বাংলার বাঘ শেরে বাংলা একে ফজলুল হক 1 min read
Reading Time: 7 minutesবাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তালিকা করলে যে ক’জনের নাম সবার শুরুতে আসবে তাদের মধ্যে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক অন্যতম। অসীম সাহসিকতার জন্য তিনি “বাংলার বাঘ” বা “শেরে বাংলা” উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর পুরো নাম আবুল কাশেম ফজলুল হক।
১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পৈত্রিক নিবাস পটুয়াখালী জেলার বাউফলে। তিনি ছিলেন কাজী মুহাম্মদ ওয়াজেদ এবং সাইদুন্নেসা খাতুনের একমাত্র পুত্র সন্তান। পিতা কাজী মুহাম্মদ ওয়াজেদ ছিলেন একজন প্রখ্যাত আইনিজীবী।
কৈশোর এবং পড়াশোনা
শেরে বাংলা একে ফজলুল হক তাঁর শৈশবের বেশীর ভাগ সময় তাঁর মামা বাড়িতেই কাটিয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় এই বাড়িতেই। বাড়িতে গৃহশিক্ষক রেখেই তাঁকে আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা দিয়েছিলেন তাঁর পিতা। পরবর্তীতে কিছু দিনের জন্য গ্রাম্য পাঠশালাতেও তাকে ভর্তি করা হয়েছিলো। ১৮৮১ সালে ফজলুল হককে বরিশাল জেলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। বরিশাল জেলা স্কুল থেকেই তিনি ১৮৮৬ সালে অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৮৯ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় (বর্তমান মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট) তিনি তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। প্রখর মেধাশক্তির জন্য তিনি শিক্ষদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন।
প্রবেশিকা পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয়। তিনি ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ বিভাগে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি প্রেসেডেন্সি কলেজেই একই সাথে গণিত, পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নশাস্ত্র নিয়ে বি.এ-তে ভর্তি হন। সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। নিজের মেধা এবং সাহসিকতার দরুণ তিনি তখন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ঘনিষ্টতা লাভ করেন। ১৮৯৩ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তিনটি বিষয়েই ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বি.এ পাশ করেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি ভাষা বিষয়ে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু এম.এ ফাইনাল পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস আগে তাঁর এক বন্ধু তাঁকে ব্যাঙ্গ করে বলেছিলো, মুসলিম ছাত্ররা খুব একটা মেধাবী হয়না বিধায় তারা গণিত নিয়ে পড়েনা। এই কথা শুনে ফজলুল হকের মনে প্রচন্ড জিদ চেপে যায়। ঐদিনই তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি গণিত শাস্ত্রেই এমএ পরীক্ষা দেবেন। মাত্র ছয় মাসের প্রস্তুতি নিয়েই তিনি পরীক্ষায় বসেন এবং প্রথম শ্রেণী লাভ করেন।
কর্মজীবন
বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিএ এবং এমএ সম্পন্ন করলেও পিতৃ পেশা আইন ব্যবসার প্রতি তাঁর ঝোক ছিলো। আর তাই তিনি ১৮৯৭ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এল. পাশ করে স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষনবিশ হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। ১৯০১ সালে ফজলুল হকের পিতা মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি বরিশাল ফেরত আসেন এবং বরিশাল আদালতে যোগদান করেন। ১৯০৩-০৪ সালে বরিশাল বার এসোসিয়েশনের নির্বাচনে তিনি সহকারী সম্পাদক পদে নির্বাচন করেন এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। বেশ কয়েক বছর আইন ব্যবসা করার পর তিনি সরকারি চাকুরি করবেন বলে মনস্থির করেন। তাঁর মেধার কদর স্বয়ং ভারতীয় ব্রিটিশ সরকার পর্যন্ত করতো। আর তাইতো পূর্ব- বাংলার তৎকালীন গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার নিজে তাঁকে ডেকে নিয়ে সম্মানের সহিত ডেপুটি মেজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ দেন। এরপর তিনি বেশ কিছুদিন ঢাকা এবং ময়মনসিংহে কর্মরত ছিলেন। এর পর তাঁকে জামালপুরের এসডিও হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
