বিশ্ব

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল: নার্সিং জগতের কিংবদন্তী1 min read

এপ্রিল ৮, ২০২০ 4 min read

author:

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল: নার্সিং জগতের কিংবদন্তী1 min read

Reading Time: 4 minutes

তিনি যখন নার্সিং পেশায় এসেছিলেন, তখন নার্সিং ছিল কেবলই দরিদ্র আর নীচু জাতের জন্য। যখন ক্লান্ত হয়ে অবসর নিলেন, তখন তিনি কিংবদন্তী। সেবার ধর্ম যদি কেউ ধারণ করে জগতে ইতিহাস রচনা করে থাকেন, তবে তাদের সবার আদর্শ বোধকরি এই একজন নারী। নাম তার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে তিনি একাই বাঁচিয়েছেন অজস্র সৈনিক। মানুষকে শিখিয়েছেন যুদ্ধে নয়, সেবা দিয়ে পৃথিবী আরো অনেক বেশি সুন্দর করা যায়। তিনি পৃথিবী ছেড়েছেন ১১০ বছর আগে। কিন্তু তার শিক্ষা আজো সুস্থ রাখে সারাবিশ্বকে।

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্ম আজ থেকে ঠিক ২০০ বছর আগে। ১৮২০ সালের ১২ মে ইতালির শহর ফ্লোরেন্সে জন্ম নেন তিনি। বাবা মায়ের দুই মেয়ের মাঝে ফ্লোরেন্স ছিলেন ছোট। তার ধনী ব্রিটিশ পরিবারের বাবা মা দুজনেই ছিলেন সমাজের অভিজাত শ্রেণীর প্রতিনিধি। তার মা, ফ্রান্সিস নাইটিঙ্গেল ধনাঢ্য বণিক পরিবারের সন্তান ছিলেন এবং তিনি সবসময় সামাজিকভাবে অপেক্ষাকৃত ভাল পদমর্যাদার মানুষদের সাথেই মেলামেশা করতেন, তবে মায়ের ইচ্ছের বিপরীতে ফ্লোরেন্স সবার সাথেই মেশার পক্ষপাতী ছিলেন। তার মা সবসময় সামাজিকভাবে নিজেদের অন্য উচ্চতায় নিতে চাইলেও ফ্লোরেন্স প্রায়ই মায়ের কথার বিরুদ্ধে চলতেন। নিজের জীবনীতে এই প্রসঙ্গে তিনি নিজের পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন অবশ্য। “আমার মনে হয় আমি মায়ের তুলনায় ভাল আচরণ আর স্বভাবের অধিকারী ছিলাম।“ ছেলেবেলা থেকেই এমনভাবেই বেড়ে উঠেছিলেন ফ্লোরেন্স, সবার প্রতি সমান মনোভাব নিয়ে।

ফ্লোরেন্সের বাবা ছিলেন একজন জমিদার। উইলিয়াম শোর নাইটিঙ্গেলের ডার্বিশায়ার এবং হ্যাম্পশায়ারে দুটো আলাদা এস্টেট ছিল। ফ্লোরেন্সের বয়স যখন পাঁচ তখন তার পুরো পরিবার ইতালি থেকে ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ারে থিতু হয়। এখানেই ফ্লোরেন্সের বাবা তাকে পুরোপুরি শিক্ষিত করে তোলেন। সেই সাথে তিনটি ভাষা রপ্ত করেন তিনি। জার্মান, ফ্রেঞ্চ এবং ইতালিয়ান ভাষায় ছোটবেলাতেই দক্ষ হয়ে ওঠেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল

ডার্বিশায়ারে থাকার সময়েই ফ্লোরেন্সের মনে মানুষের প্রতি মমতা এবং অসুস্থদের সেবা করার প্রবণতা দেখা যায়, তিনি তার অসুস্থ প্রতিবেশিদের সুযোগ পেলেই সেবা করার চেষ্টা করতেন। ১৬ বছর বয়সে যখন তিনি পরিবারের সামনে নার্স হবার ইচ্ছা পোষণ করেন তখন তার বাবা মা কেউই তাকে সায় দেয়নি। তৎকালীন সময়ের রীতি অনুয়ায়ী, ফ্লোরেন্সের সমমর্যাদার নারীদের জীবনে কৈশোর বয়স মানেই অভিজাত কোন পরিবারের স্ত্রী হয়ে যাওয়া। কিন্তু ফ্লোরেন্স আর দশজনের মত জীবন বেছে নিলেন না। পুরো একবছর পরিবারের মতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ১৮৪৪ সালে তিনি জার্মানির কাইজারওয়ার্থে লুথেরান হস্পিটাল অফ পাস্টর ফিল্ডনারে নার্সিং এর জন্য ভর্তি হন।

১৮৫০ সালের শুরুর দিকে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল লন্ডনে ফিরে আসেন। সেবছরই তিনি মিডলসেক্স হাসপাতালে কর্মজীবন শুরু করেন। হাসপাতালে তার কাজ এতই ভাল ছিল যে, নিয়োগ পাবার এক বছরের মাঝেই তিনি সুপারিনটেন্ডেন হিসেবে পদোন্নতি পান। তার এই পদোন্নতি কাজের চ্যালেঞ্জকে অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়, কারণ সেই সময়েই কলেরার প্রাদুর্ভাব মহামারী আকারে ধারণ করে এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সেসময় পর্যাপ্ত সচেতনতা না থাকায় রোগের লাগাম টানা ছিল বেশ দুঃসাধ্য। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এসময় জীবানুর বিরুদ্ধে লড়াই করা শুরু করেন এবং হাসপাতালে পরিচ্ছন্ন পরিবেশের জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। এর ফলাফলও আসে হাতেনাতে। কমে আসতে থাকে কলেরায় মৃত্যুর সংখ্যা।

মূলত অতিরিক্ত পরিশ্রমই ফ্লোরেন্সের পরবর্তী জীবনের জন্য ভোগান্তি হয়ে আসে। কলেরার এই ধকল না কাটতেই আসে তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ। অটোমান সম্রাজ্যের দখল নেয়ার জন্য গ্রেট ব্রিটেন রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার ব্রিটিশ সৈন্যকে পাঠানো হয় ব্ল্যাক সি-তে। সেখানে তাদের রসদ ফুরিয়ে আসতে খুব বেশি সময় নেয়নি। ১৮৫৪ সালে প্রায় ১৮ হাজার সৈন্যকে ক্রিমিয়ায় নিয়ে রাখা হয়। সেই সময় ক্রিমিয়ায় কোন নারী নার্স ছিল না। তাদের অতীত ইতিহাস ভাল না থাকায় মূলত এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৮৫৪ সালের শেষদিকে এসে সেক্রেটারি অফ ওয়ার, সিডনি হার্বাটের একটি পত্র পান। যেখানে তাকে অনুরোধ করা হয় ক্রিমিয়ায় দল নিয়ে যোগদান করার জন্যে। এবং ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল সাথে সাথেই দল গঠন করে ক্রিমিয়ায় যাত্রা শুরু করেন।

ফ্লোরেন্স তার ৩৪ জনের দল নিয়ে যখন ক্রিমিয়ায় পৌঁছান, তখন স্কুটারি হাসপাতালের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। গজ ব্যান্ডেজ থেকে শুরু করে পানির সরবরাহ ছিল অত্যন্ত কম মাত্রায়। আর পরিবেশ এতটাই নোংরা ছিল, সৈনিকদের বিছানায় পোকামাকড়ের উপদ্রব যুদ্ধকালীন ক্ষতের তুলনায় বেশি যন্ত্রণার হয়ে উঠল। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল প্রথমেই যুদ্ধে কম আক্রান্ত সৈনিকদের হাসপাতালের মেঝে থেকে ছাদ অব্দি পরিষ্কারের কাজ বুঝিয়ে দেন। নিজের দলকে ভাগ করেন বিভিন্ন ছোট ছোট কাজে। নিজেদের ব্যবস্থাপনায় রান্নাঘর তৈরি করে তাতে প্রস্তুত করা হয় রোগীদের জন্য আলাদা খাবার। এমনকি হাসপাতালে লন্ড্রির ব্যবস্থাও করা হয়।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধে থাকা অবস্থায় প্রতিটা মুহুর্তে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল হেটেছেন করিডোরের পর করিডর। গিয়েছেন প্রতিটি সৈন্যের পাশে। এমনকি সন্ধ্যায় হারিকেন হাতে ছুটেছেন রোগীর পাশে। পরবর্তীতে তার নামই হয়ে “দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প।“ অনেকেই তাকে ডাকতে শুরু করেন, “দ্য অ্যাঞ্জেল অফ ক্রিমিয়া।“

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শেষে যখন ফ্লোরেন্স ফিরে আসেন তখন ১৮৫৬ সাল। অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে ফ্লোরেন্সের স্বাস্থ্য তখন খুবই নাজুক। একরকম শঙ্কা নিয়েই ফেরেন নিজের ডার্বিশায়ারের বাড়িতে। কিন্তু ফিরে এসে পান বীরের সম্মাননা। হাসপাতাল নিয়ে তার ৮৩০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট ততদিনে ব্রিটেনে তাকে আলাদা এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। তার সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই ১৮৫৭ সালে গঠিত হয় “রয়্যাল কমিশন ফর দ্য হেলথ অফ দ্য আর্মি।“

যুদ্ধ শেষে স্বয়ং ব্রিটেনের রাণী তাকে “নাইটিঙ্গেল জুয়েল” লেখা একটি স্মারক উপহার দেন। ব্রিটেন সরকারের পক্ষ থেকে আড়াই লাখ পাউন্ডের অর্থ তাকে পুরষ্কার হিসেবে দেয়া হয়। যেই পুরষ্কারের টাকায় তৈরি হয় সেইন্ট থমাস হাসপাতাল এবং নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল ফর নার্সেস। তার দেখায় ততদিনে নার্সিং নিয়ে ধারণাও বদলাতে শুরু করেছে অভিজাত শ্রেণির মাঝে।

এরপরের জীবন মোটামুটি স্বস্তিতেই এবং পৃথিকৃৎ হিসেবেই কাটিয়েছেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। আমেরিকার গৃহযুদ্ধেও পরামর্শদাতা হিসেবে ছিলেন তিনি। এমনকি ভারতেও এসেছিলেন জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। তার মৃত্যু হয় ১৯১০ সালের মে মাসে। ৯০ বছর বয়সে নিজের গড়া হাসপাতালে থেকেই পৃথিবীকে বিদায় বলেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।

তিনি যখন হারিকেন হাতে সৈনিকদের পাশে ছিলেন, তখনও নার্সিং মানেই নিচু জাতের পেশা। তার সেই হারিকেন শুধু ক্রিমিয়ারের প্রান্তরেই থামেনি, আলো দিয়েছে সারা বিশ্বে। নার্সিং এর সংজ্ঞা বদলেছে সেই হারিকেনের আলোয়। “দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প” থেকে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল হয়েছেন সারা বিশ্বের কিংবদন্তী।

লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *