১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ 1 min read
Reading Time: 5 minutesগালওয়ান ভ্যালিতে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হবার পরে ফিনিক্স পাখির মতো আবার ফিরে আসছে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ। সেবারের যুদ্ধে ভারতকে রীতিমতো নাকানিচুবানি খাইয়েছিল চীন। দুই পক্ষের গণমাধ্যমই ‘৬২ সালের কথা তুলে স্নায়ুচাপ বাড়াতে চাইছে। চীনের গণমাধ্যম ভারতকে শাসাচ্ছে তাদের পুরাতন অসহায়ত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আর ভারতীয় গণমাধ্যমের দাবী, বিগত ৫৮ বছরে তারা অনেক বেশি সংগঠিত। ভয় পাবার কোন কারণই নেই ভারতের।
ঐতিহাসিক তথ্য এটাই যে ওই যুদ্ধে আমেরিকা ভারতকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল। অথবা বলা যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সাহায্যের আবেদনে ইতিবাচক ছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি৷ কিন্তু বেশ কিছু কারণে সেবার কেনেডি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রভাব রাখতে পারেননি। ৬০ কিংবা ৭০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনই অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধের গতি বদলে দিতো। তবে নানা কারণে ভারত সে সুবিধা পায়নি। ‘৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের আদ্যোপান্ত জানার আগে জানা দরকার, কেন ভারতে সেইবার সুবিধা করা হয়নি আমেরিকা এবং প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির।
তিনটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং একাকী যুক্তরাষ্ট্র
সময়টা আবার লক্ষ্য করা যাক। ১৯৬২ সাল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধ তখন একেবারেই তুঙ্গে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ঠিক একইসময় আরো দুই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মুখোমুখি হল যুক্তরাষ্ট্র। একটি কিউবা, অন্যটি চীন। এর মাঝে চীনের মুখোমুখি হওয়াটা ঠিক প্রত্যক্ষ ছিল না। বরং নেহেরুর অনুরোধ রাখতে গেলেই চীনের সামনে পড়তে হতো যুক্তরাষ্ট্রকে। তারপরেও নেহেরুকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন কেনেডি। কিন্তু সেসময় কিউবার দিকে নজর দেয়াই উত্তম ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। প্রথমত যুক্তরাষ্ট্রের দূরের শত্রু সোভিয়েতের মতো একই নীতিতে চলছিল কিউবা। আর স্বাভাবিক নিয়মে দুই সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্রতা ছিল ভালোভাবেই। এরমাঝে আলাদাভাবে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি হয়ে উঠছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকা, কানাডা ও লাতিন আমেরিকা স্টাডি সেন্টারের অধ্যাপক চিন্তামণি মহাপাত্রর কথায়,
“যখন চীন ভারতের ওপরে হামলা করে, সেই সময়ে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কট নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিল আমেরিকা। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়ে দিয়েছিল, যার ফলে পারমানবিক যুদ্ধের একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। গোটা পৃথিবীই সেই সময়ে একটা সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল।”
অধ্যাপক মহাপাত্রের কথায়,
“একটা কমিউনিস্ট দেশ চীন যখন ভারতের ওপরে হামলা করল, সেই একই সময়ে আরেক কমিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার বিরুদ্ধে কিউবাতে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠালো। আমেরিকা ভারতকে সাহায্য করতে পুরো তৈরি ছিল।”
উপরের কথাগুলো বিশ্লেষণ করলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়, কাকতালীয়ভাবে আমেরিকা এমন এক পরিস্থিতি পেয়েছিল যেখানে ৩ টি কমিউনিস্ট দেশের সাথেই যুদ্ধে চলে যাবার শঙ্কা ছিল। আবার চাইলেও সবকটাকে একেবারে বাদ দেয়া সম্ভব ছিল না। অন্তত দূরের শত্রু সোভিয়েত এবং পড়শি দেশ কিউবাকে মোটেই না। সে কারণেই ভারতের সাহায্য আবেদন এবং চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রত্যাখান করা কিছুটা সহজ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে।
প্রভাব বিস্তারকারী পাকিস্তান
এক্ষেত্রে পাশার শেষ দান দিয়েছিল পাকিস্তান। চীন ছিল পাকিস্তানের মিত্র। সেই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও ভালো সম্পর্ক ছিল ভারতের শত্রু এই দেশটির।
যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তান ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে যেন ভারত এবং চীনের মাঝে কোন হস্তক্ষেপ করা না হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত সম্পর্কও তখন অনুকূল ছিল। বরং যুক্তরাষ্ট্র ভয় ছিল চীনের সাথে মিত্রতার সুবাদে পাকিস্তান আবার কাশ্মীর অঞ্চলে হামলা করে কিনা।
সবদিক বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি সাম্যবস্থায় আসে। তারা ভারতকে সাহায্য করা থেকে যেমন বিরত থাকে। তেমনি শান্ত রাখে পাকিস্তানকেও। অধ্যাপক মহাপাত্র যেমনটি বলছিলেন –
“আমেরিকা পাকিস্তানকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে চীন কমিউনিস্ট দেশ, নিজেদের এলাকা বাড়ানোর জন্য চীন তাদের দেশও দখল করে নিতে পারে। এই যুক্তিটা অবশ্য পাকিস্তান মানতে চায় নি। তখনই তারা আমেরিকার কাছে দাবী করে কাশ্মীরের ব্যাপারে আমেরিকা তাদের মদত দিক।”
এবার আসা যাক, যুদ্ধের কারণ এবং ফলাফল ঘিরে।
চীন-ভারত যুদ্ধের নেপথ্যে
মোটা দাগে ‘৬২ এর চীন-ভারত যুদ্ধের কারণ ৩ টি। সে সময় স্বাধীন দেশ হিসেবে চীন এবং ভারত দুটোই বলতে গেলে নবীন ছিল। মানচিত্র বা সীমানা নিয়ে বিরোধ তাই তখন একেবারে অস্বাভাবিক বিষয় ছিল না। ভারত-চীন বিরোধের ৩টি কারণই ছিল সীমানা ভিত্তিক।
তিব্বত সঙ্কট:
১৯৫০ সালের অক্টোবরে চ্যাম্ব্ড সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে চীন জোরপূর্বক তিব্বতকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করে এবং আধিপত্য জোরদার করার লক্ষ্যে ব্যাপক নির্মাণকাজ হাতে নেয়। এ ব্যাপারে ভারত দাপ্তরিকভাবেই প্রতিবাদ করে। তারা চীনকে আহ্বান করে সংকট যেন কূটনৈতিক পর্যায়ে সমাধা হয়। কিন্তু প্রথমেই মাও সে তুং একে অস্বীকার করেন।
এরপরেই দৃশ্যপটে আসেন দালাই লামা। চীনের তিব্বত দখলের প্রায় ১০ বছর পর তিব্বতের সর্বোচ্চ ধর্মীয় এই নেতা একটি অভ্যুত্থান করেন চীনের বিরুদ্ধে। ব্যর্থ এই অভ্যুত্থানের পর তিনি পালিয়ে আসেন ভারতে। চীনকে উস্কে দেয়ার এই সুযোগ হারাতে চায়নি ভারত। দালাই লামাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে বসে তারা। এটিই রীতিমতো ক্রুদ্ধ করে তোলে চীনের সর্বেসর্বা মাও সে তুংকে।
আকসাই চীন:
তিব্বত ও চীনের উত্তর-পশ্চিমের প্রদেশ জিনজিয়াং-এর মাঝে অবস্থিত আকসাই চীন, যা মূলত এক সুউচ্চ মরুভূমি। ১৮৫৬ সালে প্রস্তাবিত জনসন লাইন অনুসারে আকসাই চিন ভারতের জম্মু-কাশ্মীর প্রদেশের অন্তর্গত লাদাখের একটি অংশ হবার কথা। কিন্তু চীন জনসন লাইনকে কখনো স্বীকৃতি দেয়নি, স্বভাবতই আকসাই চিনকেও ভারতের অংশ হিসেবে মেনে নেয়নি। তিব্বত অধিগ্রহনের পর ১৯৫১ সালে চীন তৎকালীন ভারত নিয়ন্ত্রিত আকসাই চিনের মধ্য দিয়ে তিব্বত ও জিনজিয়াংকে সংযোগকারী প্রায় ২০৮৬ কি:মি: দীর্ঘ এলাকায় ‘চায়না ন্যাশনাল হাইওয়ে ২১৯’ নির্মান শুরু করে।
আর এখানেই ভারত দ্বিতীয় একটি ভুল করে বসে। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা এই বিষয়টি একেবারেই নজরে আনেনি। যখন নজরে আসে তখন পেরিয়ে গিয়েছে ৬ বছর। সাল তখন ১৯৫৭৷ এই পর্যায়ে আরো একবার অসহায় হয়ে পড়ে ভারত। চীন যদিও আশ্বস্ত করে তাদের কার্যক্রম ভারতের সীমানায় কোন ক্ষতি করবে না, তবুও ভারতকে তাতিয়ে দিয়ে চীন ভারতের অধিভুক্ত আকসাই দখল করে।
অরুণাচল প্রদেশ:
১৯১৪ সালে সিমলা সম্মেলনে প্রস্তাবিত ম্যাকমাহন লাইন অরুণাচল প্রদেশ তথা নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এরিয়াকে (নেফা) ভারতের অন্তর্ভূক্ত করে। ম্যাকমাহন লাইনকেও অস্বীকৃতি জানানোর ফলস্বরূপ চীন আরুণাচল প্রদেশকে নিজের অংশ হিসেবে মনে করে। ১৯৫৯ সালের আগে খুব একটা জোরালো দাবি না তুললেও দালাই লামার ভারতে আশ্রয় লাভের পর ক্ষুব্ধ চীন তাদের জাতীয় মানচিত্রে আরুণাচল প্রদেশ ও নেফাকে অন্তর্ভূক্ত করে।
মূলত মাত্র ১ দশকের মাঝেই পরপর ৩ টি জায়গায় চীন এক প্রকার কর্তৃত্ব খাটাতে চেয়েছিল। চীনের তিব্বত অধিগ্রহন এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনের কর্মতৎপরতায় ভারত সরকারের টনক নড়ে। তারা কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়, যার ফলস্বরূপ ১৯৫৪ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনা সংগঠিত হয়। আলোচনায় আকসাই চীন ও নেফাকে অন্তর্ভূক্ত করে একটি ভারতীয় মানচিত্র প্রস্তাবিত হয়, যা সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত হয়। কিন্তু সীমান্তে চীনের কথা ও কাজের মিল না থাকায় ভারতীয়দের মনে চীনের অভিসন্ধি নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৫৭ সাল নাগাদ ভারত স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে যে সীমান্ত নিয়ে চীনের সমস্ত কথাই অনেকটা মন ভুলানো। এদিকে চাপ ধরে রাখতে ভারত রাজনীতি শুরু করে দালাই লামাকে আশ্রয় দানের মাধ্যমে।
