ইতিহাস

ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনকাল1 min read

মে ১৪, ২০২০ 4 min read

author:

ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনকাল1 min read

Reading Time: 4 minutes

ভারতবর্ষের জনপদ বহুকাল ধরে দেখেছে অনেক শাসকের শাসন। নানান চড়াই উতরাই পেরিয়ে সেসব শাসকের শাসনামলে মানুষের জীবনে এসেছে ঘাত প্রতিঘাত আর সোনালী সময়। খ্রিষ্টের জন্মের পর সবচাইতে বেশি সময় ধরে ভারতবর্ষ শাসন করে গেছে যে তিন সাম্রাজ্য সেগুলোর মধ্যে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রভাব প্রতিপত্তির কথা আজো মানুষ বিস্ময়ের সাথে স্মরণ করে। তিনশো বছর ধরে শাসন করে যাওয়া মুঘলদের নিয়েই আজ জানবো আমরা।

মৌর্য ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পর মুঘলদের শাসনকাল ছিল এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শাসনকাল। ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের সীমানা বর্তমান বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্থান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সমসাময়িক অন্যান্য সাম্রাজ্যের তুলনায় ভীষণ প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করা মোঘলদের শাসনক্ষেত্র ছিল ৪০ লাখ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের। সে সময় প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মানুষ ছিল এই সাম্রাজ্যের অধীনে।

১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধে  জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর আফগান শাসক ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করে। এরই মাধ্যমে গোড়াপত্তন হয় মুঘল শাসনের। মুঘলরা মূলত মোঙ্গলীয় ও তুর্কী বংশোদ্ভূত। বাবর ছিলেন পিতার দিক থেকে তৈমুর লং ও মাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর। মুঘলদের শাসনামলে তাদের অধিকৃত সাম্রাজ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। সেই সময়কার হিসেবে ভারতবর্ষ গোটা বিশ্বে জিডিপির হিসেবে চতুর্থ অবস্থানে ছিল যার পরিমাণ নব্বই বিলিয়ন ডলার।

বাবর ছিলেন উজবেকিস্তানের সন্তান। উজবেকিস্তানের ফরগনা রাজ্যে জন্ম নেওয়া বাবরের পিতা ছিলেন সেই রাজ্যেরই অধিপতি। কমবয়সে পিতাকে হারিয়ে মাত্র ১১ বছর বয়সেই ফরগনা রাজ্যের সিংহাসনে বসেন তিনি। সিংহাসনে বসার পর থেকেই বাবরকে সাম্রাজ্য বাড়ানোর নেশায় পেয়ে বসে। প্রথমে তিনি উজবেকিস্তানের সমরকন্দ দখল করেন। সেটি ছিল ১৪৯৭ সালের ঘটনা। এরই মাঝে দুবার তিনি সিংহাসন হারান। এরপর তিনি নিজ দেশ ছেড়ে আফগানিস্তানের দিকে নজর দেন। কালক্রমে তিনি আফগান সিংহাসন দখল করে নেন। ১৫২৬ সালের এপ্রিল নাগাদ বাবর পানিপথে ইব্রাহীম লোদীর সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এটিই পানিপথের প্রথম যুদ্ধ। মাত্র হাজার বারো সৈন্য নিয়েই অভিনব রণকৌশল ও দক্ষতায় বাবর ইব্রাহীম লোদীর প্রায় লক্ষাধিক সৈন্যকে পরাস্ত করেন । এরই মাধ্যমে দিল্লী ও আগ্রা বাবুরের অধীনে চলে আসে। যাত্রা শুরু হয় মুঘল সাম্রাজ্যের।

পরবর্তী চার বছরে অর্থাৎ ১৫২৬ থেকে ১৫২৯ সালের মধ্যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন বংশের রাজাদের সাথে বাবরের যুদ্ধ হয়। রাজপুত ও সমসাময়িক অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে যুদ্ধে জয় লাভের মাধ্যমে বাবুর দ্রুত সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকে। একইসময়ে বাংলা বিহার সহ অন্যান্য রাজ্য বাবরের আনুগত্য স্বীকার করে নেয়।

মুঘল সাম্রাজ্য সৃষ্টির মাত্র চার বছর পরই ১৫৩০ সালে পরলোক গমন করেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট বাবর। এরপর ক্ষমতায় আসেন তার সুযোগ্য পুত্র হুমায়ুন। বাবরের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য ভারতবর্ষের কাবুর থেকে গোখরা ও গোয়ালিয়র থেকে বাংলা পর্যন্ত বাড়লেও সে সময়ে অনেক এলাকায় শাসনতান্ত্রিক জটিলতা, বিদ্রোহ ও অস্থিরতা চলছিল। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে হুমায়ুনের শাসনামলে।

১৫৩৮ সাল নাগাদ চৌসা ও কনৌজ যুদ্ধে হুমায়ুন দুর্ধর্ষ নেতা শের শাহের নিকট পরাজিত হন। ফলে দিল্লী ও আগ্রার দখল চলে যায় শেরশাহ এর কাছে। পরে পারস্যের শাসক শাহ তামাস্পের সহযোগিতায়  প্রথমে লাহোর উদ্ধার করেন। এরপর ১৫৫৫ সালে হুমায়ুন আবারো দিল্লী ও আগ্রা দখল করে নেন। ফলে আবারো ক্ষমতা এসে যায় মুঘলদের কাছে। কিন্তু এর পরের বছর আকস্মিকভাবেই মৃত্যুবরণ করেন সম্রাট হুমায়ুন।

এরপর দিল্লীর মসনদে বসেন হুমায়ুন পুত্র সম্রাট আকবর। পিতামহ বাবরের মতোই আকবর মাত্র ১১ বছর বয়সে ক্ষমতায় বসেন । আকবরের শাসনকালের বেশিরভাগ বিষয়াদি পরিচালনা করতেন চাচা বৈরাম খাঁ। হুমায়ুনের আমলে শাসনতান্ত্রিক অস্থিতিশীলতার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য আকবর আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্যের দিকে নজর দেন তিনি। ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাই মুঘলদের সাথে সবচেয়ে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ছিল রাজপুতরা। রাজপুতদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষে আকবর এক রাজপুত নারীকে বিয়ে করেন। ফলে মুঘলরা নিজেদের সাম্রাজ্য বাড়ানোর এক দারুণ সুযোগ পায়।

অনবদ্য সব স্থাপনা গড়ে তোলায় মুঘলদের জুড়ি ছিল না। ফতেহপুর সিক্রি, অমৃতসর মন্দির, দিল্লীর জামে মসজিদ, আগ্রার তাজমহল নির্মাণসহ ভারতবর্ষের নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ করা হয় মুঘলদের পৃষ্ঠপোষকতায়। মুঘলদের সময়টিকে শিল্প সাহিত্য বিকাশের একটি উর্বর সময় বলে বিবেচনা করেন ঐতিহাসিকগণ। বিশেষ করে সম্রাট আকবরের সময়টিতেই মুঘলরা ধন সম্পদের চূড়ায় উঠে আসে। জিডিপির হিসাবে  তারা গোটা বিশ্বে চতুর্থ স্থান দখল করে নেয়। এছাড়া ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নিদর্শন হিসেবে সম্রাট আকবর দ্বীন-ই-ইলাহী নামে নতুন একটি ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন।

বাংলা সন প্রবর্তন ও খাজনা প্রদানকে একপ্রকার অনুষ্ঠানে রূপ দেওয়ার কৃতিত্ব সম্রাট আকবরকেই দেওয়া হয়। তা থেকেই বর্তমান হালখাতা উৎসব এর আগমন। আর এই হালখাতা তো বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আকবরের শাসনামলেই মুঘলদের সাম্রাজ্যের বিকাশ ঘটেছিল সবচেয়ে বেশি। তাই তাকে শ্রেষ্ঠ মুঘল সম্রাট হিসেবে বললেই তা মোটেও অত্যুক্তি করা হবেনা। ১৬০৫ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন সম্রাট আকবর। চতুর্থ সম্রাট হিসেবে এরপর আবির্ভূত হন সম্রাট জাহাঙ্গীর।

১৬০৫ থেকে ১৬২৭ সাল অব্দি মুঘল রাজধিরাজ ছিলেন জাহাঙ্গীর। ব্যাপক পরিমাণ মাদক আসক্তি ও নারী নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকা সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে স্বভাবতই অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়ে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত। তবে বলে রাখা ভাল তার শাসনামলেই সমগ্র বাংলা অঞ্চল মুঘলদের অধীনে আসে। সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১০ সালে তৎকালীন বাংলার রাজধানী বিহারের রাজমহল থেকে বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী ঢাকায় স্থানান্তর করেন। সে সময় ঢাকার নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর। এছাড়া সরকারী দাপ্তরিক কাজে বাংলার পাশাপাশি ফারসি ভাষার প্রচলন করেন এই সম্রাট। ১৬২৭ সালে মারা যান সম্রাট জাহাঙ্গীর।

মুঘল সাম্রাজ্যের পঞ্চম সম্রাট হিসেবে জাহাঙ্গীরের পুত্র খুররম ‘শাহজাহান’ নাম ধারণ করে দিল্লীর মসনদে বসেন। তাঁর শাসনামলকে মুঘল শাসনামলের স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিল্প-সংস্কৃতির অসামান্য বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে বলা হয় প্রিন্স অব বিল্ডার্স। সম্রাট শাহজাহান বললেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে তাজমহলের দৃশ্য। তার স্ত্রী মমতাজের স্মৃতির উদ্দেশ্যে যমুনার তীরে দূর্লভ শ্বেত পাথরের অনন্য স্থাপনা নির্মাণ করেন তিনি। এছাড়া দিল্লীর লাল কেল্লা, আগ্রার দূর্গ, দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস এর মত স্থাপনা তাঁর হাত ধরেই সৃষ্টি।

এ ছাড়া যে ব্যাপারটি না বললেই নয় তা হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরকখন্ড কোহিনূর হীরা ও মণিমুক্তা খচিত অসাধারণ ময়ূর সিংহাসন সম্রাট শাহজাহানেরই অমর সৃষ্টি। অবশ্য এই দুটোই শেষ পর্যন্ত থাকেনি মুঘলদের হাতে।১৭৩৯ সালে পারস্যের সম্রাট নাদির শাহ ময়ূর সিংহাসন লুন্ঠন করে নেয়। আর কোহিনূর হীরা ব্রিটিশ মিউজিয়ামেই শোভা পাচ্ছে এখন।

সম্রাট শাহজাহানের শেষজীবন সুখের ছিলনা। চার পুত্রের মধ্যে কোন্দলের মধ্যে পড়ে গিয়ে পুত্র আওরঙ্গজেবের দ্বারা গৃহবন্দী হন। নিজেরই সৃষ্ট আগ্রার দূর্গে ১৬৬৬ সালে তিনি মৃত্যবরণ করেন। আওরঙ্গজেব ভাইদের মধ্যকার কলহে জয়ী হন এবং আলমগীর নাম ধারণ করে সিংহাসনে আসীন হন। তাঁর শাসনামলে ভারতবর্ষে মুঘলরা সবচাইতে শক্তিধররূপে আবির্ভুত হন। প্রায় ৪৯ বছর অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে মুঘল সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন আওরঙ্গজেব। নানা ধরনের কর প্রথা তার আমলেই চালু হয়। কথিত আছে, সাধারণ জীবনধারা ও ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করায় তিনি জিন্দাপীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই প্রভাবশালী শাসক ১৭০৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

এরপর মোঘল সাম্রাজ্যে নেমে আসে বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্য। আওরঙ্গজেবের পর ক্ষমতায় আসা পুত্র প্রথম বাহাদুর শাহ প্রশাসন সংস্কারের চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৭১২  সালে তাঁর মৃত্যু ঘটলে মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের শুরু হয়। এরপর সম্রাট মোহাম্মদ শাহের শাসনামলে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে মুঘল শাসনব্যবস্থা। এ সময় মধ্য ভারতের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেয় মারাঠারা। একই সময় পারস্যের নাদির শাহ দিল্লী আক্রমণ করলে হ্রাস পেতে থাকে মুঘল শক্তি। এরপর দ্বিতীয় শাহ আলম মুঘলদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করেন।

আফগান শাসক আহমদ শাহ আবদালীর সহযোগিতায় দ্বিতীয় শাহ আলম ১৭৬১ সালে মারাঠাদের পরাজিত করে। ঐতিহাসিক পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ ছিল এটি। কিন্তু ১৭৭৬ সালে মারাঠারা ঠিকই দিল্লী দখল করে নেয়।

ইতিহাসের শেষ মুঘল শাসক দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের শাসনামল শুধুমাত্র শাহজাহানবাদ নামক শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহে সমর্থন দানের অভিযোগ দায়ের করে ব্রিটিশরা । ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হন তিনি । এর ফলে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত রেঙ্গুন শহরে (বর্তমানে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন শহর) তাকে নির্বাসিত করা হয়। আর এরই মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর মোঘল শাসনামলের সমাপ্তি ঘটে।

উত্থান, বিকাশ ও পতন সভ্যতার ইতিহাসের একটি চিরাচরিত প্রাক্রিয়া। এক সময় ভীষণ প্রভাব বিস্তার করা সাম্রাজ্য কালের গর্ভে হারায়। এ ব্যপারটি মোঘলদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে বৈকি।

লেখক- মাহের রাহাত 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *