কেমন ছিল ট্রাম্পের চার বছর?1 min read
Reading Time: 3 minutesএই লেখাটি যখন আপনি পড়ছেন তখন মার্কিন নির্বাচনের আটচল্লিশ ঘন্টাও বাকি নেই। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বৈশ্বিক গতি প্রকৃতির সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রক পদের জন্য লড়াইতে নেমেছেন জো বাইডেন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প। একজন দীর্ঘদিনের সিনেটর আর আট বছরের ভাইস প্রেসিডেন্ট। অন্যজন রীতিমতো ব্যবসায়ী থেকে প্রেসিডেন্টের আসনে। দুজনের রাজনৈতিক দর্শনে তাই বিস্তর ফারাক। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কেমন হবেন তা কিছুটা আঁচ করা যায়, বারাক ওবামার সাথে তার সম্পর্ক আর ২০০৮ থেকে ২০১৬ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকা কালে তার মার্কিন নীতি দেখে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প সেদিক থেকে রীতিমতো দূর্বোধ্য। প্রেসিডেন্ট হবার পর প্রথম দিন থেকেই রীতিমতো চমকের পর চমক দিয়ে গিয়েছেন ট্রাম্প। কিছু ক্ষেত্রে ট্রাম্পের এসব কর্মকান্ড হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। কিছুক্ষেত্রে মানুষকে হতবুদ্ধি করেছে আবার কিছু ক্ষেত্রে মানুষ রীতিমতো রাগান্বিত হয়েছেন ট্রাম্পের উপর।
মেক্সিকান সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ সংক্রান্ত কথার জন্য ট্রাম্পের সমালোচনা চলছে। মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্তে এখনো প্রায় ৫৪০ জন বাচ্চা পিতা-মাতা ছাড়াই আটকে আছে। প্রেসিডেন্সি বিতর্কে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে ট্রাম্প জবাব দেন, “তাদের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এবং তারা সেখানে ভাল পরিবেশে রয়েছে।“ কিন্তু প্রশ্ন উঠে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের থেকে এমন একটি বক্তব্য কি সত্যিই বিশ্ববাসী আশা করে? একজন শিশুর সমস্ত পরিবেশে যেখানে বাবা-মা প্রয়োজন, সেখানে সীমান্তে অভিভাবকহীন এত শিশুকে নিয়ে তার এমন দায়সারা বক্তব্য কি তার প্রশাসনিক ব্যর্থতাকেই চিহ্নিত করেনা?
অদক্ষতার বহিঃপ্রকাশ
ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির চার বছরে সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত প্রচারণা। ব্যবসায়ী ট্রাম্প যে রাষ্ট্রীয় কাজে কিছুটা দূর্বল তা বিভিন্ন অবস্থায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। জাতিসংঘের সাধারণ সভায় অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যক্তিগত সাফাই গাওয়া কিংবা দীর্ঘসময় পর্যন্ত প্রেস ব্রিফিং করা- সবকিছুতেই তার কিঞ্চিৎ অদক্ষতা প্রকাশ হয়েছিল। সেই সাথে ব্রিটেনে গিয়ে রাণী এলিজাবেথের সাথে রাজকীয় ভোজে প্রটোকল ভঙ্গ করা, ভারতে এসে ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলতে গিয়ে বেশ হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি করা, প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন থেকে বেরিয়ে আসার মতো ঘটনা ট্রাম্পের চার বছরের অজস্র কাজের মাঝে একেবারেই আলাদাভাবে মনে রাখার মতো। ট্রাম্পের এমন আচরণের প্রতি বৈশ্বিক নেতারাও যে খুব বেশি খুশি ছিলেন না তা স্পষ্ট হয়েছিল ২০১৯ সালের ন্যাটো সম্মেলনে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাঁক্রো আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পর্দার পিছনে ট্রাম্প সংক্রান্ত হাস্যরস বেশ সাড়া ফেলেছিল নেটিজেনদের মাঝে।
কঠিন মহামারিতে বিতর্কিত ট্রাম্প
চলমান কোভিড সংক্রান্ত সময়েও একের পর এক হাস্যকর বক্তব্য দিয়ে গিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মাস্ক ব্যবহারের কারণে প্রতিদ্বন্দী জো বাইডেনকে ভীতু বলে আখ্যা দেয়া, “একটা জাদুর মত কোভিড-১৯ চলে যাবে” কিংবা “এটি দৃশ্যত কাউকেই আক্রান্ত করেনা,” অথবা মানুষের শরীরেই জীবাণুনাশক ইনজেকশন করার মতো অদ্ভুত প্রস্তাব রেখেও হাস্যরসের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
এর বাইরে ইসলামের প্রতি তার বিদ্বেষ কিংবা ইসরায়েলের সাথে সম্পর্কের দিক থেকে ট্রাম্পের চার বছর উল্লেখ করার মতো। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্পের সবচেয়ে আলোচিত পদক্ষেপ ছিল ইসরায়েলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মধ্যস্থতা প্রচেষ্টা। আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সাথে ইসরায়েলের সমঝোতা চুক্তিতে বড় প্রভাব রেখেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্পের যত ইতিবাচক দিক
এতকিছুর ভীড়ে অবশ্য অনেক ইতিবাচক দিকও ছিল ট্রাম্পের। যার মধ্যে সবার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট এর সংস্কার পদ্ধতির কথা বলতে হয়। তিনি নতুন তিনজন বিচারপতি এবং ২২০ জন বিচারক নিয়োগ করেছেন। তাদের সকলেই আজীবনের জন্য নির্বাচিত। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ টি সার্কিট কোর্টে মোট ৫৩ জন বিচারক নিয়োগ দেন। যেখানে পুরো ৮ বছরে বারাক ওবামা নিয়োগ দিয়েছিলেন কেবল ৫৩ জন বিচারক। আইন ব্যবস্থা সংহত করতে ট্রাম্পের এমন উদ্যোগ বেশ অনেকটা সময় ধরেই প্রভাব বজায় রাখবে।
১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর এবারই প্রথম মার্কিন বিমান বাহিনীতে নতুন এক শাখা অনুমোদন পেয়েছে। স্পেস ফোর্স নামের এই নতুন ফোর্সের জন্য প্রায় ৭৩৮ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন দিয়েছেন ট্রাম্প। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিভাগের শক্তি বৃদ্ধিতে এটি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে চলেছে। এটি মার্কিন নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কাজের চাপ কমাতে কাজ করবে। সেই সাথে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারেও কাজ করবে এই বিশেষ শাখা।
ট্রাম্পের চার বছরের সবচেয়ে বড় সাফল্য নিঃসন্দেহে আইএস এর খিলাফতের পতন। সেই সাথে আইএসের শীর্ষ নেতা আবু বকর আল বাগদাদী এর মৃত্যু। ২০১৪ সালে সিরিয়া এবং ইরাকের বড় একটি অংশ দখল করে নেয় আইএস। তারা সেখানে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। ৫ বছরের প্রাণান্ত চেষ্টায় উগ্রপন্থী এই ইসলামী দলকে দমন করতে সক্ষম হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে দাবী করেছেন আইএস সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে। তবুও এখন পর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার মার্কিন সৈন্য ইরাক ও সিরিয়াতে রয়েছে। আইএস সংক্রান্ত খবরও এখন মিডিয়ায় অনেকটাই কমে এসেছে। যার কৃতিত্ব ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিতেই হয়।
ব্যর্থতার ইতিবৃত্ত
সাফল্যের চেয়ে ট্রাম্পের ব্যর্থতার পাল্লাই একটু বেশি ভারি বলা যায়। অভিসংশনের মত বড় বিতর্ক ট্রাম্পের সঙ্গী ছিল। ইউক্রেনের সাথে চুক্তিতে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং কংগ্রেসের সম্মান ক্ষুন্ন করার মত দুই অপরাধে তার বিরুদ্ধে অভিসংশনের প্রস্তাব আসে হাউজ অফ রিপ্রেজেনটেটিভ থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ ইতিহাসে কেবল ৩য় প্রেসিডেন্ট হিসেবে এমন লজ্জা পেতে হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে।
কোভিড ইস্যুতেও বড় আকারের ব্যর্থতার গল্প লিখেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রায় ৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন মার্কিন নাগরিক এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন পর্যন্ত কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হননি। মৃত্যু ও শনাক্তের হারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিশ্বের অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, ১৯৪৫ এর পর থেকে সব যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যত সৈন্য মারা গিয়েছে, কেবল এই কোভিড-১৯ ভাইরাসেই তার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।
এছাড়াও কৃষাঙ্গ অধিকার ক্ষুন্ন করা এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে মন্দাভাবের দায়ও আছে তার কাঁধে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এছাড়া দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বর্তমানে শূন্যের অল্প উপরে। প্রায় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেকারত্ব নিয়ে বর্তমানে দেশটিতে ১৩ মিলিয়ন ব্যক্তি বেকার অবস্থায় রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বড় এক ব্যর্থতা হিসেবেই একে দেখতে চাইবেন মার্কিন জনগণ।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