বিনোদন

ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (৫ম পর্ব): জামতারা: সাবকা নাম্বার আয়েগা- প্রতারণাই যে গ্রামের মূল পেশা1 min read

ফেব্রুয়ারি ২, ২০২০ 5 min read

author:

ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (৫ম পর্ব): জামতারা: সাবকা নাম্বার আয়েগা- প্রতারণাই যে গ্রামের মূল পেশা1 min read

Reading Time: 5 minutes

হ্যালো, বিকাশ থেকে নাহিদ বলছি। বিকাশ অ্যাকাউন্ট আপগ্রেডের কাজ চলছে। বিকাশ থেকে আপনার ফোনে ভেরিফেশন কোড পাঠানো হয়েছে, সেটা আমাকে দিন। এবার আপনার বিকাশের পিন বলুন।

বিকাশের এই বিজ্ঞাপনের কথা কার না মনে আছে! লোভের ফাঁদে পড়ে নিজ একাউন্টের তথ্য অপরিচিত কাউকে না প্রদানে সচেতন করাই ছিল এই বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য। সাধারণ একটি ফোন কলের মাধ্যমে যে কারো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য নিয়ে টাকা পাচার করে ফেলতে পারে প্রতারক চক্র। মেইল, ফোন কল, ক্ষুদে বার্তা প্রভৃতি মাধ্যমকে পুঁজি করে হরদম চলছে ধরণের প্রতারণা। 

সময়ের সাথে ষড়যন্ত্রের ধরণেও এসেছে বিবর্তন। ডিজিটাল প্রযুক্তির ধূর্ত ব্যবহার জনগণের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে দ্রুতই বেড়ে চলেছে এই অপরাধের মাত্রা। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সের ব্যানারে দেখা গেলো এরই এক ঝলকজামতারা। 

কাহিনি সংক্ষেপ

ভারতের ঝাড়খণ্ড জেলার ছোট্ট গ্রাম জামতারা। গ্রামের অধিকাংশ লোকই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, তবুও যারা এগিয়েছিলো তারাও খুব বেশিদূর পড়ালেখা করেনি। অথচ এই গ্রামের বহু যুবকেরই মাসিক আয় লাখ খানেকের উপর। অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন উদ্ভাবনী ক্ষমতার জোরে এগিয়েছে গ্রামটি? একেবারেই নয়। গ্রামীণ জনতার সহজ স্বাভাবিক জীবনযাপন বা কৃষ্টিগত কোন কারণে গোটা ভারতের কাছে এর পরিচিতি মেলেনি। এর পরিচিতিসাইবার ক্রাইমের গ্রামহিসেবে। 

মনিকা- স্পর্শের অপরাধের রসায়ন ছিল প্রশংসাযোগ্য; Photo: NDTV

গল্পের পত্তন আজ থেকে বছর দশেক আগে। ভারতের জনগণ সবেমাত্র এটিএম কার্ড অথবা ডিজিটাল ব্যাংকিং এর সাথে পরিচিত হয়েছে। নতুন প্রযুক্তির প্রতি অগাধ আস্থা আর অসচেতনতাকেই লক্ষ্য বানিয়ে ব্যবসা ফাঁদে জামতারার সাত তরুণ। প্রথমে তারা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল করে বিভিন্ন ব্যক্তির এটিএম কার্ড, ব্যাংক ডিপোজিট প্রভৃতির তথ্য আদায় করে নিতো। এর বিপরীতে লক্ষাধিক টাকার প্রস্তাব , গাড়ি বা ফ্ল্যাট জেতার প্রলোভন দেখাতো তারা। আর অসাবধানী জনগণ সহজেই পা দিয়ে বসতো সেই ফাঁদে।

ঠগদের দলের নেতৃত্ব দেয় দুই জ্ঞাতি ভাই সানি মণ্ডল রকি মণ্ডল। এর মাঝেই গোটা দেশ থেকে অভিযোগ আসতে থাকে জামতারা গ্রামের বিরুদ্ধে। গ্রামীণ পুলিশের অজ্ঞানতা এবং সানির চাতুর্যে সহজেই মামলা থেকে রেহাই পেয়ে যায় অপরাধ চক্রের তরুণেরা। তাদের আয়ও বাড়তে থাকে। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিবিদ ব্রজেশ ভানের এতে বিষম আপত্তি। আয়কৃত অর্থের অর্ধেক দাবি করে বসে সে। এর বিনিময়ে পুলিশি হয়রানি থেকে সানিরকির দলকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। রকি গ্রামের অন্যান্য যুবক প্রস্তাবে রাজি হলেও বেঁকে বসে সানি। প্রেমিকা গুডিয়াকে সঙ্গী করে ফিসিং ব্যবসা আরও জাঁকিয়ে তোলে সে। 

অন্যদিকে জামতারায় নতুন এসপি হিসেবে আসেন ডলি সাহু। ফিসিং অপরাধের সাথে যুক্ত যুবকদের শাস্তির আওতায় আনতে ঢালাও ভাবে সাজান জামতারার পুলিশ স্টেশনকে। সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে সাথে নিয়ে আবিষ্কার করেন ব্রজেশের ঘরেই আছে ফিসিং ব্যবসারকলসেন্টার 

একদিকে রকির অথর্ব দল, অন্যদিকে চতুর সানিগুডিয়ার ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যবসা। দুই ভাইয়ের দ্বৈরথকে আরও বাড়িয়ে তোলে ব্রজেশ ভানের লোভ। অপরাধ জগতের সাথে যুক্ত হয় রাজনীতি। কোটি কোটি টাকা লুটে নেয়া জামতারা যুবকদের ভবিষ্যৎ কী? ভানের লোলুপ কুটচাল থেকে মুক্তি মিলবে কি তাদের? পুলিশই বা কীভাবে শাস্তির বিধান করবে এই চক্রের

গল্প হলেও সত্যি

জামতারাকে শুধু সিরিজ হিসেবে গুনলে মুশকিলেই পড়বেন। কেননাদিল্লি ক্রাইমএর মতো এটিও সত্য অপরাধকে কেন্দ্র করেই নির্মিত। ঝাড়খণ্ডের এই গ্রামেই ভারতের সবচেয়ে বেশি সাইবার ক্রাইম সংঘটিত হয়। ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত একশোরও বেশি মামলা করা হয়েছে এই গ্রামের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে। জামতারা তো বটেই আশপাশের ১২ টি রাজ্যের পুলিশও এই সময়ে তেইশবার হানা দিয়ে ৩৮ জনকে আটক করেছে। শুধু ২০১৭ সালেই ১০০ জনের অধিক চৌদ্দ শিকের পাল্লায় পড়েছে। 

পরিচালক সৌমেন্দ্র কিন্তু বেশ গবেষণা করেই সিরিজ তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনে চোখ আটকে যায় তাঁর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, জামতারা গ্রামের একরাশ যুবকের পাল্লায় পড়ে বহু ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজ্ঞ বহু অর্থ খুইয়েছেন। উচ্চশিক্ষিত এই লোকগুলোকে পাড় বুদ্ধু বানানো যুবকদের পড়াশোনার দৌড় বড়জোর পঞ্চম শ্রেণি। তারা স্রেফ ফোন কলের মাধ্যমে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকা প্রতিমাসে হাতিয়ে নিচ্ছে এদের কাছ থেকে। গোটা ভারতের জনতাকে লক্ষ্যবস্তু বানালেও ঝাড়খণ্ডের লোকেদের ক্ষতি করেনা তারা। 

ব্রজেশ চরিত্রের সুবাদে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন অমিত সিয়াল; Photo: NDTV

প্রতিবেদনখানা পড়েই সৌমেন্দ্র টের পান, সিরিজ তৈরির জন্য এরচেয়ে বাঘা গল্প আর হয়না। পাশাপাশি এই বিশাল চক্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার একটা ভিত্তি তৈরির তাড়নাও অনুভব করেন। তাঁর মতে, আমরা সবাই ই কম বেশি এমন ফোন কল পেয়েছি। প্রচুর লোক প্রতিদিন এভাবে নিজের সর্বস্ব হারাচ্ছেনও। অথচ মিডিয়াতে এই বিষয়ে তেমন শোরগোল নেই। ভারতে খুব সহজেই লোকের ব্যক্তিগত তথ্য আদায় করে নিতে পারে প্রতারকচক্র। যুক্তরাষ্ট্রে এর বিরুদ্ধে শক্ত আইন থাকলেও আমাদের নেই। খুব বড় ধরণের জালিয়াতি না ঘটা অব্দি সম্ভবত সরকারের টনকও নড়বে না।  আমি বিশ্বাস করি, ‘জামতারা’ এই সমস্যাকে তুলে ধরবে জনগণের কাছে, তাদের সচেতন হতে সাহায্য করবে সিরিজটি।‘ 

জামতারায় সরাসরি অপরাধ চক্রের মুখোমুখিও হয়েছিলেন তিনি। নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন,জামতারার তরুণদের প্রধান পেশাই প্রতারণা। পুলিশ যতই চেষ্টা করুক, ওরা তার চাইতে দশ কদম এগিয়ে। ধরুন, কোন পুলিশ চক্রের কাউকে আটক করলো,সাথে সাথেই পুলিশের অ্যাকাউন্টে পাঁচ হাজার টাকা ডিপোজিট করে দেয় তারা। এরপর কার সাধ্য বলুন এদের ঘাঁটাবার?’ 

বলিষ্ঠ গল্প, দুর্বল চিত্রনাট্য

নেটফ্লিক্সের ছায়াতলেই মুক্তি পেয়েছে সিরিজটি। হলদে ছাটেই শুট করা হয়েছে পুরো দশ পর্বই চিত্রায়িত হয়েছে হলদে ছাটে। এর পরিচালনায় ছিলেন সৌমেন্দ্র পাধি। এর আগেবুধিয়া সিং: বর্ন টু রানদিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। 

গল্পের ভিত দৃঢ় হলেও বেশি কিছু অংশে দুর্বলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। পশ্চিমবঙ্গের সাথে সীমানা ভাগাভাগি করায় জামতারার ভাষা মূলত বাংলা সান্থালি ভাষার মিশ্রণে গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেদিকটা এড়িয়েই গেছেন চিত্রনাট্যকার ত্রিশান্ত শ্রীবাস্তব নিশাঙ্ক ভার্মা। ঝাড়খণ্ডে ভাই সম্বোধনে নামের সাথেইয়া; যোগ করা হয়। অথচ গোটা সিরিজে রকি সানিকেরকিওয়া’, ‘সানিওয়াডাকা হয়েছে। তবে এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন পরিচালক সৌমেন্দ্র। ‘নেটফ্লিক্স আন্তর্জাতিক একটা প্ল্যাটফর্ম। ভারতের বাইরেও এর দর্শক আছে। সেকথা মাথায় রেখেই আমাদের এগুতে হয়েছে। যতটা সম্ভব সহজবোধ্য ভাষা ব্যবহার করতে হয়েছে আমাদের। এটা ঠিক যে এর ফলে মৌলিক স্বাদটা বিঘ্নিত হয়েছে।‘

গত ১০ জানুয়ারি নেটফ্লিক্সের পর্দায় মুক্তি পায় ১০ পর্বের ক্রাইমড্রামা জনরার সিরিজটি। প্রতি পর্বের ব্যাপ্তি ছিল ২৩৪০ মিনিট। কৌশল শাহের সিনেমাটোগ্রাফি আর মাল্টি ক্যামেরায় জামতারার তীক্ষ্ণ অপরাধ ্যাকেটের সমস্তটাই এসেছে প্রগাঢ়ভাবে। সরল ভাষায় চিত্রনাট্য লেখা হলেও অভিনেতাদের আন্তরিকতায় ঘটনার ভয়াবহতা ঠিকই টের পেয়েছে দর্শক।

‘জামতারা’র জালিয়াত চক্রের যুবকেরা; Photo: ScoopWhoop

নবীনের ভিড়

সিরিজের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নতুন অভিনেতাদের দিয়ে কাজ করানো। ব্রজেশ ভানের চরিত্রে অমিত সিয়াল তুলনামূলক প্রবীণ অভিনেতা হলেও বাকি সবাই ছিলেন আনকোরা মুখ। কাস্টিং ডিরেক্টর বিকাশের হাত ধরেই বাকিরা সুযোগ পেয়েছেন সিরিজে। সানি চরিত্রে স্পর্শ শ্রীবাস্তব অবশ্য স্টার প্লাসেরবালিকা বধূদিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলেন। তবুও চারবার অডিশনের পরেই ডাক মেলে তার। মেয়েলি কণ্ঠে স্ক্যামিং এর দৃশ্যগুলোয় অনন্য ছিল স্পর্শ। অন্যদিকে রকি হিসেবে অংশুমান পুষ্কর মডেলিং এর জন্য অডিশন দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই বিকাশ তাকে ডেকে অডিশনের প্রস্তাব দেন। মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ কেজি কমিয়ে অডিশন দেয় অংশু। 

সাত ধাপে অডিশন দিয়ে অংশু নির্বাচিত হলেও গুডিয়া চরিত্রে মনিকা পানওয়ারকে বেশিই শ্রম দিতে হয়েছে। পাহাড়ের মেয়ে হওয়ায় কথার টানে কিছুতেই ঝাড়খণ্ডের আঞ্চলিকতা আনতে পারছিলেন না। তিন পর্ব চিত্রায়নের পর ছেড়ে দেবার কথাও ভাবছিলেন। পরিচালকের প্রেরণাতেই ফের চরিত্রে মেশেন মনিকা। আকশা পারদাশানি ছিলেন সিরিজের অন্যতম বলিষ্ঠ চরিত্র ডলি সাহু হিসেবে। নবীন হিসেবে তিনিও নজর কেড়েছেন।

সানি চরিত্রে দ্যুতি ছড়িয়েছেন স্পর্শ শ্রীবাস্তব; Photo: Hindustan Times

চমকপ্রদ উপস্থাপন

অনেকের মতে কলম্বিয়ান মাদক নেতা পাবলো এস্কোবারেরই প্রতিরূপ এই জামতারার অপরাধ চক্র। পিছিয়ে থাকা জামতারা গ্রাম পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছে এই ফিসিং স্ক্যামের সাথে যুক্ত হয়েই। 

ডিজিটাল প্রতারণা তদন্ত কর্মকর্তা মাক্রান্দ ওয়াঘ জামতারার মূল তদন্তের স্বার্থে একেবারে কাছ থেকে দেখেছেন প্রতারক চক্রের কর্মকাণ্ড। বাস্তব চিত্রের আলোকে তিনি বলেন, জামতারার তরুণদের কাছে আধুনিক প্রযুক্তির সবকিছুই আছে। তারা ইন্টারনেট, ভিওআইপির সর্বোচ্চ ব্যবহারটা জানে। গ্রামের বয়স্কদের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে জালিয়াতির অর্থ হস্তান্তর করে। প্রতিজন গড়ে ৩০০ টা ফোনকল করে প্রতি মাসে। এই বিশাল চক্রের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় সচেতনতা। ভুলেও কাউকে ব্যক্তিগত কোন পাসওয়ার্ড দেবেন না, অচেনা লিংকে ক্লিক করবেন না আর পর্ণ সাইটে ভুলেও ঘুরবেন না। এই সাইটই ভাইরাসের সবচেয়ে বড় আখড়া। এছাড়াও এটিএম বুথে সাবধানতার সাথে লেনদেন করবেন।‘ 

লেখক- সারাহ তামান্না 

আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (প্রথম পর্ব ): আশা-নিরাশার Bard of Blood

আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (দ্বিতীয় পর্ব): The Family Man- অপ্রতিরোধ্য বাজপাই

আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (তৃতীয় পর্ব): Broken but Beautiful- ভালোবাসার সাতকাহন

আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (চতুর্থ পর্ব): Delhi Crime- নির্ভয়া কেস ও বর্বর সমাজের আলাপন

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *