ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (তৃতীয় পর্ব): Broken but Beautiful- ভালোবাসার সাতকাহন1 min read
Reading Time: 4 minutesজাপানিজরা কোন ভাঙা বস্তুকে চট করে ফেলে দেয়না। বরং সোনার গুঁড়ো দিয়ে ভাঙা টুকরোগুলো জুড়ে দেয়। ফলাফল? পূর্বের চাইতেও আকর্ষণীয়, মনোরম হয়ে ওঠে সেটি। ভাঙা কোন বস্তুকে সোনা, রূপা বা প্লাটিনামের গুড়োর সাহায্যে জুড়ে দেয়ার প্রক্রিয়াকে বলে ‘কিংসুগি’। প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো এই শিল্পের চর্চা কিন্তু মানুষের জীবনেও আছে। ভগ্ন হৃদয়ও অল্প ভালোবাসার ছোঁয়াতেই জেগে ওঠে পূর্ণোদ্যমে, রচনা করে নতুন স্বপ্ন।
এমন ব্যথিত ভগ্ন হৃদয় জুড়বার গল্প নিয়েই অল্ট বালাজির ওয়েব সিরিজ ‘Broken but Beautiful’। ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত হয় ১১ পর্বের এই সিরিজটি। হালকা মেজাজের মিঠে গল্প নিয়ে আইএমডিবিতে ৮.৫ রেটিংও আদায় করে নিয়েছে ।
গত বর্ষার সুবাস
অঞ্জন দত্ত বেলা বোসকে পাওয়ার জন্য আকুল ছিলেন। এমনকি মালার কথা ভেবেও অশ্রু ফেলেছেন গোপনে, বারোই মে কে করেছেন অবিস্মরণীয়। শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ পার্বতীর ব্যথায় প্রাণের মায়া ত্যাগ করে উচ্ছন্নে গিয়েছিলেন। তারাশঙ্করের কবিও ছোট ঠাকুরঝি প্রেমের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন বসনকে অসীম ভালোবেসে।
উদাহরণগুলো পড়লে মনে হতেই পারে, উপমহাদেশীয় নারীরা বোধয় হৃদয়হীনা। হৃদয় ভাঙতে জানে শুধু, গড়তে নয়। ঘেঁটে দেখলে করবী, মেরি, মেমসাহেব, শবনম বা চন্দ্রমুখীর মতো অসংখ্য নিঃস্বার্থ প্রেমিকার নাম মিলবে। কিন্তু সে তো সাহিত্যে। বাস্তবে কী হয়? বাস্তবটাই সামিরা।
এক বছর হতে চললো সামিরা-কার্তিকের প্রেম চুকেবুকে গেছে। পাঁচ বছরের সম্পর্কের ইতি টেনে অনন্যার প্রেমে ডুব দেয় কার্তিক। সে তো নতুন প্রেম আর উঠতি ক্যারিয়ার নিয়ে মজে আছে। ওদিকে সামিরা ক্রমে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। প্রায়ই পুরনো প্রেমিকের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে সে, রোদ-জলে মেশে তার অশ্রু, Claustrophobia জায়গা করে নেয় তার জীবনে।
‘আরো একবার হৃদয় আমার ভেঙে গেছে বিচ্ছেদে, যাবার যে গেছে, পড়ে আছি আমি দ্যাখো তার নির্বেদে।‘-হাফিজের শায়েরির মতোই দুঃখভারে নত সে। ক্রমাগত নিজেকে প্রশ্ন করে ক্লান্ত তরুণী শেষমেশ সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, কার্তিকের স্মৃতি নিয়েই বাঁচবে সে। হোক না সে বেদনার্ত, যন্ত্রণাবিদ্ধ!
মুম্বাইয়েরই আরেক প্রান্তের যুবক বীর। হৃদয় ভাঙার তাড়নায় সেও বিদ্ধ। তবে তার গল্পটা আলাদা। শৈশব-কৈশোরের প্রেম পরিণতি পেলেও দীর্ঘ হয়নি সংসার। আলিনাকে সে হারিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়। চার বছরেও সে ক্ষত সারেনি। নিয়মিত কাউন্সেলিং করলেও পিটিএসডির (Post Traumatic Disorder) গ্রাস থেকে বাঁচতে পারেনি বীর। তাই একসময় সেই ভগ্ন হৃদয় আর চাপা কষ্টের সাথেই আপোষ করে নেয়, ভেবে নেয়, ‘গোটা পৃথিবীর কাছে আলিনা হয়তো মৃত। কিন্তু আমার কাছে? বাস্তবের চাইতেও জীবন্ত।‘
ঘটনাচক্রে দুই ব্যর্থ প্রেমাস্পদের দেখা হয়ে যায়। প্রয়োজনের খাতিরেই একে অন্যের সংস্পর্শে এসে দুজন আবিষ্কার করে, ‘আমরা যে একইরকম ভাঙা। একইরকম একা।‘ তাহলে? এরপরের গল্পটা বন্ধুত্বের, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার। সামিরা বুঝতে পারে, যে ভালোবাসা মাঝপথে হাত ছেড়ে দেয়- সেটা আদতে ভালোবাসাই নয়। অন্যদিকে বীরও নিজস্ব গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু বীর-সামিরা কি একে অপরের প্রেমে পড়বে? নাকি নিখাদ বন্ধুত্বই চায় নির্মল দুটি হৃদয়?
থ্রিলারের ভিড়ে নির্মল প্রেম
গত দুই বছর যাবত অনলাইনের মাঠে মোটামুটি কড়া রাজত্ব করছে ওয়েব সিরিজগুলো। সময়ের সাথে নিজেদের বদলে না নিলে যে মুশকিল তা ভালোই জানে বালাজি টেলিফিল্মস। মিলেনিয়ামের প্রথম ভাগটায় টেলিভিশনে রাজত্ব করেছে তারা। তাই ওয়েবের মাঠে নেটফ্লিক্স, হুলু, অ্যামাজনের সাথে পাল্লা দিতে অল্প স্বল্প চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে মূল লক্ষ্য ভারতীয় দর্শক। সে ছক অনুসারেই প্রেমের গল্পকেই বেছে নিয়েছে একতা কাপুরের দল। বীর চরিত্রে রুপদানকারী ভিক্রান্ত মাসি বালাজির সাথে আগেও কাজ করেছেন। হারলিন শেঠির এটাই প্রথম ওয়েব সিরিজে কাজ।
অধিকাংশ ওয়েব সিরিজের গল্প আবর্তিত হয় থ্রিলার অথবা অপরাধ জনরা নিয়ে। দর্শকের সাড়াও কম থাকেনা। তবে একটু যদি হাঁফ ছেড়ে অন্যদিকে বিনোদিত হতে চান সেক্ষেত্রে ‘Broken but Beautiful’ নিঃসন্দেহে চমৎকার। জিতান হারমিত সিংয়ের ক্যামেরা কৌশল আর উন্নি কৃষ্ণানের সম্পাদনায় গোটা সিরিজেই সজীব, প্রাণচঞ্চল একটা আমেজ পাবে দর্শক।মাল্টি-ক্যামেরার গুণে ছোট ছোট ডিটেইলসেও মনোযোগ দিয়েছে পরিচালক। সেট, মেকআপ, পোশাক ও লোকেশন বাছাইয়েও যথার্থতার পরিচয় দিয়েছে। ক্যাফেতে সামিরা প্রতীক্ষা, আলিনা-বীরের মিষ্টি প্রেমের সুবাস, ইশানভির কাউন্সেলিং, বীর-সামিরার একসাথে আলিনার জন্মদিন পালন আর সবশেষে লেকের পাশে বীর-সামিরার চুম্বনের লংশট- মনে রাখার মতো সজল বেশ কিছু দৃশ্য আছে সিরিজে।
কারিগরিতেও দক্ষতা
রেশু নাথের গল্পে সন্তোষ সিংও সন্তোষজনক পরিচালনা করেছেন। ভিক্রান্ত আর হারলিন- দুজনের মতে পরিচালক তাদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দেয়াতে চরিত্র ফুটিয়ে তোলার কাজটা সহজ হয়েছে। প্রচুর ফ্ল্যাশব্যাক থাকলেও এলোমেলো লাগেনি পরিপক্ব সম্পাদনার জোরে। প্রতি পর্বের রানটাইম ২৩-২৫ মিনিট। রেশু নাথের লেখনিতে দারুণ কিছু সংলাপ পাওয়া গেছে সিরিজে। যেমন- বীরের কণ্ঠে, ‘কেউ যেন টুকরো টুকরো অংশ জুড়ে আমাকে তৈরি করেছে। সেকারণেই হয়তো খুব সহজে ভেঙে যাই।‘ সামিরাকে হালকা ব্যক্তিত্বের চরিত্র দেখালেও তার কাছ থেকেও এসেছে ভারি সংলাপ,‘একটা সম্পর্ক শুরুর বেলায় দুজন মানুষের সম্মতি চাই। অথচ শেষ করতে একজনের ইচ্ছে থাকাই যথেষ্ট। কি অদ্ভুত! না?’ প্রথমেই ইশানভির কাউন্সেলিংয়ে ভঙ্গুর হৃদয়ে সন্তাপের কথাও ছিল মনে রাখার মতো।
শ্রুতিমধুর ছিল এর সংগীত আয়োজনও। শ্রেয়া ঘোষাল ও দেব নেগির ডুয়েটে এসেছে থিম সং ‘ইয়ে কেয়া হুয়া’। রানা মজুমদারের কম্পোজিশনে মিষ্টি প্রেমের এই গানের ভিউ সংখ্যা প্রায় ৯৬ লাখ! তবে গোটা সিরিজের ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোরে রাহুল দেব নাথও পিছিয়ে নেই। গোটা সিরিজে নিটোল ভাবখানা ধরে রেখেছিল তার সুরই। এছাড়াও তেজাসের বাঁশির সুরে পাপনের বিচ্ছেদ গান ‘লটে নেহি’ও স্মৃতিকাতর করেছে শ্রোতাদের। আর প্রতি পর্ব শেষে পুজা-মিলিন্দ গাবার পাঞ্জাবি গান ‘সোনহেয়া’ তো আগে থেকেই জনপ্রিয়।
চরিত্রাভিনেতা বাছাইয়ে বেশ বুদ্ধির পরিচয়ই দিয়েছে বালাজি। ভিক্রান্ত মাসি বর্তমানে উঠতি তারকা, হারলিনও টেলিভিশন আর অনলাইনের পরিচিত মুখ। এই সিরিজের শক্তিশালি দিক হলো সম্পর্ক ভাঙার পর সামিরার বাস্তবসম্মত পোট্রেয়াল। যারা বীর বা সামিরার মতো সম্পর্ককে সম্যকরূপে পেয়েছেন তারা খুব সহজেই মেলাতে পারবেন নিজেকে।
নন্দিত বালাজি
‘অল্প কথায় কাজ হইলে বেশি কথার কাজ কী?’ প্রমথ চৌধুরীর কথাটা শেষ পর্যন্ত একতা কাপুরের বালাজি আত্মস্থ করতে পেরেছে। একসময় বালাজি মানেই ছিল বউ-শাশুড়ির অর্থহীন ঝগড়া আর অযৌক্তিকভাবে হাজার পর্বের সিরিয়াল। সে হিসেবে গত কয়েক বছরে ‘বোস: ডেড অর এলাইভ’,’ হাক সে’, ‘বারিশ’, ‘দ্য টেস্ট কেস’ এর মতো অনবদ্য সিরিজ উপহার দিয়েছে বালাজির ওয়েব প্ল্যাটফর্ম।
‘কতকাল নত আমি গলিপথে তার-
কোথায় বা যাব আর- এ বড় বন্ধন-
যেদিকেই যাই-পথ জুড়ে সে আমার।‘ – সেই কতকাল আগে হাফিজ তার শায়েরিতে প্রেমিকা বিরহে ফরিয়াদ জানিয়েছিলেন। এতটা দিন পরেও সেই কাতরতা বদলায় নি। প্রেমের কোন স্থান-কাল-পাত্র নেই, বিরহেরও নেই। তবুও নতুন আঙ্গিকে সূচনা করতেই হয় প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমির। দিনশেষে সামিরার মতো বিহঙ্গ হয়ে বলতেই হয় ‘আজ আমি মুক্ত।প্রাণ ভরে নিঃশ্বাসে আর বাধা নেই‘
লেখক- সারাহ তামান্না
আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (প্রথম পর্ব ): আশা-নিরাশার Bard of Blood
আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (দ্বিতীয় পর্ব): The Family Man- অপ্রতিরোধ্য বাজপাই
আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (তৃতীয় পর্ব): Broken but Beautiful- ভালোবাসার সাতকাহন
আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (চতুর্থ পর্ব): Delhi Crime- নির্ভয়া কেস ও বর্বর সমাজের আলাপন
আরও পড়ুন- ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (৫ম পর্ব): জামতারা: সাবকা নাম্বার আয়েগা- প্রতারণাই যে গ্রামের মূল পেশা