ইতিহাস

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিহত যত প্রেসিডেন্ট (পর্ব –১)1 min read

নভেম্বর ৯, ২০২০ 5 min read

author:

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিহত যত প্রেসিডেন্ট (পর্ব –১)1 min read

Reading Time: 5 minutes

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদটা বিভিন্ন দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। তবে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই পদের অধিকারী হলে অপাঘাতে প্রাণ হারাবার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনাও থেকে যায় হয়ত। এখন পর্যন্ত যতজন মার্কিন মুলুকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সকলেই তাদের সময়ের সবচেয়ে সেরা নিরাপত্তা নিয়ে চলেছেন। কিন্তু তার পরেও আততায়ী হামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চারজন প্রেসিডেন্ট মারা গিয়েছেন আততায়ীর হাতে। এর মাঝে আছেন আব্রাহাম লিঙ্কন আর জন এফ কেনেডির মত জনপ্রিয় শাসকেরাও।

আব্রাহাম লিঙ্কন, সাল ১৮৬৫

প্রেক্ষাপট

নিঃসন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস বদলে দেয়া একজন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। আমেরিকান সিভিল ওয়ার দারুণভাবে সামলেছিলেন রিপাবলিকান এই প্রেসিডেন্ট। ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল রাজধানী ওয়াশিংটনের ফোর্ড থিয়েটারে নিহত হন তিনি।

সাধারণত প্রেসিডেন্টের আততায়ী বলতে আমাদের চোখের সামনে একজন ক্ষ্যাপাটে সন্ত্রাসী কিংবা গুপ্তচর জাতীয় কারো চিত্র ভেসে উঠলেও, লিঙ্কনের আততায়ী ছিলেন বিখ্যাত একজন অভিনেতা। তার নাম জন উইলকিস বুথ। বুথ ছিলেন উত্তরের মানুষ। আব্রাহাম লিঙ্কনের দাসদের বিপক্ষে যাওয়াটা তার ঠিক পছন্দসই ছিল না। মার্কিন জনগণের উপর এই আচরণ এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, আজো অল্প কিছু দোদুল্যমান অঞ্চল বাদ দিলে, সমগ্র আমেরিকায় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ নিজেদের জন্য ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্টকেই খোঁজ করে। মার্কিন গৃহযুদ্ধে যদিও উত্তরাঞ্চল জয়লাভ করেছিল তবুও তা মার্কিন ইতিহাসে দাসদের জন্য একটি অধিকারের সূচনা করে দিয়েছিল।

জন উইলকিস বুথ উত্তরের মানুষ হলেও দাসদের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন। দক্ষিণাঞ্চলের নেতা রবার্ট লি তার দল নিয়ে আত্মসমর্পণের ঠিক পাঁচদিন পরেই বুথের হাতে নিহত হন আব্রাহাম লিঙ্কন।

দক্ষিণের প্রতি সমর্থন থাকলেও অভিনয়ের তাগিদে গৃহযুদ্ধের সময়টা উত্তরাঞ্চলেই কাটিয়ে দেন জন উইলকিস বুথ। যুদ্ধের শেষ দিকে চলে আসতেই অন্যরকম এক পরিকল্পনা সাজান তিনি। বুথ আর তার ছয় বন্ধুর পরিকল্পনা ছিল ২০ মার্চ তারা আব্রাহাম লিঙ্কনকে অপহরণ করে দক্ষিণাঞ্চলের রাজধানী রিচমন্ডে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে সেদিন পরিকল্পিত সে জায়গায় আসেননি আব্রাহাম লিঙ্কন।

আব্রাহাম লিঙ্কন, GETTY IMAGES

লিঙ্কনের মৃত্যু

৯ এপ্রিল আত্মসমর্পন করেন রবার্ট লি। যুদ্ধ শেষ হলেও উইলকিস বুথ তখনো ক্ষেপে ছিলেন। আরো বড় পরিকল্পনা করে বসেন তিনি। এবং তা সরাসরি আব্রাহাম লিঙ্কনকে খুন করার পরিকল্পনা।

লরা কিনের কমেডি দেখার জন্য ১৪ এপ্রিল ফোর্ড থিয়েটারে এসেছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন। সে সময় তার সাথে ছিলেন ফার্স্ট লেডি মেরি টড লিঙ্কন। থিয়েটারের প্রেসিডেন্ট বক্সে সেসময় আরো উপস্থিত ছিলেন তরুণ আর্মি অফিসার হেনরি রাথবোর্ন এবং তার বাগদত্তা ক্লারা হ্যারিস।