জামালপুরে কর্তব্যরত অবস্থায় বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়। ফজলুল হকের একান্ত প্রচেষ্টায় সেবার দাঙ্গা বন্ধ হয়। সরকারি চাকরির সুবাধে তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে সাধারণ মানুষের উপর মহাজন ও জমিদারদের নির্মম অত্যাচার নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেন। এসব ব্যাপার নিয়ে সরকারের সাথে ফজলুল হকের বিরোধ বাঁধে। সরকারের সাথে বনিবনা না হওয়ায় তিনি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর ১৯১১ সালে পুনরায় কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি যেদিন কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন সেদিন খাজা সলিমুল্লাহর সভাপতিত্বে এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়।
রাজনৈতিক জীবন
কলকাতায় আইন বিষয়ে পড়াশুনা করার সময় থেকেই রাজনীতিটাও ভালো করে রপ্ত করেছলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। রাজনীতিতে তাঁর যখন হাতে খড়ি হয় কলকাতা ছিলো বঙ্গীয় রাজনীতি তথা সর্ব ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। ফলে ভারতবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে শেরে বাংলার সখ্যতা হতে সময় লাগেনি। আর তাঁর সাহস, বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শীতার জন্য তিনি খুব দ্রুতই সবার নজর কারতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বাংলা জনপদে বিভক্তির রেখা দেয়। হিন্দু মুসলিম আলাদা হয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠে। ঠিক সেই সময়টাতেই নবাব স্যার সলিমুল্লাহ উপলব্ধি করেন যে মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষার জন্যও একটি সংগঠন খুব দরকার। আর এই চিন্তা থেকেই ১৯০৬ সালের শেষের দিকে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্সের আয়োজন করেন। ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত এই কনফারেন্সেই মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষায় একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ নিজে এবং যুগ্ম সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয় শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও নবাব ভিকারুল মুলককে। ঐদিনই নবাব সলিমুল্লাহ নিখিল ভারত মুসলিমলীগ গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবটি সর্ব সম্মমতিক্রমে গৃহীত হয় এবং মুসলিমলীগের সুত্রপাত ঘটে।
চাকরী এবং আইন ব্যবসার জন্য শুরুর দিকে মুসলিম লীগের সাথে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না। শেষে ১৯১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু তখন মুসলিমলীগের সাংগঠিক নানা বিষয় নিয়ে দলের নেতৃস্থানীয়দের সাথে তাঁর বিরোধ বাধে। এই বিরোধ নিষ্পত্তি হলে তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন।
১৯১৪ সালে ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ মাঠে মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। একই বছর তিনি নিখিল ভারত কংগ্রেস দলেও যোগদান করেন। তাঁর যোগ্যতা এবং বিচক্ষণতার জন্য তিনি একই সাথে মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের অন্যতম ক্ষমতাধর এবং শীর্ষস্থানীয় নেতা হয়ে উঠেন।
১৯১৮ সালে দিল্লীতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, একমাত্র বাঙালী হিসেবে তিনিই নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কোন অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছেন।
এই দিকে কংগ্রেসের রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। ফলশ্রুতিতে ১৯১৮ সালে তাঁকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত করা হয়। সেই সাথে ১৯১৯ সালে সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে নিখিল ভারত মুসলিমলীগের প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত করা হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর খেলাফত আন্দোলনের সুত্রপাত হলে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সক্রিয় ভাবে খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন।খেলাফত আন্দোলনের সময় তিনি নিখিল ভারত খেলাফত কমিটির গুরত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বও পালন করেছেন।
