featured বিশ্ব

চীনের তিয়ানানমান স্কয়ার গণহত্যা, নিহত হয়েছিল প্রায় ১০ হাজার আন্দোলনকারী1 min read

জুলাই ১১, ২০১৯ 3 min read

author:

চীনের তিয়ানানমান স্কয়ার গণহত্যা, নিহত হয়েছিল প্রায় ১০ হাজার আন্দোলনকারী1 min read

Reading Time: 3 minutes

১৯৮৯ সালের জুন মাসের ৩ ও ৪ তারিখে চীনের রাজধানী বেইজিং এর তিয়ানানমেন স্কয়ারে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার দাবিতে সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলন করে। কিন্তু সেদিন তিয়ানানমেন স্কয়ারে ঘটে গিয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্যতম ঘটনাগুলোর একটি। গণতন্ত্রপন্থী কিছু ছাত্রনেতার ডাকে ঐ সমাবেশে যোগ দিয়েছিল চীনের হাজারো সাধারণ জনগণ। সেই সমাবেশে চীনের সেনাবাহিনী উপর্যুপরি গুলি চালিয়ে প্রায় দশ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল।

১৯৮৯ সালের এপ্রিলে কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক নেতা ও  বর্তমান চীনের গণতন্ত্রপন্থী ও সংস্কারবাদী নেতা হু ইয়াও ব্যাং মারা যান। তার মৃত্যুর পর প্রতিবাদী ছাত্র নেতারা বেইজিং হয়ে তিয়ানানমেন স্কয়ার অভিমুখে একটি মিছিল বের করে। হু এর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর ছাত্ররা গণতন্ত্রের দাবিতে জোড়ালো আন্দোলন শুরু করে। মোটামুটি মে মাসের মাঝামাঝি নাগাদ তাদের এ আন্দোলনে হাজারো সাধারণ জনগণ যোগ দেয়। তখন দেশের মধ্যে একটা অরাজকতার সৃষ্টি হয়— একপাশে কমিউনিস্ট সরকার আর অন্য দিকে গণতন্ত্রপন্থী ছাত্র-জনতা। তার সাথে দেখা দেয় অর্থনৈতিক বৈষম্য। যদিও ১৯৮০র দশকে চীন সরকার সংস্কারমূলক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু পুঁজিবাদ সৃষ্টি হওয়ায় অন্য ঝামেলা তৈরি হলো। দরিদ্র ও শ্রমিক পর্যায়ের জনগণ অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে চাকরির স্বল্পতা দেখা দেয়। ফলে দারিদ্র্যতা দিন দিন বাড়তে থাকে।

ছাত্রসমাজ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। তারা সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তারা বলে, চীনের শিক্ষাব্যবস্থা ছাত্রদের অনুকূলে নেই। এর পরিবর্তন প্রয়োজন। কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মকর্তা ছাত্রদের এ দাবির সাথে একমত পোষণ করলেও অনেকেই এটাকে হুমকি ভেবেছিল।

মে মাসের ১৩ তারিখে আন্দোলনরত কয়েকজন ছাত্র মিলে অনশন ধর্মঘট শুরু করে। তাদের দেখে সমগ্র চীন জুড়ে বিভিন্ন ধরণের মিটিং-মিছিল ও অনশন করতে আরম্ভ করে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। এসব আন্দোলন দেখে চীন সরকার ঘাবড়ে যায়। এদিকে মে মাসের ১৫ তারিখে চীনের পরম মিত্র রাশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিখেইল গর্বাচেভের চীন সফর করার কথা। চীন সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী তিয়ানানমেন স্কয়ারে গর্বাচেভের স্বাগত অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিয়ানানমেন স্কয়ার তখন বিক্ষোভকারীদের দখলে। তাই বাধ্য হয়ে বিমানবন্দরেই রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানানো হয়।

চীন সরকারের মানসিক অবস্থা তখন কেমন তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকার প্রধান তখন মনে হয় ভাবছিল, “পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে”। সরকার ২০ মে মার্শাল ল জারি করে এবং সেই সাথে বেইজিংয়ে  ২,৫০,০০০ সেনা মোতায়েন করে। মে মাসের শেষের দিকে তিয়ানানমেন স্কয়ারে প্রায় এক মিলিয়ন আন্দোলনকারী জমা হয়। তারা প্রতিদিনই হয় মিছিল না হয় জনসভা করতে থাকে। আর সেসব ছবি তুলে বহির্বিশ্বে তাদের আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে থাকে।

এসব পদক্ষেপ চীন সরকারের রক্তচক্ষুকে আড়াল করতে পারে নি। সরকার ভাবল এই উটকো ঝামেলাটা এমনভাবে ঝাড়তে হবে যেন তাবৎ দুনিয়া কেঁপে ওঠে। আর চীনে ভবিষ্যতে যেন এ ধরণের আন্দোলন করার কথা কেউ স্বপ্নেও না ভাবে। তারপর এলো সেই বিভীষিকাময় রাত। যার কথা মনে হলে এখনও চীনের সাধারণ মানুষের আত্মা কেঁপে ওঠে।

চীন সরকারের দাবি সেখানে ২০০ জনের মতো মানুষ মারা গিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত এক নথিতে সেদিনের হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সামরিক আইন জারি করে আন্দোলন দমনের সময় প্রায় ১০ হাজার আন্দোলনকারী প্রাণ হারিয়েছিলেন।

গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনরত জনসাধারণকে ঠেকাতে চীনের সামরিক বাহিনী যে তান্ডব চালিয়েছিল তার মর্মান্তিক কাহিনী বর্ণনা করেছেন ততকালীন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত অ্যালান ডোনাল্ড। তিনি ৫ জুন লন্ডনে পাঠানো এক টেলিগ্রাম বার্তায় জানিয়েছিলেন যে, সাঁজোয়া যান নিয়ে তিয়ানানমেন স্কয়ারের দিকে জুনের ৩ ও ৪ তারিখের রাতে সেনাবাহিনী ঢুকেছিল। ছাত্রদের বলেছিল এক ঘন্টার মধ্যে চত্বর ত্যাগ করার জন্য। ছাত্ররাও তাই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু পাঁচ মিনিটের মাথায় আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার বা এপিসি (এক ধরনের সাঁজোয়া যান) হামলা চালায়। ছাত্ররা হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল। তারা এক নিমেষেই মাটিতে লাশ হয়ে লুটিয়ে পড়তে লাগল। দেখতে দেখতে তিয়ানানমেন স্কয়ার মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। লাশগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এগুলোর উপর দিয়ে এপিসি চালিয়ে পিন্ড বানিয়ে ফেলা হয়। এরপর লাশের পিন্ডকে  বুলডোজারের সাহায্যে তুলে নিয়ে গিয়ে পুড়ানো হয়। তারপর দেহাবশেষগুলো নর্দমায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আর হোস পাইপ দিয়ে পানি ছিটিয়ে পরিষ্কার করে ফেলা হয় তিয়ানানমেন স্কয়ার।

ডোনাল্ড আরও জানান, চারজন নারী শিক্ষার্থী আহত অবস্থায় সাহায্য চেয়েছিল। হামলাকারী সেনা সদস্যরা তাদেরকে বেয়নেট চার্জ করে। সেনাবাহিনীর অ্যাম্বুল্যান্সগুলো সাহায্য করতে এসেছিল, তাদের উপরও গুলি চালানো হয়। অ্যালান ডোনাল্ড জানান, কমপক্ষে দশ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল সেদিন। চীন সরকারের এক নির্ভরযোগ্য সূত্রের কাছ থেকে তিনি এসব তথ্য জানতে পেরেছিলেন।

অ্যালান ডোনাল্ড আরও জানান, এই ন্যাক্কারজনক হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছিল ২৭তম আর্মি, যাদের শতকরা ৬০ শতাংশই ছিল অশিক্ষিত এবং আদিম প্রকৃতির। এই নৃশংসতায় খোদ চীনা সেনাবাহিনীও অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়েছিল। এই চরম উত্তেজনার মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অনেকেই ভেবেছিল গৃহযুদ্ধ বোধ হয় আসন্ন।

২৮ বছর পর ব্রিটিশ আর্কাইভ তিয়ানানমেন স্কয়ারের এ বর্বরতার গোপন দলিল প্রকাশ করে। চীন বিষয়ক ফরাসি বিশেষজ্ঞ এবং হংকং ব্যাপ্টিস্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জ্যঁ পিয়েরে ক্যাবেস্টান ব্রিটিশ সরকারের এ তথ্য বিশ্বাসযোগ্য বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, এর আগে মার্কিন সরকার কর্তৃক প্রকাশিত নথিতেও তিয়ানানমেন স্কয়ারে নিহতের একই সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও ঐ আন্দোলনের সময় জ্যঁ পিয়েরে নিজেও বেইজিং এ উপস্থিত ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত এ নথি নিয়ে তিয়ানানমেন স্কয়ারের ঐ ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা জিয়ং ইয়ান বলেছেন, “আমি মনে করি এটা নির্ভরযোগ্য।”

বিশ্ব যাই বলুক না কেন, চীনা কর্তৃপক্ষের দাবি এই ঘটনায় নিহতের সংখ্যা মাত্র দু’শ জন। ঘটনার তিন দশক পরেও দেশটিতে এ বিষয়ে কোন আলোচনা বা সমাবেশ করা একদম নিষিদ্ধ। এমনকি এত ভয়ঙ্কর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কোন পাঠ্যপুস্তকে পর্যন্ত নেই। আর গণমাধ্যমে এ বিষয়ক আলোচনা সমালোচনা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।

লেখক- নিশাত সুলতানা                                                                                       

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *