ভারতে ‘ডাইনি’ নিধনের আড়ালে চলছে নারী হত্যা1 min read
Reading Time: 5 minutes
ভারতের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ডাইনি নিধনের নামে অবাধে পিটিয়ে বা কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে নানা বয়সী নারীদের। অঞ্চলগুলোর মধ্যে বিহার, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, উড়িষ্যা, আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর ও উত্তরে জলপাইগুড়ি, মালদা, দিনাজপুর সন্নিহিত এলাকায় বিশেষত চা বাগান অঞ্চলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায়ই ঘটে থাকে ডাইনি সন্দেহে অত্যাচার অপমান ও নিগ্রহের ঘটনা।
ভারতের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ডাইনি সন্দেহে হত্যার ঘটনা ঘটেছে আড়াই হাজার। এটা শুধু খুনের হিসাব। আর কতজন যে এ অপবাদের শিকার হয়েছেন তার কোন হিসেব নেই। বিবিসির সূত্রমতে বিগত কয়েক বছরে প্রায় তিন হাজার নারীকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। দিনে দিনে এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এ ধরনের কুসংস্কার নির্মূল করার যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারছে না। ২০১৬-১৭ সালে কেবল উড়িষ্যাতেই ৯৯টি এবং রাজস্থানে ১২৭টি ডাইনি নিধনের অভিযোগ দাখিল হয়েছে পুলিশের খাতায়। কেন হচ্ছে এসব হত্যাকান্ড? আর নারীদেরকেই শুধুমাত্র কেন টার্গেট করা হচ্ছে? আসব সেসব কথায়, তার আগে দেখে নিই ডাইনি কী, ঠিক কোন কোন বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে ডাইনি বলা যায়। পাশাপাশি আমরা এখান থেকে ডাইনি শিকারের ইতিহাস ও ভূগোলটাও জানব।
ডাইনি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা আমাদের সবারই আছে। কোন ব্যক্তি (সাধারণত নারী), যাকে তার নিজের আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীরা ‘অশুভ শক্তির’ অধিকারী বলে বিশ্বাস করে, এবং সন্দেহ করে যে সে তার ‘অলৌকিক ক্ষমতার’ সাহায্যে মানুষের ক্ষতি করছে। ডাইনি দেখতে কেমন বা তাদের চরিত্রের বিশ্লেষণ বিভিন্ন সমাজে বিভিন্নরকম। যেমন বলা যেতে পারে, ভারতের সাঁওতাল সমাজে ডাইনিকে একভাবে দেখা হয়। আবার আমেরিকার নাভাজো বা দক্ষিণ আফ্রিকার বান্টু সমাজে ডাইনি সংক্রান্ত রীতিনীতির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।
ডাইনি-তন্ত্র-মন্ত্র-তুকতাক এসব জিনিসে বিশ্বাস ও তার চর্চা অতি প্রাচীন এবং বিশ্বব্যাপী। এশিয়া আফ্রিকা ইউরোপ সব ইতিহাসেরই প্রাচীন গ্রন্থে ডাইনি আর তুকতাকের প্রসঙ্গ আছে। ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্র, যেটা ‘বেদ’ এর অন্যতম অঙ্গ সেটাও অলৌকিক তন্ত্র মন্ত্রে ভরপুর। মনিয়ের উইলিয়ামসের বিখ্যাত সংস্কৃত অভিধান অনুযায়ী, ‘ডাকিনী’দের (‘ডাকিনী’ শব্দ থেকে ‘ডাইনি’ শব্দের উৎপত্তি) কথা পাওয়া যায় ভাগবতপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ, মার্কন্ডেয়পুরাণ ও কথাসরিৎসাগর নামক গ্রন্থে। তারা ছিল দেবী কালীর অনুচরী ও মাংসভুক। ব্যবিলন সভ্যতার বিখ্যাত হাম্মুরাব্বির অনুশাসনে ডাইনিবিদ্যার কথা পাওয়া যায়। এছাড়াও প্রাচীন মিশরীয়, গ্রীক ও রোমান সভ্যতাতেও ডাইনিবৃত্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। রোম সাম্রাজ্যে গণহারে ডাইনি পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো আধুনিক যুগের গোড়ার দিকে ইউরোপের ইতিহাসে ঘটেছিল কুখ্যাত ও ভয়ংকর ডাইনি পোড়ানোর ঘটনা। তখন প্রায় চল্লিশ থেকে ষাট হাজার মানুষকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।
১৪৮৭ সালে দুই জার্মান পাদ্রী ‘মালিয়ুস মালফিকারুম’ বা ‘ডাইনিদের শায়েস্তা করার হাতুড়ি’ নামের একটি বই লেখেন। ডাইনির লক্ষণ চেনার উপায় থেকে শুরু করে কিভাবে তার উপর অত্যাচার চালাতে হবে সে সবকিছুর নৃশংস বর্ণনা ছিল বইটিতে। এ বইটি পরবর্তী কয়েকশ বছর পর্যন্ত ডাইনি নিধনের গাইডলাইন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত রমরমিয়ে চলেছিল কুৎসিত কুসংস্কার-প্রণোদিত এসব ভয়ংকর কাণ্ড।
বর্তমানে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে এ ধরণের বিশ্বাস ও চর্চা আজ আর নেই। তবে এশিয়া ও আফ্রিকার নানা দেশে এখনও ডাকিনীবিদ্যার প্রবল দাপট রয়েছে। ভারতের পাশের দেশ নেপালেও ডাইনিবিদ্যার চর্চা করা হয়। প্রতি বছরই ডাইনি অপবাদে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে আফ্রিকার ক্যামেরুন, ঘানা, জম্বিয়া, সিয়েরা লিয়ন, কেনিয়া, তানজানিয়া পভৃতি দেশে। ২০০৯ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে উল্লেখ করা হয়, কেবল গাম্বিয়াতেই প্রায় হাজারখানেক নারীকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বর্তমানে মোটামুটি সবদেশেই ডাইনি শিকার নিষিদ্ধ। একমাত্র দুটি দেশে আজও সরকারি আইনবলে ডাইনি শিকার করা হয়— সৌদি আরব ও ক্যামেরুন। ভারতেও এর বিরুদ্ধে কড়া আইন চালু থাকলেও এটাকে এখনও কেন্দ্রীয়ভাবে পাস করা হয় নি।
ভারতের আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অঞ্চলে নারী হত্যার এই নেক্কারজনক ঘটনাটি বেশি ঘটছে। ২০১৫ সালে ঝাড়খন্ডে পাঁচজন ঘুমন্ত নারীর উপর চালানো হয়েছিল ডাইনি হত্যার নামে এক পাশবিক নির্যাতন। একদল মানুষরূপী হায়েনা তাদেরকে চুলের মুঠি ধরে বিছানা থেকে টেনে এনে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে খুন করে। গ্রামবাসীকে উসকে দিয়েছিল সেই গ্রামেরই একজন ওঝা। গ্রামের একটি ছেলে জন্ডিসে মারা গেলে ওঝা একই পরিবারের ওই পাঁচজন মহিলাকে দেখিয়ে বলে যে, ওরাই নাকি ছেলেটিকে খেয়েছে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য উড়িষ্যায় এক গৃহবধূকে তথাকথিত ডাইনি চিহ্নিত করে তাকে তার সন্তানসহ কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গ্রামের বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তারা কবিরাজের দ্বারস্ত হয়েছিল। কবিরাজ ওই মহিলাকে দেখিয়ে বলে যে, ওর কুদৃষ্টি পড়েছে গ্রামের বাচ্চাদের উপর। তাই যত দ্রুত সম্ভব একে মেরে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কেউ বাচ্চাদের সঠিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল না। একই ঘটনা আসামেও ঘটে। সেখানে পূর্ণি ওরাও নামের ৬৩ বছরের এক বৃদ্ধাকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে তাকে ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বেরে করে নগ্ন করা হয় এবং শেষে শিরঃছেদ করে খুন করা হয়। এত অমানবিক অপরাধ করার পরও কেউ হত্যাকারীদেরকে কিছুই বলল না। বরং এ ঘটানার অভিযোগে পুলিশ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করলে, গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির দাবিতে একদল গ্রামবাসী বিক্ষোভ করে।
গ্রামের অনেকেই এসবের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে গিয়েও গাঁয়ের মোড়লদের ভয়ে খুলতে পারে না। কারণ এর ফলে তাদেরকে প্রতিহিংসার শিকার হতে হয় এবং একঘরে হয়ে থাকতে হয়। অনেকসময় পুলিশ খবর পেয়েও কাজ না করার অভিযোগ রয়েছে। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ এর দক্ষিণ এশিয়ার একজন কর্মকর্তা মনে করেন যে এর জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী পুলিশ। তার কথা হচ্ছে, পুলিশ থাকতে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সাহস হয় কি করে? কেন পুলিশ কড়া ব্যবস্থা নেয় না? আসলে ডাইনি চিহ্নিত করে গ্রামের ওঝা বা গুণিনেরা। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস গ্রাম প্রধানেরও নেই। গ্রামের সমস্ত মানুষ এদের কাছে যায় চিকিৎসার জন্য।
সেই প্রাচীনকাল থেকেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদেরকে অবমূল্যায়ন করা হয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী ইন্দিরা জয় সিং এক সাক্ষাৎকারে বলেন, কুসংস্কার অন্যতম কারণ হলেও অপরাধটা মূলত হয় ব্যক্তিগত শত্রুতা, জমি বিবাদ বা জাতপাত ও লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে। তাই এর শিকার হন নারীরা। অসহায়, বিধবা, সন্তানহীন ও অবিবাহিত বয়স্ক মহিলারাই এর শিকার হন বেশি।
ভারতীয় সব শ্রেণীর মানুষের অভিমত, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষ করে আদিবাসী সমাজে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে নি। শুধুমাত্র কুসংস্কারকে ডাইনিপ্রথার পিছনে দায়ী করলে চলবে না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, প্রশাসনের উপেক্ষা প্রভৃতির মিলিত ফল হলো এ ডাইনি অপবাদ। এ সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় হলো সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, তৃণমূল পর্যায় থেকে আইন প্রণয়ন, প্রচার অভিযান বাড়ানো এবং শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
তবে আশার কথা হলো, আসাম সরকার সম্প্রতি ডাইনি হত্যা রুখতে কঠোর আইন পাস করেছে। তাতে বলা হয়েছে, কাউকে ডাইনি অপবাদ দিলে অভিযুক্তকে তিন থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং পঞ্চাশ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। আর যদি কাউকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে খুন করা হয় তাহলে অপরাধীকে ভারতীয় দন্ডবিধির ৩০২ ধারা মোতাবেক বিচারের আওতাধীন আনা হবে। তদন্তকারীদের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এক সমাজকর্মী কাজ করছেন ডাইনিপ্রথার বিরুদ্ধে। তিনি ঝাড়খণ্ডের একজন উপজাতি তরুণী। তিনি ছোটবেলায় নিজের চোখে দেখেছেন তার দাদিকে কিভাবে ডাইনি অপবাদ দিয়ে গর থেকে টেনে বের করে নগ্ন করে বিষ্ঠা খাইয়ে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল। সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই তিনি নিজ উদ্যোগে ঝাড়খণ্ডের গ্রামে গ্রামে গিয়ে ডাইনিপ্রথার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করছেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানাচ্ছেন। গ্রামবাসীদের তিনি বোঝাতে চাইছেন কিছু অসাধু ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এসব কুসংস্কার ছড়াচ্ছে। আদিবাসী সমাজে জমিজমা, বিষয়সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান অধিকার নেই বলে সেই সুযোগে তাদেরকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে খুন করে সমস্ত সম্পত্তি ভোগ করার পায়তারা করছে এক শ্রেণীর পাষন্ড পুরুষ।
ওই আদিবাসী তরুণী তাই ডাইনি প্রতিরোধক আইনটি তার সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে প্রচার করছেন এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার আন্দোলন শুরু করেছেন। এছাড়াও আসামের বিরুবালা রাভা। তিনি দীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ ডাইনি নিধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তার নিরলস পরিশ্রম আর অসীম সাহসের ফলে আসামে ডাইনি নিধনের বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতের মধ্যে কঠোরতম আইন পাস হয়েছে।
প্রখ্যাত লেখক স্যানাল এদামারুক এবং নিকিতা সোনাভেন ডাইনিপ্রথার বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে গ্রামবাসীদেরকে সচেতন করছেন। গ্রামের মানুষকে বুঝিয়েছেন যে, রোগব্যাধি হয় জীবাণুর বিস্তারের কারণে, আবহাওয়া খারাপ হয় প্রাকৃতিক কোন নিয়ামকের কারণে, কোন ডাইনির জাদুতে নয়। সোনাভেন, বিরুবালা বা এদামারুকদের মতো আরও অনেকেই এগিয়ে আসছেন ডাইনি নিধনের নামে হত্যাযজ্ঞ চালনাকারীদের প্রতিহত করার জন্য। সরকারকেও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব অপরাধের সুষ্ঠু ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিবিধান করতে হবে। তবেই আজকের আধুনিক সভ্যতার যুগে আদিম এ পাশবিকতা নির্মূল হবে।