বাংলাদেশ

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীঃ গণতন্ত্রের মানসপুত্র1 min read

জানুয়ারি ৬, ২০২০ 6 min read

author:

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীঃ গণতন্ত্রের মানসপুত্র1 min read

Reading Time: 6 minutes

ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক উত্থান কিংবা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বলতে গেলে যে কয়জন নেতার নাম সবার আগে উচ্চারিত হবে, তাদের মধ্যে অন্যতম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ভারত উপমহাদেশের বাঙালি অধ্যুষিত এই অঞ্চলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ত্যাগী এই নেতা আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন। এছাড়াও এই উপমহাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিলো অগ্রগণ্য।

“গণতন্ত্রের মানসপুত্র” খ্যাত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জন্ম ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তাঁর পিতা ব্যারিস্টার স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের একজন খ্যাতনামা বিচারক এবং মা খুজাস্তা আখতার বানু ছিলেন একজন প্রখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক। তৎকালীন উর্দু সাহিত্যে মহিলা সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। 

তৎকালীন ভারতবর্ষে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলোতে উর্দু ভাষা ব্যাবহারকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। সোহরাওয়ার্দীর পরিবারেও এই রেওয়াজ ছিলো। কিন্তু তিনি নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষা শিখেছিলেন। উল্লেখ্য যে, দেশ ভাগের আগে ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া অখণ্ড স্বাধীন বাংলা নামে এক “ডোমিনিয়ন রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠার চিন্তা তাঁর মাথাতেই প্রথম এসেছিলো। যদিও ইতিহাসবিদদের মধ্যে এই বিষয় নিতে মতভেদ আছে। 

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

শৈশব এবং পড়াশুনা

সোহরাওয়ার্দীর শৈশব কেটেছে তাঁর পরিবারের সাথেই। তাঁর মা খুজাস্তা বানু ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম মহিলা যার থলিতে সিনিয়র কেম্ব্রিজ পাসের ডিগ্রী ছিলো। তাদের সাথেই থাকতেন খুজাস্তা বানুর নিঃসন্তান ভাই স্যার আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী। উচ্চশিক্ষিত মামা এবং মায়ের কাছ থেকেই শৈশবে তালিম নেন সোহরাওয়ার্দী। এরপর তাঁকে কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি করা হয়। সেখানে আরবি, উর্দু এবং ফার্সি ভাষা নিয়ে পড়াশুনা করার পাশাপাশি তিনি বাড়িতে মা এবং মামার কাছে ইংরেজি এবং বাংলা ভাষা শিখতেন। আলিয়া মাদরাসায় পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে তিনি ভর্তি হন সেইন্ট জ্যাভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকেই তিনি কৃতিত্বের সাথে বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর তাঁর মায়ের অনুরোধে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং আরবি ভাষা এবং সাহিত্যে স্নাতোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। 

১৯১৩ সালে পড়াশুনার জন্য তাঁকে ব্রিটেন পাঠানো হয়। ব্রিটেনের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবার বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি তেমন আগ্রহ না থাকায় তিনি সেখানে নতুন করে আইন বিষয়ে পড়ালেখা শুরু করেন এবং ১৯১৮ সালে সম্মানজনক বার এট ল ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯২০ সালে তিনি কলকাতায় ফেরত এসে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

সংসার এবং রাজনীতি

ব্রিটেন থেকে পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরে ১৯২০ সালে সোহরাওয়ার্দী তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আদবুর রহিমের কন্যা বেগম নেওয়াজ ফাতেমাকে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন। 

ভারত উপমহাদেশের এই মহান নেতার রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে তাঁর মামা আব্দুল্লাহ আল মামুন সোহরাওয়ার্দীর উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণায়। ১৯২১ সালের শুরু দিক থেকেই তিনি পুরাদস্তুর রাজনীতিবিদ বনে যান। একই বছর কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে প্রার্থী হন এবং নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেন। 

ইতোমধ্যে গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে স্বাধীনতার ঢেউ খেলতে শুরু করে দেয়। ব্রিটিশদের নাগপাশ থেকে ভারতকে মুক্ত করতে একে একে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে ভারতবর্ষের সর্বস্তরের জনগণ। একের পর এক আন্দোলন ঘনীভূত করতে থাকে স্বাধীন ভারতের সম্ভাবনা। কিন্তু এটাও অনুমেয় ছিলো যে, ভারত স্বাধীন হলেও এই উপমহাদেশের মুসলিমদের স্বাধিকার আন্দোলনের শেষটা অতো সহজে হবে না। তাই মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র কায়েমের আন্দোলন শুরু হয় কয়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে। এই আন্দোলনে ভারতবর্ষের মুসলিম অধ্যুষিত সর্ববৃহৎ এই অঞ্চলের নেতৃত্ব দেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। 

তৎকালীন বাংলায় ১৯২৩ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা প্রকট রূপ ধারণ করে। উভয়পক্ষের বহু মানুষ হতাহত হয়। দিনকে দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকলে সোহরাওয়ার্দী চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টিতে যোগ দেন এবং ঐতিহাসিক “বেঙ্গল প্যাক্ট” বা “বঙ্গীয় জাতীয় চুক্তি” স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে হিন্দু এবং মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা এবং সরকারি চাকরীতে বাংলায় ৫৬% মুসলিমদের নিয়োগের কথা উল্লেখ ছিলো। বেঙ্গল প্যাক্ট কার্যকর হলে বাংলায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ হয় এবং হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায় শান্তিতে বসবাস করতে শুরু করে।

১৯২৪ সালে কলকাতা পৌরসভার নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দী ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন। মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতা চিত্তরঞ্জন দাস। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মাথায় চিত্তরঞ্জন দাস মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বেঙ্গল প্যাক্ট বন্ধ হয়ে যায়। কারণ স্বরাজ পার্টির অন্যান্য নেতাদের বেঙ্গল প্যাক্টের চুক্তিগুলোতে অতোটা সায় ছিলো না। চিত্তরঞ্জন দাসের একার বলেই টিকে ছিলো বেঙ্গল প্যাক্ট। এই ব্যাপারটি নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে স্বরাজ পার্টির অন্যান্য নেতাদের মতবিরোধ শুরু হলে ১৯২৭ সালে তিনি পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯২৬ সালে তিনি মুসলিমদের জন্য পৃথক সংগঠন “ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি” প্রতিষ্ঠা করেন। 

বেঙ্গল প্যাক্ট বন্ধ হয়ে গেলেও উপমহাদেশের মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। বলতে গেলে তাঁর একার উদ্যোগেই ১৯২৮ সালে কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম কনফারেন্স আয়োজিত হয়। এই কনফারেন্সে তিনি লিখিত এক বক্তব্যে মুসলিমদের স্বার্থের কথা বলিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরেন। একই বছরের শেষ সপ্তাহে দিল্লীতে সর্বদলীয় মুসলিম নেতাদের বেশ কয়েক দিনব্যাপী এক বিশাল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনেই উপমহাদেশের মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষায় ১৪ দফা দাবি উত্থাপন করেন। 

১৯২৯ সালের এসেম্বলি নির্বাচনের পূর্বে “ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি” নামে আরেকটি স্বতন্ত্র সংগঠন তৈরি করেছিলেন  সোহরাওয়ার্দী। সে বার নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন তিনি। 

উপমহাদেশের প্রভাবশালী মুসলিম নেতা হওয়া সত্ত্বেও ১৯৩৬ সালের আগ পর্যন্ত মুসলিম লীগের সাথে তাঁর কোন সম্পৃক্তা ছিলো না। এ বছর ভারত শাসন আইন পাস হলে ভারতবর্ষে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। নির্বাচনের আগে তাঁর সংগঠন  “ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি” বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। নির্বাচনে তাঁর তৎপরতায় বাংলার অধিকাংশ মুসলিম আসনগুলোতে মুসলিম লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। নির্বাচনে  জয়লাভের পর মুসলিম লীগ ও শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি কোয়ালিশন করে মন্ত্রীসভা গঠন করে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলার প্রথম মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের জয়ের পেছনে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা ছিলো হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক নিজেও এ কথা স্বীকার করেছেন। এই নির্বাচনে মুসলিম লীগের জয়ের পর বাংলায় মুসলিমদের মধ্যে নতুন আশার আলোর সঞ্চার হয়। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্যে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে বাংলা। 

১৯৪৩ সালে প্রবল গণরোষের মুখে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার পতনের পেছনে তাঁর অবদান ছিলো মুখ্য। এই মন্ত্রীসভার পতনের পর খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। নতুন মন্ত্রীসভার অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ছিলেন তিনি। এই মন্ত্রীসভায় সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী, পৌর সরবরাহ মন্ত্রীসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। আবুল হাশিম এবং তাঁর কৃতিত্বতায় ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করে এবং হোসেন শহীদ সোহওয়ার্দী বাংলার মূখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মূলত এই বিজয়েই মুসলিমদের জন্য “পাকিস্তান” নামে পৃথক রাষ্ট্রের দ্বার উন্মোচন হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি পূর্ণ সমর্থন দেন এবং সহযোগিতাও প্রদান করেন।

১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট স্বাধীন ভারতবর্ষের ব্যাপারে ব্রাক্ষনবাদী নেতাদের কেবিনেট মিশন প্ল্যানের বিরুদ্ধে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেন। বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হওয়ার সুবাধে তিনি ঐদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। ভারতবর্ষের মুসলিম নেতারা চাইছিলেন মুসলিমদের জন্য সার্বভৌম এবং আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠন করতে। এই ইস্যুতে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা প্রবল রূপ ধারণ করে। বাংলাদেশের নোয়াখালীতেও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। এই দাঙ্গার সময় মুখ্যমন্ত্রী হওয়া স্বত্বেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নীরব ভূমিকার জন্য হিন্দুদের কাছে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। 

এরপর তাঁর নিজের উদ্যোগে দিল্লীতে এক সম্মেলনে লাহোর প্রস্তাবের একটি বিতর্কিত সংশোধনী উত্থাপন করা হয়। এই সংশোধনীতে অখণ্ড স্বাধীন বাংলার কথা উল্লেখ ছিলো। কিন্তু হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় তাঁর নীরব ভূমিকার কারণে হিন্দুদের কাছে এই সংশোধনী তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায় নি। উল্লেখ্য যে, শরৎচন্দ্র বসু ছাড়া কংগ্রেসের আর কোন নেতাই অখণ্ড বাংলা প্রস্তাবে সায় দেননি। এসব কারণে ১৯৪৭ সালে সোহরাওয়ার্দী মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তান না গিয়ে বরং কলকাতাতেই থেকে গিয়েছিলেন। কিন্ত ১৯৪৯ সালের দিকে তৎকালীন ভারত সরকার তাঁর উপর অনৈতিকভাবে করের বোঝা চাপাতে থাকলে তিনি ভারত ছেড়ে পাকিস্তান চলে যেতে বাধ্য হন। 

দেশ ভাগের পর খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম নেতারা বেশ শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী হয়ে উঠেন। খাজা সাহেব পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলে সোহরাওয়ার্দী আইনসভার সদস্যপদ পান। কিন্তু অনেক নেতারাই তাঁকে ভারতীয় এজেন্ট এবং পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে অভিহিত করতে থাকে। রোষের মুখে তাঁকে পাকিস্তানের আইনসভা থেকে অপসারণ করা হয়। 

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশেমের নেতৃত্বে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সমর্থনে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” প্রতিষ্ঠিত হয়।

এরপর সোহরাওয়ার্দীর অনুসারীরা ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ গঠনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলো।  ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশেমের নেতৃত্বে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সমর্থনে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসম্প্রাদিয়কতার কথা মাথায় রেখেই পরবর্তীতে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নাম হয় “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ”। সংগঠনের সভাপতি হন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিব তখন কারাগারে বন্দী অবস্থায় ছিলেন।  গোটা পাকিস্তানের কথা মাথায় রেখে সংগঠনটির নাম দেওয়া হয় “নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ”। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৫৩ সালে তিনি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন উপলক্ষে যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রচার করে। এই ইশতেহারের অন্যতম বিষয়গুলো ছিলো- লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা করা, ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে শহীদ মিনার নির্মাণ ইত্যাদি। 

১৯৫৪ সালের মার্চ মাসের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের মধ্যে ২২৩ টিতেই বিজয় লাভ করে। এর মধ্যে ১৪৩ টি আসন পেয়েছিলো আওয়ামী মুসলিম লীগ। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভায় সোহরাওয়ার্দী আইন মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরি মুহাম্মদ আলী পদত্যাগ করলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ নেন। এই পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে তাঁকে ব্যাপক রাজনৈতিক বিরোধের মুখে পরতে হয়। ১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে ছিলেন। এরপর ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দর মির্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন এবং তাঁকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধে তাঁকে ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি গ্রেফতার করা হয়। একই বছর ১৯ আগস্ট মুক্তি পেয়ে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্যে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা এন ডি এফ গঠন করেন। 

মৃত্যু

এন ডি এফ গঠনের জন্য তিনি দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। বয়সের তুলনায় পরিশ্রম মাত্রাতিরিক্ত বেশি হওয়ার ফলস্বরুপ তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে এবং তিনি অসুস্থ হয়ে যান। ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে করাচীর জিন্নাহ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। স্বাস্থ্যের একটু উন্নতি হলে উন্নত চিকিৎসার  জন্য তাঁকে লেবাননের বৈরুতে পাঠানো হয়। বৈরুতের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানকালে ৫ ডিসেম্বর রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় এই মহান নেতার। তাঁর মৃত্যু আজও রহস্যমণ্ডিত। 

লেখক- নিয়ন রহমান

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *