেন অবলীলায়।
দক্ষিণী নায়িকা প্রিয়ামনিও হিন্দি ওয়েব সিরিজে এই প্রথম কাজ করেছেন। তার সুচিত্রা চরিত্রের মিষ্টতাও ছিল আকর্ষণীয়। শারদ কেলকারের সুদর্শন উপস্থিতি দিয়েছে অনন্য সজীবতা। তবে আলাদা করে বলতেই হবে দুই ক্ষুদে অভিনেতা- মেহেক ও বেদান্তের কথা। আথার্ভ চরিত্রে বেদান্তের আবোলতাবোল বাঁশির সুর আর ধৃতি হিসেবে মেহেকের সদ্য কৈশোরের সংকট ছিল নজরে পড়বার মতো। পাকিস্তানি মেজর সামির হিসেবে নিজের সেরাটাই দিয়েছেন দর্শন কুমার।
অসামান্য মনোজ
২০ সেপ্টেম্বর অ্যামাজনে প্রাইমে মুক্তির পরপরই দর্শক- সমালোচক মনোজ বাজপেয়ির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভারতীয় মিডিয়ায় যেখানে পুলিশ বা গোয়েন্দাদের দেখানো হয় সুদর্শন-অতিরিক্ত গ্ল্যামারাস রূপে সেখানে মনোজ একেবারেই ঘরের লোক। আর এখানেই লোকে নিজের সাথে মিল খুঁজে পেয়েছে। ‘দাবাং’য়ের সালমান খান বা ‘সিংঘাম’ এর অজয় দেবগন হওয়ার কোন প্রচেষ্টাই ছিল না মনোজের ভেতর। উল্টো বিন্যস্ত হাস্যরস আর কমিক রিলিফের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত বাস্তবতার স্বাদ পেয়েছে দর্শক। ঝানু গোয়েন্দা, কৌতুকপ্রিয় সহকর্মী, ঠাণ্ডা মাথার নেগোশিয়েটর, ব্যর্থ প্রেমিক, আদুরে বাবা কিংবা সন্দেহবাতিকগ্রস্ত স্বামী- সব চরিত্রেই এঁটে গেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। সরকারি কর্মকর্তার দোটানা, সংসারের খুঁটিনাটি সমস্যা, সন্তানদের যত্নশীল পিতা এসব বৈশিষ্ট মনোজের চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মনোজের এটাই প্রথম কাজ। পরিচালক জুটির প্রথম থেকেই পছন্দের লিস্টিতে ছিলেন মনোজ। ক্যাফেতে বসে মাত্র ২০ মিনিটের ভেতর রাজিও করে ফেলেন তাঁকে।
মন্দের পাল্লা শূন্য
বিশ্বব্রক্ষান্ডের তাবৎ ভিনগ্রহিদের আগ্রহ নাকি শুধু আমেরিকাকে ঘিরে। অন্তত হলিউডি ছবি দেখলে তাই মনে হবার কথা। সেকথা খাটে বলিউডের কিছু চিরাচরিত মারদাঙ্গা ছবিতেও। সিরিয়া, আফগানিস্তান,ইরাক, অস্ট্রেলিয়া ,কানাডা নয়- শুধুমাত্র ভারতকে ঘিরেই দুষ্কৃতিকারীদের আগ্রহ, বাকিদের বেলায় একদম পানসে তারা। অন্তত হালজমানার একপেশে কিছু ছবি দেখলে এমন ধারণাই জন্মাবে আপনার। সেদিক দিয়ে The Family Man ব্যতিক্রম। ‘হামারা ভারাত মাহান’ বা ‘আমাদের ভারত মহান‘ -বুলির বদলে সত্যটাই উদঘাটনে তৎপর ছিল এই সিরিজ। যেকোনো সত্যের নাকি চারটে দিক হয়। দুপক্ষের দৃষ্টিতে দুই সত্য, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সত্য আর ঈশ্বরের নিখাদ সত্য। পরিচালক জঙ্গিবাদের উত্থানের সাথে সাম্প্রতিক ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাকেও টেনে এনেছেন। ভারতে হিন্দু রাজনীতিকদের উস্কানি, অসহায় মুসলিমদের নির্যাতন- কোন কিছুই এড়ায় নি স্ক্রিপ্টে। ভূপাল ট্র্যাজেডির আদলে প্রতিশোধের নতুন বিন্যাসেও মুগ্ধ হয়েছে দর্শক।
কাশ্মির ইস্যুতে কিছু বিষয়ের চমৎকার উপস্থাপন দেখা গেছে। যেমন- আভা হাঞ্জুরার কণ্ঠে কাশ্মিরি লোকসংগীত ‘হুকুস বুকুসের’ অভাবনীয় ব্যবহার, কাশ্মিরি বিবাহ ও মেহমানদারি প্রথার নির্মল উপস্থাপন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্যান্য পরিচালক এসব খুঁটিনাটি এড়িয়ে একমাত্র অশান্ত কাশ্মীরকেই দেখান। কিন্তু এই সিরিজে কাশ্মিরের প্রাকৃতিক মাহাত্ম্য, জল-স্থল-জনের অপূর্ব সম্মিলন আর স্বাধীনতাকামী জনতার বুকচাপা কান্নাই উঠে এসেছে। কারিগরি দক্ষতা ও মনস্তত্বে ব্যাপক গবেষণা করেই মাঠে নেমেছে রাজ-ডিকের দল।
সুরবিন্যাসের জন্য় টুপি খোলা অভিবাদন পেতেই পারেন শচীন-জিগার। প্রতিটি পর্বের শেষে ভিন্ন ভিন্ন সংগীত আয়োজন করা বেশ শ্রমেরই ব্যাপার। সিরিজের থিমসং ‘কিসকে লিয়ে জান দেগা’য় সেতারের ব্যবহার এবং শ্রেয়া ঘোষালের মোহনীয় কণ্ঠ শিহরিত করবে শ্রোতাদের।
ইতোমধ্যেই পরবর্তী সিজনের ডাক দিয়েছে ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ পরিবার। আগামী বছরই সম্ভবত দেখা যাবে ‘নার্ভ গ্যাস’ ক্লাইমেক্সের ফলাফল।
লেখার যবনিকা টানি সালোনির সংলাপ দিয়ে, ‘ কাশ্মির নিয়ে সবাই স্রেফ নিজ নিজ খেলায় মত্ত। কিন্তু বিষাক্ত হচ্ছে শুধু এর হাওয়া আর জনতার স্বাধীনতা।‘
লেখক- সারাহ তামান্না
আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (প্রথম পর্ব ): আশা-নিরাশার Bard of Blood
আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (তৃতীয় পর্ব): Broken but Beautiful- ভালোবাসার সাতকাহন
আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (চতুর্থ পর্ব): Delhi Crime- নির্ভয়া কেস ও বর্বর সমাজের আলাপন
আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (৫ম পর্ব): জামতারা: সাবকা নাম্বার আয়েগা- প্রতারণাই যে গ্রামের মূল পেশা