বিশ্ব

“আয়রন ম্যান অব ইন্ডিয়া”- সরদার বল্লভভাই প্যাটেল 1 min read

জুলাই ৩০, ২০২০ 4 min read

author:

“আয়রন ম্যান অব ইন্ডিয়া”- সরদার বল্লভভাই প্যাটেল 1 min read

Reading Time: 4 minutes

২০১৮ সালে ২,৯৮৯ কোটি রুপি ব্যয়ে ভারতের গুজরাটের নর্মদা জেলায় নির্মাণ করা হয়ে বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ মূর্তি, যা স্ট্যাচু অফ লিবার্টির প্রায় দ্বিগুণ। ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’ বা ‘ঐক্যের মূর্তি’ হিসেবে পরিচিত এই মূর্তিটি আর কারো নয়, আয়রন ম্যান অব ইন্ডিয়া নামে খ্যাত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের। নানা রাজ্যে বিভক্ত ভারতকে এক করাতে বল্লভভাই প্যাটেলের অবদান অসামান্য। তাকে সন্মান জানাতে ভারত তার জন্মদিন “রাষ্ট্রীয় একতা দিবস” হিসেবে পালন করে।

ভারতের প্রথম এই উপ-প্রধানমন্ত্রী ১৮৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর গুজরাটের প্রভাবশালী পতিদার সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেন। স্ত্রীকে হারানোর দুই বছর পর ১৯১১ সালে ৩৬ বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ডের মিডল টেম্পলে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করতে যান। ৩৬ মাসের কোর্স ৩০ মাসে শেষ করে তিনি ভারতে ফিরে এসে আহমেদাবাদে থিতু হন এবং ব্যরিস্টার হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেন। স্ত্রী জাভেরি, কন্যা মানিবেন এবং পুত্র দয়াভাইকে নিয়ে ছিলো তার সংসার। পাঁচ বছরের কন্যা ও তিন বছরের পুত্রকে রেখে তার স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন৷

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকা

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুর দিকে বল্লভভাই না রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলেন, না গান্ধীর মতবাদের অনুসারী ছিলেন। ১৯১৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর সাথে এক সভায় দেখা হওয়াটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি গান্ধীর জীবন দর্শনে ব্যাপক প্রভাবিত হন এবং গান্ধীর ডাকে অনেক সাধনায় অর্জিত চাকরি ছেড়ে দেশ স্বাধীন করার আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯১৭ সালে তাকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গুজরাট শাখার সেক্রেটারি হিসাবে নিযুক্ত করা হয়।

বল্লভভাই গান্ধীর ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে (১৯২০) যোগ দিয়ে পশ্চিম ভারত ভ্রমণ করে দলের পক্ষে প্রায় ৩ লাখ সদস্য যোগাড় করেন। তিনি এই সময় প্রায় ১৫ লাখ টাকাও পার্টির ফান্ডে সংগ্রহ করেন। ১৯২৩ সালে যখন গান্ধী জেলে বন্দী ছিলেন, তখন বল্লভভাই সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

সরদার বল্লভভাই প্যাটেল

কৃষকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকা ছিলো অনস্বীকার্য। তৎকালীন সময়ে কৃষকদের “কর দেবো না ” আন্দোলনের ফলে বৃটিশ সরকার বাধ্য হয়েছিল ভারতীয় কৃষকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জমি ফেরত দিতে। আর এই আন্দোলনের মূল হোতা ছিলেন বল্লভভাই প্যাটেল। এই আন্দোলনের পর কৃষকদের দেওয়া খেতাবে বল্লভভাই প্যাটেল হয়ে উঠেন “সরদার প্যাটেল”।  এর মাধ্যমে পুরো ভারত ব্যাপী তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পরে।

“লবণ-সত্যাগ্রহ” নামক এক আন্দোলনে যোগদানের অপরাধে সরদার প্যাটেলকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। ১৯৩১ সালে লর্ড আরউইন এবং মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। চুক্তিটি “গান্ধী-আরউইন” চুক্তি হিসাবে পরিচিত।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শুরু হলে অনেকে গান্ধীজীর সমর্থন ত্যাগ করলেও প্যাটেল তার একনিষ্ঠ অনুসারী থেকে যান। তবে সরদার প্যাটেলের কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের সাথে খুব একটা মিত্রতা ছিলোনা৷ জওহরলাল নেহেরুর উপর প্রকাশ্যে তার বিরক্তি প্রকাশ করার কারণে বল্লভভাই প্যাটেল বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন৷ এমনকি তার ভাষায় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র ছিলেন “ক্ষমতালোভী”।

১৯৪২ সালে অনেক বাঘা বাঘা নেতারা গান্ধীর ভারত ছাড় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অসহযোগ আন্দোলনের যৌক্তিকতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামে এক ধরনের মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। সরদার প্যাটেলের একনিষ্ঠ সমর্থনের কারণে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি বাধ্য হয় মহাত্মা গান্ধীকে ভারত ছাড় আন্দোলনে সমর্থন দিতে। সেই বছর তাকে আবার গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয় এবং ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের সাথে তাকে আহমেদনগর দুর্গে বন্দী থাকতে হয়৷

সরদার প্যাটেল ও দেশভাগ

ব্রিটিশদের কাছে থেকে স্বাধীনতা লাভের পর বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন প্রথম কংগ্রেস নেতা যিনি দেশভাগ মেনে নিয়েছিলেন। কারণ, তার মনে হয়েছিলো মোহম্মদ আলী জিন্না স্বাধীনতার ঠিক আগ মুহুর্তে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সূত্রপাত করে যে বিচ্ছিনতাবাদী আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলো তা নিরসনের একমাত্র উপায় হতে পারে দেশ ভাগ মেনে নেওয়া। পার্টিশন কাউন্সিলে ভারতের হয়ে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের তিন স্তম্ভ গান্ধী, নেহেরু ও বল্লভভাই

গান্ধী, নেহেরু ও বল্লভভাইয়ের সম্পর্ক

বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন গান্ধীর অত্যন্ত আজ্ঞাবাহী সহচর। গান্ধীর কোন আদেশের অবাধ্য তিনি হতেন না। এমনকি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগও তিনি দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন এক গান্ধীর নির্দেশে। ১৯৪৬ সালে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির ১৫ ভোটের মধ্যে ১৩টি ভোটই ছিল বল্লভভাইয়ের পক্ষে। কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট যিনি হবেন, তিনিই স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবে ব্যাপারটি অনেকটা এমন ছিল। নেহেরু প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির পছন্দের ব্যাপারটি জেনে চুপ ছিলেন। কিন্তু গান্ধী ভেবেছিলেন, নেহেরু হয়তো দ্বিতীয় স্থান পছন্দ করবেন না। তাই তিনি বল্লভভাইকে নির্বাচন থেকে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে বলেন। বল্লভভাইও বিনা প্রশ্নে গান্ধীর নির্দেশ মেনে নেন।

নেহেরু খুবই অল্প সময়ের জন্য কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট পদে বসেছিলেন। ১৯৪৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৮৭ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত নেহেরু ভারতের অন্তর্বতীকালীন সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন। ভাইসরয়ের নির্বাহী কাউন্সিলে প্রধানমন্ত্রীর সমান ক্ষমতা নিয়ে নেহেরু ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন। আর বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন কাউন্সিলটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে।

বল্লভভাই এবং নেহেরু সব ব্যাপারে একমত না হলেও তারা ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান এই দুই নেতা পরস্পরকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। নিজেদের ভিন্নমতের কারণে দল কিংবা দেশের ক্ষতি হয়েছে এমন কোন অবস্থান তারা কখনোই নেন নি। বল্লভভাইয়ের মৃত্যুর পরে তার সন্তানদের নেহেরু নিজ সন্তানের মতোই দেখে রেখেছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে গান্ধী বল্লভভাইয়ের চেয়ে নেহেরুকে মুক্তমনা এবং আধুনিক ভাবতেন। যেটি পুরোপুরি মিথ্যা নয়। নেহেরুর মতাদর্শ অনেকটা বামপন্থী ঘরানার সমাজতন্ত্রের দিকে ছিল। অপরদিকে বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন ডানপন্থী ক্যাপিটালিজমের দিকে। এছাড়া হিন্দু ধর্মের প্রতি বল্লভভাইয়ের ভালোবাসাটা অনেকটা প্রকাশ্য ছিল। অনেকের মতে বল্লভভাই ছিলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের হিন্দুত্বের পতাকাবাহী একজন, অপরদিকে নেহেরু ছিলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধর্মনিরপেক্ষ অংশের পতাকাবাহী। হিন্দু ধর্মের প্রতি টান থাকলেও বল্লভভাই সাম্প্রদায়িক ছিলেন এমন কোন প্রমাণ কেউ দিতে পারবেন না। গান্ধীর মৃত্যুর পর তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে (আরএসএস) নিষিদ্ধ করেন।

তিনি তাদের নিষিদ্ধ করে লিখেন, “তাদের (আরএসএস) সব বক্তব্য সাম্প্রদায়িকতার বিষে ভরা”। তিনি আরও যুক্ত করেন, “তাদের এই বিষের ফলে দেশকে গান্ধীজীর মহামূল্যবান জীবনটি বিসর্জন দিতে হলো।”

সরদার বল্লভভাই প্যাটেল থেকে লৌহ মানব

বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী। তার সবচেয়ে বড় অবদান ছিলো ভারতবর্ষের প্রায় ৫৬৫ টি রাজ্যকে ভারতের অধীনে আনা৷ এই কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। আর কংগেস এই কাজের ভার অর্পণ করেছিলো বল্লভভাই প্যাটেলের ওপর। প্রথম দফার অন্য রাজ্যগুলো তিনি ভারতের অধীনে আনতে পারলেও জম্মু ও কাশ্মীর, জুনাগড়, ভোপাল ও হায়দরাবাদ – এই রাজ্যগুলোকে তিনি ভারতের অধীনে আনতে বিফল হন৷ পরবর্তীতে তিনি রাজনৈতিক বুদ্ধির জোরে এসব রাজ্যকে ভারতের অধীন করেছিলেন।

অনেক রাজনীতিবিদেরা মনে করেন আজকের সংঘবদ্ধ ভারত তারই চেষ্টার ফল। ভারতের একক রাজ্যগুলোকে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করার কৃতিত্বের জন্য তাকে জার্মানির কিংবদন্তী নেতা অটো ভ্যান বিসমার্কের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তাছাড়া, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এবং ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সরদার বল্লভভাই প্যাটেল। এসব গুণের কারণে সরদার প্যাটেল থেকে তিনি হয়ে উঠেন দেশের লৌহ মানব (‘Iron Man of India’)৷

১৯৫০ সালের ১৫ ডিসেম্বর হৃৎরোগে আক্রান্ত হয়ে মুম্বাইয়ের বিড়লা হাউসে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ মৃত্যুর পর ১৯৯১ সালে তাকে ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এরপর ২০১৪ সালে তার জন্মদিবস ৩১ অক্টোবরকে “রাষ্ট্রীয় একতা দিবস” হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

লেখক- পূজা ধর 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *