২৬/১১ মুম্বাই হামলা, ২০০৮1 min read
Reading Time: 5 minutesদিনটা ছিল ২৬ নভেম্বর, ২০০৮। অমৃতা রাইচান্দ,৩২ তম জন্মদিন পালনে গিয়েছিলেন মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে।
অন্য যেকোনো দিনের মতো হতে পারতো সেদিনও। রেস্টুরেন্টে অতিরিক্ত ভিড় ছিল দেখে তারা দোতলার হেরিটেজ স্যুটে যায়। এই সামান্য ব্যপারটি সেদিন জীবন ও মৃত্যর মাঝে পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল তাঁর ও তাঁর পরিবারের। পেগাসাস শিপিং এর এমডি, দিলিপ মেহতা এসেছিলেন এক ডিনারের আমন্ত্রনে। ৯.৪৫ এর সময় তিনি এলিভেটরে নিচে যেতে চাইলে তাঁকে বলা হয় গ্যাংগ্রুপের মাঝে মারামারি চলছে নিচতলায়। কিন্তু পরে তারা জানতে পারে যে আসলে তারা সন্ত্রাসী হামলার মাঝে রয়েছে।
প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি
পাকিস্তানের মুজাফফারবাদে লস্কর-ই-তাইয়্যেবা ২৪(মতান্তরে ২৬) জন কে ট্রেনিং দেওয়া শুরু করে। এর মাঝে ১০জন কে মুম্বাই হামলার জন্য ঠিক করা হয়। বিভিন্ন মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে আমেরিকার ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিদের ধারণা, সাবেক পাকিস্তানি অফিসাররা ও আইএসআই এ প্রশিক্ষণ দিয়েছিল।
যাত্রা শুরু
২৩ নভেম্বরে করাচি থেকে ১০জন নৌকায় রওনা দেয়। ৩৮ ঘণ্টা তারা ভারতীয় নৌবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে যাত্রা করে। এর মাঝে তাদের কাছে ৩০ রাউন্ডের ৬/৭ টি ম্যাগাজিন দেওয়া হয়, এছাড়া আরও ৪০০ রাউন্ড গুলিও দেওয়া হয়, ৮টি হ্যান্ড গ্রেনেড, একে-৪৭, অটোমেটিক রিভল্ভার,কিছু ক্রেডিট কার্ড ও ফল্মুল পৌঁছে দেওয়া হয়। তারা ভারতীয় একটি ট্রলার হাইজ্যাক করে ও এর জেলেদের মেরে ফেলে, ক্যাপ্টেন বাদে। ক্যাপ্টেন তাদের ভারতে নিয়ে প্রবেশ করে। মুম্বাই থেকে ৪ নটিক্যাল মাইল দূরত্বে এসে ক্যাপ্টেনকেও মেরে ফেলে। কোলাবার দুটি স্থানে তারা নামে। প্রথমে বারওয়ার পার্কের কাছে নামে ৮ জন। অন্য ২ জন সমুদ্রে ফিরে যায়, যারা পরবর্তীতে ওবেরয় হাউস ও ট্রাইডেন্ট পার্কে হামলা করে। ৮ জনের দলটিকে কিছু জেলে দেখে সন্দেহ করে এবং স্থানীয় পুলিশের কাছে জানায়,কিন্তু তারা তেমন ভাবে আমলে নেয়না। ৮ জন ৪টি জোড়ায় ভাগ হয়ে নিজ নিজ হামলার স্থানে রওনা দেয় এবং মুম্বাই সাক্ষী হয় ৩টি বিভীষিকাময় দিনের।
শিবাজি টার্মিনাস
রাত ৯.২০ এর দিকে প্রথম হামলা হয় ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসে। ২জন সন্ত্রাসী,ইসমাইল খান ও আজমল কাসাব। প্যাসেঞ্জার হলে প্রবেশ করে এলোপাথাড়ি গুলি করা শুরু করে। ১৫ মিনিটের মাঝে ৫৪ জন মারা যায় ও ১০৪ জন আহত হয়। সৌভাগ্যক্রমে রেলওয়ে ঘোষক বিষ্ণু দত্তরাম যেন্দে সময়মত ঘোষণা দিয়ে হাজার মানুষের জীবন বাঁচান। সিএসটি থেকে বের হয়ে দুই সন্ত্রাসী কামা হাসপাতালে আক্রমন করতে বের হয়। কিন্তু তাদের আগেই হাসপাতালের কর্মচারীরা সব রোগীর ওয়ার্ড বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই এখানে হতাহত হয়নি কেউ। এর মাঝে সন্ত্রাসী দুজনকে অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াডের চিফ হেমন্ত কারকারে জিপে ধাওয়া করে। কিন্তু গোলাগুলিতে মারা যান তিনি ও তাঁর তিন সহকর্মী এবং তাদের জিপ নিয়ে পালায় ইসমাইল ও কাসাব। গিরগাও এলাকায় পুলিশের রোডব্লকের সামনে পড়লে পালটা গোলাগুলিতে ইসমাইল নিহত হয় ও কাসাব আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয়।
নরিমান হাউস
এরপরের আক্রমন হয় ৮/১০ মিনিটের ব্যবধানে,নরিমান হাউসে। ইহুদি লুবাভিচ আউট্রিচ সেন্টারে আক্রমণ করে ও র্যাবাই, তার স্ত্রী ও ৫জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মেরে ফেলে। এছাড়া আরও ৯ জনকে জিম্মি করে রাখে তারা। পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের মাঝে গোলাগুলি চলে কয়েকবার। এরপর ২৭ তারিখে এনএসজি উদ্ধার অভিযানে নামে। প্রথম তলা থেকে ৯জনকে জীবিত উদ্ধার করে তারা। এনএসজি ও পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে দুই সন্ত্রাসীই নিহত হয়। ২৮ তারিখে নরিমান হাউস এনএসজির দখলে আসে।
লিওপল্ড ক্যাফে
অন্যদিকে লিওপল্ড ক্যাফেতে যায় শোয়েব ও আমির নামে দুজন সন্ত্রাসী। তাদের গোলাগুলিতে ১০জন মারা যায় ক্যাফেতে ও আরও অনেকে আহত হয়। সেখানে থেকে বের হয়ে তারা তাজ হোটেলের দিকে রওনা দেয়। পথে বেশ কয়েকটি ট্যাক্সিতে বোমা রেখে যায়। যার কয়েকটি বিস্ফোরিত হয় ৫জন মারা যায় ও ১৫জন আহত হয়।
তাজমহল প্যালেস হোটেল
রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে শোয়েব ও উমর তাজমহল হোটেলের সুইমিং পুলের দিকে যারা ছিল তাদের আক্রমন করে। ধীরে ধীরে তারা রেস্টুরেন্ট ও বারের দিকে আগাতে থাকে। আর হোটেলের সামনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে আব্দুর রহমান ও আবু আলি। তারা এলোপাথাড়ি গুলি ও গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। রাত ১২টার মাঝে পুলিশ হোটেল ঘিরে ফেলে। কিন্তু রাত ১টায় হোটেলের প্রধান গম্বুজে বোমা মারে ও আগুন জলতে দেখা যায়। এছাড়া হোটেলের উপর তলায় বিশালাকারে আগুন ছড়িয়ে যায়।
রাত ৪টার দিকে প্রায় ১০০-১৫০ জনকে উদ্ধার করে পুলিশ। ভোর ৬টার দিকে এনএসজি কমান্ডোরা আসে। তারা হোটেলে প্রবেশ করে সকাল ৮টার দিকে মানুষ জনকে লবি দিয়ে বের করে আনে। চেম্বার্স ক্লাব থেকে আরও ৫০জন উদ্ধার হয়। দুপুর ১২টার দিকেও আরও মানুষ উদ্ধার করে তারা। এরপরেও ভেতরে থাকা সন্ত্রাসীরা ক্রমাগত বোমা বিস্ফোরণ করতে থাকে এবং উদ্ধারকারী বাহিনীর সাথে তাদের গোলাগুলি চলতে থাকে। অবশেষে ২৯ তারিখে শেষ হয় এই ৩ দিনের অবরোধ। ৪ জন সন্ত্রাসীসহ ৩১ জন মারা যায় এখানে।
ওবেরয়-ট্রাইডেন্ট হোটেল
সন্ত্রাসীদের সর্বশেষ স্পট ছিল ওবেরয়-ট্রাইডেন্ট হোটেল। যে সময়ে তাজে আক্রমন করে, ঠিক সেসময়ে এ হোটেলেও আক্রমন করে দুজন সন্ত্রাসী। তারা রেস্টুরেন্ট দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে প্রবেশ করে। রাত ১২টার দিকে হোটেল ঘিরে মুম্বাই র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স অবস্থান নেয়। ২৭ তারিখ ভোর সাড়ে ৬টার দিকে এনএসজি কমান্ডোরা আসে ও উদ্ধার অভিযান শুরু করে।
বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ৩০ জন জিম্মিকে উদ্ধার করা হয়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে আরও ১৪ জন উদ্ধার হয়। এরপরে ৭-৮টার মাঝে কয়েকটি বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া যায় ও আগুন জ্বলতে দেখা যায়। মূলত চতুর্থ তলায় আগুন ছড়াতে দেখা যায়। এর পরের দিন সকাল ১০টায় আরও ৪০ জনকে উদ্ধার করা হয়। অবশেষে দুপুর ৩টায় ওবেরয়-ট্রাইডেন্ট হোটেলকে মুক্ত ঘোষণা করা হয়। হোটেলের ভেতর থেকে ২৪টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। সন্ত্রাসী দুজন অভিযানে নিহত হয়। হোটেল থেকে মোট ১৪৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
এর মধ্য দিয়ে ২৬-২৯ পর্যন্ত মুম্বাই শহরের টানা ৩দিনের ভয়ানক সময়ের সমাপ্তি ঘটে। সন্ত্রাসীদের মাঝে শুধু একজন,আজমল কাসাব ধরা পড়ে। ভারতে তাঁর বিচার করা হয় ও ২০১২ সালে ইয়েরওয়ারা জেলে তাঁর মৃত্যদন্ড কার্যকর করা হয়।
এলইটি যখন এ হামলার পরিকল্পনা করছিল তখন তাদের টেক-চিফ জারার শাহ এর অনলাইন কার্যক্রমের উপর নজরদারি ছিল যথাক্রমে ভারত, ব্রিটেন ও আমেরিকার ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির। কিন্তু তারা কেউই কোন যোগসূত্র তৈরি করতে পারেনি। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তারা তথ্য শেয়ার করে। এসব কিছু জানা যায় এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁসকৃত নথিপত্র থেকে।
শেষ কথা
২০০৮ সালের সে ঘটনার পরের কয়েকবছর অমৃতা রাইচান্দ নিজের জন্মদিন পালন করতে পারেননি। কিন্তু তারপর তিনি আবার নিয়মিত তাজ হোটেলে তাঁর জন্মদিন পালন করতে যাওয়া শুরু করেন। দিলিপ মেহতা ৬-৭ মাস দুঃস্বপ্নের ঘোরে ছিলেন,ঘুমাতে পারতেন না। কিন্তু এখন সামলে উঠেছেন তিনিও।
ধর্মের মুখোশ পরে সন্ত্রাসীরা হাজারো রুপে ফিরে আসে আমাদের জীবনে। কিন্তু তারপরও মানুষ ভয় কাটিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। আর সেখানেই হয় সন্ত্রাসের পরাজয়।
লেখক- আসমাউল হুসনা
আরও পড়ুন- মুম্বাই হামলা ১৯৯৩- যে হামলায় মৃত্যু উপত্যকায় রূপ নিয়েছিল মুম্বাই!
আরও পড়ুন- ফ্লাইট আইসি ৮১৪ হাইজ্যাকিং– এক মাসুদ আজহারের কাছে ভারতের পরাজয়