এক পর্যায়ে ভারত পুরো ব্যাপারটিতে কূটনৈতিক সমাধানে উদ্যত হয়। যার মূল লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে কোণঠাসা হয়ে থাকা চীনের উপর সীমান্ত-সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য চাপ বাড়ানো। আর এজন্য নেহেরু চিঠি দিয়েছিলেন কেনেডিকে। যদিও কেনেডি তখন সোভিয়েতের সাথে কোল্ড ওয়ারে যুক্ত।
অপরদিকে চীন অনেকদিন ধরেই সন্দেহ করছিল তিব্বতে অস্থিতিশীলতার পিছনে ভারতের মদদ আছে। ১৯৫৯ সালে ভারত দালাই লামাকে আশ্রয় দিলে এই সন্দেহ নিশ্চয়তায় পরিণত হয়। একই সালে সীমান্তে চীনকে মোকাবিলার উদ্দেশ্যে ভারত ‘সম্মুখ নীতি’ গ্রহন করে। এই নীতির অংশ হিসাবে ভারত বিতর্কিত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সেনা মোতায়েন এবং বিভিন্ন স্থানে চৌকি নির্মান শুরু করে, যার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছিল ম্যাকমাহন লাইনের উত্তরে অর্থাৎ চীন নিয়ন্ত্রত এলাকায়।
ভারত যখন সবকিছু খুব সহজ সমাধান এবং কূটনৈতিক পর্যায়ে সামলাতে ব্যস্ত তখন চীন ফুঁসে উঠে ক্ষোভে। তিব্বত ইস্যুতে তারা ভারতকে ছাড় দিতে মোটেই রাজি ছিল না। এরমাঝে ভারত সরকার একইসাথে সোভিয়েত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে চীনের উপর চা প্রয়োগে উদ্যত হলে পরিস্থিতি আরো বেশি জটিল হয়ে পড়ে। চীন তখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সরাসরি যুদ্ধের জন্য।
যুদ্ধের পরাজয় এবং ভারতের শিক্ষা
যুদ্ধে ভারত বেশ ভালভাবেই পরাজিত হয়। আকসাই চীন এবং তিব্বতে চীনের কর্তৃত্ব টিকে থাকে। সেই সাথে টিকে থাকে “চায়না ন্যাশনাল হাইওয়ে ২১৯”। কিন্তু এই যুদ্ধ থেকেই পরবর্তীতে ভারত খুব দ্রুত শিক্ষা নেয়। যার ফলাফল পাওয়া যায় ১৯৬৫ সালের ইন্দো-পাক যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে মিত্রবাহিনীর ক্ষেত্রেও।
‘৬২ এর পরাজয় থেকে ভারত দ্রত যে শিক্ষাগুলো নিয়েছিল –
১৷ পরাশক্তি হতে হলে সামরিক শক্তি আবশ্যক। শুধুমাত্র কূটনৈতিক জেরে বৈশ্বিক পরাশক্তি হওয়া যায় না।
২। বৈদেশিক নীতির মাঝে সৈন্যবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করতেই হবে। এর বড় ফল তারা পেয়েছিল পাকিস্তানের সাথে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে। এখন পর্যন্ত ভারত এই নীতিতে সফল।
৩। যুদ্ধ কেবল সৈন্য সংখ্যা আর গোলাবারুদের বিষয় নয়। অবকাঠামোগত উন্নয়ন খুবই দরকার। সৈন্য যদি সঠিক জায়গায় মোতায়েন করা না যায় তবে এটি ভয়াবহ ফল বয়ে আনতে পারে।
৪। সেনাবাহিনীতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আবশ্যক ছিল ভারতের জন্য। এর অভাবেই বড় রকমের বিপদে পড়তে হয়েছিল ভারতকে। বর্তমানে ভারত সৈন্যদের ব্যাপক আকারে প্রযুক্তিগত সুবিধা দিচ্ছে। যা তাদের সামরিক ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন করেছে।
৫। মিত্রতার অভাব। মার্কিন সাহায্য পুরোপুরি পাওয়া গেলে হয়ত ভারত বড় কিছু করতে পারতো। কিন্তু মার্কিন সাহায্য না পাওয়ার কারণেই তাদের পিছিয়ে পড়তে হয়। পরবর্তী সময়ে ভারত যা বেশ ভালভাবেই কাটিয়ে উঠেছিল।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