১৯২২ সালে মহাত্মাগান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে উপনির্বাচনের আয়োজন করে ব্রিটিশ সরকার। শেরে বাংলা খুলনা উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন।
১৯২৩ সালে মতিলাল নেহেরু এবং চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্ত্বে গঠিত স্বরাজ্য দল আইন সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিলো। এই দলটির অন্যতম লক্ষ্য ছিলো আইন সভায় নির্বাচিত হয়ে সরকারি নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান করা। স্বরাজ্য দলের প্রতি শেরে বাংলার পূর্ণ সমর্থন ছিলো। দুই বছর পর ১৯২৪ সালে খুলনা অঞ্চল থেকেই তিনি আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর বাংলার তৎকালীন গভর্নর লিটন তাঁকে বাংলা প্রদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু ১৯২৪ সালের বাজেটের প্রতি স্বরাজ্য পার্টি অনাস্থা জ্ঞাপন করলে ১ আগস্ট শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক মন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেন।
মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর থেকে শেরে বাংলা সম্পূর্ণরুপে কৃষক রাজনীতিতে জড়িয়ে পরেন। ১৯২৯ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদের ২৫ জন মুসলিম সদস্যকে নিয়ে কলকাতায় মিলিত হয়েছিলেন তিনি। সেদিন নিখিল বঙ্গপ্রজা সমিতি নামে একটি দল গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। বাংলার কৃষক প্রজাদের স্বার্থ রক্ষাই ছিলো এই সমিতির মূল লক্ষ্য। ১৯৩৫ সালে ময়মনসিংহে নিখিল বঙ্গপ্রজা সমিতির এক বিশাল সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়েই শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নতুন দল কৃষক-প্রজা পার্টির সুত্রপাত ঘটে।
১৯৩৫ সালে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচন আয়োজন করে। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক কৃষক প্রজাপার্টির পক্ষে তাঁর নির্বাচনী এলাকা পটুয়াখালী থেকে নির্বাচনে অংশ নেন। একই আসনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন পটুয়াখালীর তৎকালীন জমিদার এবং ঢাকা নবাব পরিবারের সদস্য খাজা নাজিমুদ্দিন। খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রতীক ছিলো হারিকেন এবং শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের প্রতীক ছিলো লাঙ্গল। কৃষক-প্রজাপার্টির স্লোগানে (লাঙল যার জমি তার, ঘাম যার দাম তার) উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণ শেরে বাংলাকেই ঐ আসন থেকে নির্বাচিত করে। নির্বাচনের পর ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল তাঁর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রীপরিষদ বাংলার তৎকালীন গভর্নর এন্ডারসনের কাছে শপথ গ্রহণ করে। ঐদিনই বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক।
অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শেরে বাংলা একে ফজলুল হক নানামুখী কর্মসূচী হাতে নিয়েছিলেন। তিনিই সর্ব প্রথম বিনা বৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন করেছিলেন। এছাড়াও তিনি বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই পদক্ষেপের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে ক্লাউড কমিশন গঠন করে। ক্লাউড কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৩৮ সালের ১৮ আগস্ট “বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব” আইন পাসের মাধ্যমে চিরতরে জমিদারি প্রথা বন্ধ করে দেওয়া হয়। মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৩৯ সালে আইন সভায় তাঁর নেতৃত্বে “বঙ্গীয় চাকুরি নিয়োগ বিধি” প্রবর্তিত হয়।এই বিধিতে মুসলিমদের জন্য ৫০ ভাগ চাকরি নির্দিষ্ট রাখার ব্যবস্থার কথা উল্লেখ ছিলো। এছাড়াও বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি যে সব উল্লেখযোগ্যা কাজ করেছেন-
- চাষী খাতক আইনের সংশোধনী এনে ঋণ সালিশী বোর্ডকে শক্তিশালী করা
- ১৯৪০ সালে মহাজনি আইন পাশ
- দোকান কর্মচারী আইন প্রণয়ন করে দোকান শ্রমিকদের সপ্তাহে একদিন ছুটির ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদানের নির্দেশ জারি
- কৃষি খাতে উন্নয়নের জন্য ঢাকা, রাজশাহী এবং খুলনায় কৃষি ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা
- পাটের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে ১৯৩৮ সালে “পাট অধ্যাদেশ” জারি।
উল্লেখ্য যে, ১৯৪১ সালের ১২ ডিসেম্বর শেরে বাংলা একে ফজলুল হক পুনরায় মন্ত্রীসভা গঠন করেন।
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে লাহোরে মুসলিম লীগের এক বিশাল অধিবেশনের আয়োজন করা হয়। ঐ অধিবেশনে মুসলিমলীগের পক্ষে লাহোর প্রস্তাবের প্রারম্ভিক খসড়া তৈরি করেন পাঞ্জাবের মুখ্য মন্ত্রী সিকান্দার হায়াত খান এবং এই প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মূল বিষয় ছিলো, ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসকারী মুসলিম নাগরিকদের জন্য পৃথক ভুখন্ডের দাবী। এই লাহোর প্রস্তাব-ই পরবর্তীতে “পাকিস্তান প্রস্তাব” হিসেবে আখ্যায়িত হয়।
টানা দুইবার বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান। বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে বরিশাল অঞ্চল ও খুলনার বাগেরহাট আসন থেকে নির্বাচিত হন। কিন্তু দলীয়ভাবে তাঁর পার্টি পরাজিত হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভা গঠন করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই নির্বাচনে দলের ভরাডুবির পর নেতাকর্মীদের চাপে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক আবার মুসলিম লীগে যোগদান করেন। কিন্তু পার্টিতে তাঁর ভূমিকা ছিলো নীরব।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ঢাকা হাইকোর্টে পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেছিলেন।উল্লেখ্য যে, তিনি ঢাকা হাইকোর্ট বার কাউন্সিলের প্রথম নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন।
১৯৫১ সালে তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের এটর্নি জেনারেল পদে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।পূর্ব পাকিস্তানের এটর্নি জেনারেল থাকাকালীন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন।
১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ ৩০০ আসনের মাত্র ৯ টিতে জয়লাভ করে। বিপুল ভোটে জয়লাভ করে যুক্তফ্রন্ট শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠন করে এবং তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। কিন্তু পাকিস্তানিদের ছলাকলার কাছে এইমন্ত্রীসভা বেশি দিন টিকেনি।
এরপর পাকিস্তানের রাজনীতিতে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। এসব বিষয় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মোটেও পছন্দ ছিলো না। তাই রাজনীতি থেকে নির্বাসনে যেতে চেয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু রাজনীতি তাঁকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছিলো। হক মন্ত্রী সভা পতনের পর ১৯৫৫ সালে তাঁকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ নেওয়ার জন্য আহবান জানানো হয়েছিলো। কিন্তু তিনি সেই আহবান নাকচ করে দেন। এরপর ১৯৫৬ সালে তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করা হয়। কিন্তু সেই পদটিও বেশি দিন টিকেনি। বার্ধক্য এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে শেরে বাংলা রাজনীতি থেকে নিজেকে অনেকটা সরিয়ে নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৫৮সালের অভ্যুত্থানের সময় তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়েছিলো।
অবসর এবং মৃত্যু
১৯৫৮ সালের অভ্যুত্থানের পর রাজনীতি থেকে নিজেকে বলতে গেলে একদম গুটিয়ে নিয়েছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। এবছরই তাঁকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক “হেলাল-ই-পাকিস্তান”-এ ভূষিত করা হয়। ১৯৬১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করে এবং হলের আজীবন সদস্যপদ প্রদান করে। এই সংবর্ধনা সভাই ছিলো শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সর্বশেষ জনসভা। এরপর তিনি আর কোন জনসভায় যোগ দেননি।
শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ১৯৬২ সালের ২৭ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রায় একমাস সেখানে চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বাংলার এই বাঘ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সমাহিত করা হয় তাঁকে। তাঁর মৃত্যুর দিন রেডিও পাকিস্তান সেদিনের সব অনুষ্ঠান বাতিল করে সারাদিন কোরআন পাঠ সম্প্রচার করে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে তাঁর প্রতি সম্মান দেখানো হয়।