ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (প্রথম পর্ব ): আশা-নিরাশার Bard of Blood1 min read
Reading Time: 5 minutes‘চাইলেই যদি সব পাওয়া যেত তবে স্বপ্ন আর বাস্তবে ফারাক থাকতো না।‘
জান্নাত মারির মুখের এই সংলাপটিই ‘Bard of Blood’ এর প্রতিনিধিত্ব করে। আগস্ট মাসের ২২ তারিখে সুপারস্টার শাহরুখ খান এবং এমরান হাশমির ট্রেইলার দর্শক টেনেছিল। কিন্তু ২৭ সেপ্টেম্বর মুক্তির পর সিরিজের গতানুগতিক কাহিনী দর্শকদের বিরক্তই করেছে।
দূর্বল গল্প ও প্রধান চরিত্রগুলো নির্মাণে যত্নের অভাবকে ছাপাতে পারেনি দুর্দান্ত লোকেশন আর ক্যামেরাতে অসাধারণ সব লংশটের ব্যবহার। ‘যত গর্জে তত বর্ষে না‘র উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নেটফ্লিক্স ও রেড চিলি এন্টারটেইনমেন্টের যৌথ প্রযোজনার এই সিরিজ।
কাহিনি সংক্ষেপ
সপ্তাহখানেক বাদেই ভারত-চীন সামিট। এই আয়োজনের উপর নির্ভর করছে ভারত-চীনের ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সম্পর্ক। অন্যদিকে আইএসএ এবং তালেবান গোষ্ঠী এই সামিট বানচালের পরিকল্পনা আঁটছে। অনতিবিলম্বে ব্যাপারটা জেনে ফেলে চার ভারতীয় গোয়েন্দা। কিন্তু সমস্যা বাঁধে তখনই যখন তালেবানেরা আটক করে তাদের। হত্যার উদ্দেশ্য থাকলেও আইএসএ কর্মকর্তা তানভীর শেহজাদ চার এজেন্টকে ঘিরে করে নতুন পরিকল্পনা। কী সেই কূটচাল? চার এজেন্ট কি শেষ অবধি দেশে ফিরবে? কী হবে ভারত- চীন সামিটে? তালেবানরাই বা কী ভাবছে?
এতগুলো প্রশ্ন সামনে রেখেই শেষ হয় Bard of Blood এর প্রথম পর্ব। এরপরের বাকি ছয় পর্ব জুড়ে দেখা যায় সাবেক র (RAW) এজেন্ট কবির আনন্দের মিশন। ভারতীয় চার এজেন্টকে উদ্ধার করতে গিয়ে কবির আবিষ্কার করে পূর্বের অসফল মিশনের আদ্যোপান্ত। আগের মিশনে প্রিয় বন্ধু বিক্রমজিতের মৃত্যু, প্রেমিকা জান্নাতের সাথে বিচ্ছেদ, বেলুচিস্তান আজাদ ফোর্সের অসহায়তা সব মিলিয়ে ক্লান্তিকর যাত্রার পথে এগোয় কবির। তার সাথে তাল মেলায় আরও দুই এজেন্ট ইশা খান্না আর বীর সিং।
সিরিজের নেপথ্যে
২০১৫ সালে প্রকাশিত বিলাল সিদ্দিকির ‘Bard of Blood’ উপন্যাসকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে সিরিজটি। থ্রিলার জনরার ড্রামা সিরিজের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন রিভু দাশগুপ্ত। এর আগে ‘মাইকেল’, ‘তিন’, ‘যুদ্ধ’ (ড্রামা সিরিজ) এসেছে রিভুর হাত ধরে। এই সিরিজেও রিভুর পরিচালনা প্রশংসা পেয়েছেন। অবশ্য চিত্রনাট্যকার মায়াংক ভার্মার কাজে সন্তুষ্ট নয় দর্শক। সংলাপ সাজানোয় মনোযোগী হলেও ততটাই অমনোযোগী মনে হয়েছে চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে খানিকটা সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রযোজক শাহরুখ খান, গৌরি খান এবং গৌরব ভার্মাকে। বিশেষত ‘কিং খান’ দম্পতি কীভাবে এতটা গতানুগতিক, উত্তেজনাহীন থ্রিলারে বিনিয়োগ করেছেন, তা নিয়েই চলছে বিতর্ক। তাছাড়া নেটফ্লিক্সও কনটেন্ট বাছাইয়ে বোকামি করেছে বলেই সমালোচকেরা মন্তব্য করেছেন।
তবে সিরিজের অন্যতম শক্তিশালী দিক ছিল এর ক্যামেরার কাজ। লংশটের বর্ণালি ব্যবহার, ফ্ল্যাশব্যাকের সুচিন্তিত উপস্থাপনের জন্য ক্যামেরার দায়িত্বে থাকা চিরন্তন দাস বাড়তি হাততালি দাবি করতেই পারেন। বিশেষ করে বেলুচিস্তান ও কেচের উষর মরুভূমি, শুকনো বালির জীবনযাপন আলাদা রং পেয়েছে উপযুক্ত ক্যামেরা আর ড্রোনের ব্যবহারে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই সিরিজে অংশ নেয়ার গল্পটা এমরান বলেন এভাবে, ‘ ২০১৫ সালেই বিলালের বইটা পড়েছিলাম। তখনই মনে হলো, বাহ! এই গল্পে তো সরস একখানা ছবি বানানোই যায়। এর চার বছর পর হুট করেই বিলাল একদিন ফোনে জানালো, নেটফ্লিক্স বইটা নিয়ে সিরিজ বানাচ্ছে। মূল চরিত্র নিয়ে আলাপ করতে করতেই বিলাল প্রস্তাব দিয়ে বসলো। সে রাতেই তিন পর্বের স্ক্রিপ্ট হাতে পেলাম। অদ্ভুত রোমাঞ্চ হচ্ছিলো। আর এখন তো দেখতেই পারছেন।‘
যা কিছু ভালো
সাত পর্বের সিরিজটি এক হিসেবে এমরান হাশমির কাঁধে ভর দিয়েই এগিয়েছে। এডোনিস বা কবির আনন্দের চরিত্রে সাবলীল ছিলেন এমরান। এজেন্ট হিসেবে নিজের সেরাটাই দিয়েছেন তিনি। অতি অভিনয় বা নায়ক হওয়ার বাড়তি চেষ্টা ছিল না বলেই গল্পের সাথে মিশতে পেরেছেন তিনি। তার মুখে শেকসপিয়ারের বচন মানিয়েছেও বেশ। এরপরেই বলতে হয় বীর সিং চরিত্রে রূপদানকারী বিনীত কুমারের কথা। একদিকে স্বদেশে ফেরার আকুলতা,অন্যদিকে দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর এক ফেরারি যুবকের বাস্তবিক চিত্র এসেছে তার চরিত্রে। তবে তার ‘মুক্কাবাজ’, ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুরে’র মতো কারিশমা এখানে অনুপস্থিত ছিল। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে দুটো। প্রথমত, এই সিরিজের সাথে অনুরাগ কাশ্যপ জড়িত ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, এমরানকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্য চরিত্রকে একটু কম আলোই পেয়েছে।
তালেবান নেতা মোল্লা খালিদের চরিত্রে দানিশ হুসেন ছিলেন যোগ্য নির্বাচন। তবে পর্দায় তাঁকে আরও বেশি সময় দেখানো গেলে তালেবানদের চরিত্র বুঝতে সুবিধা হতো। তার চরিত্রটি নির্মিত হয়েছে তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের অনুকরণে। কীর্তি কুলহারি বরাবরের মতোই ছিলেন সপ্রতিভ। এমরানের পাশাপাশি তাকেও শেকসপিয়ার আউড়াতে দেখা গেছে বেশ চৌকসভাবে। ঘনিষ্ঠ দৃশ্য, চুম্বন ছাড়াও যে প্রেম আর রসায়ন বোঝানো যায়, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ মেলে কীর্তি-এমরান জুটির অভিনয়ে।
বেলুচিস্তান আজাদ ফোর্সের ইস্যুও এসেছে সিরিজে। তাদের নিগ্রহ, লক্ষ্য, অন্তঃকোন্দল প্রভৃতি ক্ষেত্রেও পরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন নির্মাতারা। নুসরাত মারি হিসেবে অভিষেক খানও নিজের সেরাটা দিয়েছেন। তালেবান-আইএসএ দুই সন্ত্রাস গোষ্ঠীকে কেন্দ্রীভূত করে গল্প এগুলেও মূল নেতিবাচক চরিত্রে ছিলেন তানভীর শেহজাদ অর্থাৎ জয়দীপ আহলাওয়াত। কিছু দৃশ্যে তার তুলনায় এমরানকে বেশ দুর্বলই লেগেছে। রজিত কাপুর, শিশির শর্মাও কম সময়ের চরিত্রে সুবিচার করেছেন। তবে সিরিজে চটকদার টুইস্ট বলতে ছিলেন একমাত্র সোহাম শাহ্।
অনাকাঙ্ক্ষিত নিরাশা
সিরিজের অন্যতম প্রধান র এজেন্ট অ্যানালিস্ট ইশা খান্নার চরিত্রে সবিতা ধুলিপালা ছিলেন একেবারে নিষ্প্রভ। সবিতার অভিনয় এতটাই বৈচিত্র্যহীন ও কাঁচা ছিল যে, দর্শকদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে এই একই সবিতা ‘Made in Heaven’, ‘Chef’, ‘Raman Raghav 2.0’ তে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন। বরং কিছু দৃশ্যে সংলাপে জড়তা প্রমাণ করেছে সবিতার হিন্দি শেখার বয়স মোটে পাঁচ বছর। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এজেন্ট হওয়া সত্ত্বেও ইশার রাইফেল চালনা ছিল বেশ অপরিপক্ব ও অবিশ্বাস্য।
সবিতা ছাড়া বাকিসব চরিত্রের কাস্টিংই ছিল ক্ষুরধার। তবে ‘নতুন বোতলে পুরনো মদে’র মতোই ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ, ভারতীয় গোয়েন্দার সাহসিকতা, ইসলামোফোবিয়া এসেছে সিরিজে। এই একই ধাঁচের গল্প সালমান খানের ‘এক থা টাইগার’, ‘ফ্যান্টম’, ‘এজেন্ট বিনোদ’, ‘মাদ্রাজ ক্যাফে’, ‘কাবুল এক্সপ্রেস’ প্রভৃতিতে ইতোমধ্যেই দেখেছে দর্শক। সিরিজে প্রয়োজনীয় টুইস্ট ধরে রাখতেও খুব একটা সফল হন নি পরিচালক। যেমন- তানভীর শেহজাদ পূর্বেই কবির-বিক্রমজিতকে ধোঁকা দিয়েছিল, সেটাও সময়ের বেশ আগে দেখিয়ে ফেলেছেন পরিচালক। ডাবল এজেন্ট হিসেবে জান্নাতের অবস্থানও ছিল অস্পষ্ট। তালেবানি নীতিতেও ঢিলেমি পরিলক্ষিত হয়েছে।
সময়ের তুলনায় এই সিরিজ বেশ দুর্বল হলেও এর শক্তিশালী দিকও কম নয়। বিশেষত এমরান হাশমি ক্যারিয়ারের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন এখানে। বলিউডপাড়ায় একসময় যাকে অভিনয় না জানা,সিরিয়াল কিসার হিসেবে ডাকা হতো, সময়ের প্রবর্তনে সেই এখন বলীয়ান এক অভিনেতা। তাই হালকা ঘরানার থ্রিলার হিসেবে একেবারে মন্দ নয় Bard of Blood. সো হ্যাপি ওয়াচিং!
লেখক- সারাহ তামান্না
আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (দ্বিতীয় পর্ব): The Family Man- অপ্রতিরোধ্য বাজপাই
আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (তৃতীয় পর্ব): Broken but Beautiful- ভালোবাসার সাতকাহন
আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (চতুর্থ পর্ব): Delhi Crime- নির্ভয়া কেস ও বর্বর সমাজের আলাপন
আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (৫ম পর্ব): জামতারা: সাবকা নাম্বার আয়েগা- প্রতারণাই যে গ্রামের মূল পেশা