সকাল দশটা পনের মিনিটে বুথ প্রেসিডেন্সিয়াল বক্সে প্রবেশ করেন। একজন অভিনেতা হিসেবে তার সেখানে প্রবেশ করাটা বেশ সহজই ছিল বলতে গেলে। প্রেসিডেন্সিয়াল বক্সে প্রবেশ করেই তিনি নিজের ডেরিঞ্জার পিস্তল দিয়ে প্রেসিডেন্টের মাথার পিছনে গুলি করেন। অত কাছ থেকে পয়েন্ট ফরটিফোর রেঞ্জের বুলেটের একটি মাত্রই গুলিই যথেষ্ট ছিল। গুলি করার সাথে সাথেই রাথবোর্ন তার দিকে ছুটে যান। বুথ অবশ্য তৈরিই ছিলেন। তাকেও ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। রাথবোর্নকে আঘাত করেই নিচের মঞ্চে ঝাঁপ দেন উইলকিস বুথ। আর চেঁচিয়ে বলেন “Sic semper tyrannis” যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, “এটাই সব অত্যাচারীর নিয়তি” – এটি মূলত যুদ্ধের সময় ভার্জিনিয়া রাজ্যের স্লোগান হিসেবে প্রচলিত ছিল।

প্রথমদিকে দর্শকদের সবাই এটিকে মঞ্চে চলমান কমেডির অংশ হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই ফার্স্টলেডির চিৎকারে তাদের ভুল ভাঙে। বুথ লাফিয়ে নামার সময় তার পা ভেঙে ফেললেও থিয়েটার থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। আর বাকিদের নজর চলে যায় প্রেসিডেন্টের দিকে।

দর্শকদের মাঝে থাকা ২৩ বছর বয়সী তরুণ ডাক্তার চার্লস লিলি প্রথম প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থিত হন। লিঙ্কনের তখন শ্বাস যায় যায় অবস্থা। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো কিছু সৈনিক এসে তাকে রাস্তার পাশের এক সরাইখানায় নিয়ে যান, সেখানেই একজন সার্জন এসে নিশ্চিত করেন প্রেসিডেন্টকে বাঁচানো সম্ভব না। তবুও চিকিৎসার ত্রুটি রাখা হয়নি। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে পরদিন ১৫ এপ্রিল সকাল ৭ টা ২২ মিনিটে লিঙ্কনকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

জন উইলকিসের বুথেরও অবশ্য একই ভাগ্য বরণ করতে হয়। প্রায় দশ হাজার সৈন্য তাকে খুঁজতে বেরিয়ে পরে। তাকে খুঁজে পাওয়া যায় ২৬ এপ্রিল। ভার্জিনিয়ার এক গোলাঘরে বুথ আর তার বন্ধু হেরল্ড আত্মগোপন করে ছিলেন। সৈনিকরা সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। হ্যারল্ড জ্বলন্ত গোলাঘর থেকে বেরিয়ে এলেও জন উইলকিস বুথ সেখানেই থেকে যান।

জেমস গারফিল্ড, ১৮৮১ সাল

প্রেক্ষাপট

জেমস গারফিল্ডের মৃত্যুতে যতটা না আততায়ীর হাত ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল চিকিৎসার ভুল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশতম প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড আততায়ীর গুলিতে আহত হন ২রা জুলাই। আর মারা যান ১৯ সেপ্টেম্বর। এই দুই মাসে কেবলমাত্র অসহনীয় যন্ত্রণাই তিনি ভোগ করেছিলেন।

আব্রাহাম লিঙ্কনের মত জেমস গারফিল্ডও ছিলেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট। ওহাইও রাজ্যের কংগ্রেসম্যান গারফিল্ড ক্ষমতায় ছিলেন কেবল ২০০ দিন। কিন্তু তার শাসনের প্রথম চারমাসেই ব্যাপক পরিমাণ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে রিপাবলিকানরা। বিশেষ করে প্রশাসনিক ক্ষমতার জন্য প্রভাবশালী রিপাবলিকানদের সাথে তার দ্বন্দ খুবই তুঙ্গে উঠেছিল। প্রায় একইসময়ে তার স্ত্রীও ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হন। ঘর এবং বাইরের এই চাপ সামলাতেই ছুটি নিয়ে নিউ ইংল্যান্ডে ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন গারফিল্ড। সেই ছুটির সিদ্ধান্তই তার পুরো জীবনের ছুটি নিশ্চিত করে দিয়েছিল।

জেমস গারফিল্ড, wikipedia

গারফিল্ড হত্যাকান্ড

রেলেই ওয়াশিংটন ডিসি থেকে নিউ ইংল্যান্ডে যাচ্ছিলেন গারফিল্ড। পথে বাল্টিমোর এন্ড পটোম্যাক স্টেশনে তার রেল যাত্রাবিরতি করে। ছুটিতে ছিলেন বলেই কিনা গারফিল্ডের সাথে তখন কোন সৈনিক ছিলেন না। তার সাথে ছিল কেবল দুই সন্তান এবং সেক্রেটারি ব্লেইন।

সকাল ৯ টা ২০ নাগাদ স্টেশনে নামেন গারফিল্ড। সেখানেই বিশ্রামাগারে বসে ছিলেন তিনি। তখনই সেখানে প্রবেশ করেন চার্লস গ্যাটু। চার্লস গ্যাটু বেশ ক্ষ্যাপাটে গোত্রের লোক ছিলেন। প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ডকে হত্যা করাকে ঈশ্বরের দেয়া দায়িত্ব বলে দাবী করেছিলেন তিনি। তার মতে, গারফিল্ডের মৃত্যু রিপাবলিকানদের ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করবে। হাতির দাঁতের তৈরি পয়েন্ট ফরটিফোর ক্যালিবারের পিস্তল কিনেছিলেন জাদুঘর থেকে। এমনকি নিজ এলাকার জেল থেকেও তিনি ঘুরে এসেছিলেন। দেখতে চেয়েছিলেন, যেখানে আশ্রয় নিতে চলেছেন সেখানটা আসলেই কতটা উপযুক্ত তার জন্য। গ্যাটু তার পকেটে একটা কাগজ নিয়ে ঘুরছিলেন। যেখানে লেখা ছিল। “দুঃখজনক হলেও প্রেসিডেন্টের মৃত্যু দরকারী ছিল। কিন্তু এটা রিপাবলিকান পার্টিকে এক করবে এবং রিপাবলিকদের রক্ষা করবে।“

সকাল ৯ টা ২০ মিনিটেই দ্রুত বিশ্রামাগারে প্রবেশ করেন ঘাতক গ্যাটু। আগের এক সপ্তাহ ধরেই প্রেসিডেন্ট গারফিল্ডের পিছু নিয়েছিলেন তিনি। তবে গুলিটা ঠিকমত করতে পারেননি তিনি। প্রথম গুলি আঘাত করে গারফিল্ডের ডানহাতে। পরবর্তীতে প্রতক্ষ্যদর্শীরা জানান, গুলি খেয়েই গারফিল্ড প্রথম বলেছিলেন, “হায় ঈশ্বর! কি এটা!” পরের গুলি আঘাত করে গারফিল্ডের কোমরে।

গ্যাটু পালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ এক নাগরিক তার পথরোধ করেন। সাথে ছিল একজন পুলিশ অফিসার আর স্টেশনের টিকেট চেকার।

(Library of Congress)

ভুল চিকিৎসা এবং গারফিল্ডের মৃত্যু

গারফিল্ড গুলি খেয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মিনিটখানেকের মাঝেই প্রায় দশজন ডাক্তার তার কোমরের কাছে ক্ষত পরীক্ষা করেন। গুলি তার মেরুদন্ড এবং গুরুত্বপূর্ণ সব অঙ্গে আঘাত না করে সরাসরি অগ্নাশয়ে গিয়ে ঠেকেছিল। সেসময়ের চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও যেটাকে খুব সহজেই সারিয়ে নেয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু উৎসাহী ডাক্তারের জীবাণুযুক্ত হাত আর অহেতুক যন্ত্রের ব্যবহার ক্ষতের অবস্থা আরো অনেক বেশি খারাপ করে ফেলে।

ঘন্টাখানেক পরে গারফিল্ডকে ফিরিয়ে আনা হয় হোয়াইট হাউজে। ডাক্তারের ধারণা ছিল সে রাতেই মারা যাবেন গারফিল্ড। কিন্তু গারফিল্ড বেঁচে ছিলেন। তবে বেশ কিছুদিন পরেই গারফিল্ডের শরীর খারাপ হতে শুরু করে। তার ডাক্তার উইলার্ড ব্লিস তাকে কড়া ডোজের কুইনাইন, মরফিন এবং অ্যালকোহল দিতে থাকেন। ব্লিস নিজেও বেশ কয়েকবার প্রেসিডেন্টের শরীরে দ্বিতীয় বুলেটের খোঁজ করেন। এমনকি আলেকজান্ডার গ্রাহামবেলের মেটাল ডিটেক্টরের সাহায্যও নেয়া হয় বুলেটের সন্ধান করার জন্য। গ্রাহামবেলকে গারফিল্ডের শরীরের ডান পাশেও খোঁজ চালানোর অনুমতি দেয়া হয়। অথচ সেদিকে গুলি ছিল না।সেপ্টেম্বর নাগাদ ইনফেকশন ছড়িয়ে পরে গারফিল্ডের শরীরে। তার শরীরে ফোস্কাও দেখা যায়। হোয়াইট হাউজ থেকে সরিয়ে তাকে জার্সি উপকূলের কাছে এক কটেজে নিয়ে আসা হয়। ধারণা করা হয়েছিল, সমুদ্রের বিশুদ্ধ বাতাস প্রেসিডেন্ট গারফিল্ডের স্বাস্থ্য ফেরাতে পারে। কিন্তু সেখানেই ১৯ সেপ্টেম্বরের রাতে জেমস গারফিল্ড শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

-ঐশ্বর্য মীম

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *