ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (ষষ্ঠ পর্ব): কোটা ফ্যাক্টরি- আইআইটি কত দূর!1 min read
Reading Time: 5 minutesএক মাস বাদেই শুরু হতে যাচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। স্বভাবতই শিক্ষার্থীরা জোরেশোরে চালিয়ে যাচ্ছে অহোরাত্রির সাধনা। তবে পরীক্ষা শেষ মানেই কিন্তু শেষ নয়। কলেজের ঝুলি গোটাতেই প্রস্তুতি নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের। তখন কেউ মেডিকেলের স্বপ্নে বিভোর, কেউ ভবিষ্যৎ প্রকৌশলীর স্বপ্নে। বাংলাদেশের সব জেলা থেকেই কিশোর কিশোরীরা ভিড় জমাবে পরিকল্পিত ও সফল ভবিষ্যতের আশার ভর্তিযুদ্ধে।
বছর খানেক আগেও শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল ভর্তি কোচিংয়ের সফল ও নিশ্চিততম ব্যবস্থা। বর্তমানে বিভাগীয় শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকাতেও অল্প বিস্তর বিস্তার লাভ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের পসরা। অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা কারণেই তাই একক কোন জনপদে পত্তন ঘটেনি বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং ধারণার। কিন্তু প্রতিবেশি দেশ ভারতে কিন্তু এর রমরমা কারবার চোখে পড়ে। আর এর আটপৌরে গল্পকে উপজীব্য করেই নির্মিত হয়েছে পাঁচ পর্বের মিনি সিরিজ ‘কোটা ফ্যাক্টরি’।
কাহিনি সংক্ষেপ
বছরান্তে দশ লাখেরও বেশি ভারতীয় শিক্ষার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় এক পরীক্ষা আইআইটি এন্ট্রান্স। মাত্র তেরো হাজার তিনশো ছিয়াত্তর আসনের বিপরীতে প্রস্তুতি নেয়া- রণকৌশলের চাইতে কম নয়। ১৯৪৬ সালে স্যার যোগেশচন্দ্র সিংয়ের আহ্বায়িত কমিটির পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৫০ সাল থেকে ভারতের ২৩টি শহরে স্থাপন করা হয় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। খড়্গপুর দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও ক্রমে এর পরিসর বাড়ছে। স্বাধীনতা উত্তর ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমৃদ্ধিই ছিল ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির আদলে তৈরি করা এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য। এর সুফলও ভোগ করছে এখন ভারত। সুন্দর পিচাই, নারায়ণা মুরথি, চেতন ভগত থেকে বিনোদ খোসলা; বহু প্রভাবশালীই এসেছেন এর হাতধরে।
বহুল আকাঙ্ক্ষিত আইআইটির ভর্তিযুদ্ধ যে কঠিন হবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ভারতীয় মধ্যবিত্তসমাজে এর চল সবচাইতে বেশি।গড়ে ১৫ বছর বয়স থেকেই একজন ভারতীয় কিশোর বা কিশোরীর প্রস্তুতি পর্ব আরম্ভ হয়। সেই রণে সাফল্যের জন্য কঠোর অধ্যবসায়, নিয়মিত পড়ালেখার পাশাপাশি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশেরও একটা প্রভাব থাকে। সত্তর বছর পূর্বের পরিকল্পনার সুফল ভারত পেয়েছে নব্বইয়ের দশকে, ফলে প্রযুক্তি শিক্ষার চাহিদাও উঠতি। তাই কোচিং বাণিজ্যও রমরমা ব্যবসার চাবিকাঠি পেয়ে গেছে এর সুবাদে।মাত্র দুই দশকেই রাজস্থানের কোটা শহর আইআইটি কোচিংয়ের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর সর্বনিম্ন দশ হাজার শিক্ষার্থীর সমাগম ঘটে এই শহরে। বছরব্যাপী প্রস্তুতির পরেই যুদ্ধের ময়দানে নামতে হয় তাদের। এই সময়টায় পরিবার-পরিজন তো বটেই, গোটা পৃথিবীর থেকেই বিচ্ছিন্ন থাকতে হয় তাদের।
আর দশটা গড়পড়তা স্বপ্নবাজ কিশোরের মতোই বৈভব পাণ্ডের আগমন ঘটে কোটায়। প্রডিজি নামী কোচিংয়ে ভর্তি হতে না হতেই টের পায়,ফেলে আসা পৃথিবী থেকে আমূল আলাদা এই ‘হোস্টেলের শহর’। এ শহরে বিনোদন হলো খ্যাতিমান শিক্ষকদের শিক্ষামূলক ভিডিও,পুরো দুনিয়া যখন এন্ড্রয়েড বা অ্যাপলের স্মার্টফোনে বুঁদ, তখনও নোকিয়ার সেই মান্ধাতা আমলের ফোনের রাজত্ব এখানে। অদ্ভুত দোটানা থেকে তাকে তুলে আনে নতুন দুই বন্ধু মিনা আর উদয়। কোটার নিয়মকানুন, দিনলিপি, শহর যাপনের সাথে বৈভবকে একাত্ম্হ তে আরও এগিয়ে আসে শহরের তারকা শিক্ষক- জিতু। রসায়নের নীরস কটাক্ষ, পদার্থবিজ্ঞানের অব্যর্থ গণিত কিংবা মেকানিক্সের‘রিস্ক’– সব মিলিয়ে খাবি খাওয়ারই দশা হয় বৈভবের। সাদাকালো,পরাধীন জীবনের মাঝেও উদয়, মিনা, শিবাঙ্গী আর বর্তিকার আলোড়নে কোটায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে সে। ভালোবাসতে শেখে শিক্ষাঙ্গনের তীব্রসংগ্রামকে।
সাদাকালোয় মোড়া
ভারতের প্রথম সাদাকালো ওয়েব সিরিজ ‘কোটা ফ্যাক্টরি’। একরাশ স্বপ্ন নিয়ে কোটায় এলেও শেষ অবধি এর জীবনটা যে দুই রঙা আঁচ তা করা যায় সহজেই। উদয় চরিত্রে অভিনয় করা আলম খান তো বলেই ফেললেন, ‘বইয়ের দুনিয়া তো সাদাকালোই। কোটাও অমন।‘
জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল টিভিএফ বা দ্য ভাইরাল ফিভারের ব্যানারে ২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল TVFPlay তথা ইউটিউবের মাঠে প্রচারিত হয় এর প্রথম পর্ব। ভারতের সর্ববৃহৎ শিক্ষামূলক প্লাটফর্ম Unacademy ও JEE (Joint Entrance Examination) ছিল এর পৃষ্ঠপোষক। এই সিরিজটি গত বছরের সবচাইতে আলোচিত এবং দর্শকপ্রিয় সিরিজ হলেও এর বাজেট ছিল স্বল্প এবং অভিনেতারাও ছিলেন অপেক্ষাকৃত নবীন মুখ।
পাঁচ পর্বের প্রতিটির ব্যাপ্তি ছিল ৩৫-৪০ মিনিট। ‘Inventory’, ‘Assembly Line’, ‘Optimization’, Shutdown’, ‘Overhaul’- নামের এই কয় পর্বেই কোটার মাহাত্ম্য আর বিস্তৃতির সারমর্ম দাঁড় করেছে ‘কোটা টিম’। সিরিজের প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি বলিষ্ঠতা ছিল এর চিত্রনাট্যে। সৌরভ খান্না, সন্দীপ জৈন, অভিষেক যাদব, তমজিত দাস ও হিমাংশু চৌহানের সম্মিলিত প্রচেষ্টারই নিদর্শন ‘কোটা ফ্যাক্টরি’। প্রধান নির্দেশক সৌরভ খান্না হলেও পরিচালনার দায় ছিল রাঘব সুব্বুর কাঁধে।
নির্বাহী প্রযোজক সামির সাক্সেনা জানান আরও কিছু তথ্য, সৌরভ খান্না কিন্তু আইআইটির ছাত্র ছিলেন। শুধু তাই না, কোটায় ক্লাসও নিয়েছেন তিনি। তবে মজাদার বিষয় হলো, টিভিএফের ৫০ ভাগ সদস্যই কোটায় থেকেছেন। সে হিসেবে এই গল্পটা তাদেরও।‘
সহযোগী প্রযোজক শ্রেয়াস পান্ডে এর মূল লক্ষ্যটা পরিষ্কার করে জানান এভাবে, ‘কোটার ধ্যানজ্ঞান, অনুভূতি জুড়েই বিদ্যাচর্চা। ভিডিও মাধ্যমে সেটা ফুটিয়ে তোলা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের জন্য।‘ পরিচালকের দৃষ্টিতে কোটা নিজেই একটা চরিত্র। প্রথম পর্বের অটোরিক্সাওয়ালার চরিত্রে নাকি অমিতাভ বচ্চনকে নেবার ফন্দি এঁটেছিলেন রাঘব। শেষমেশ অবশ্য ছোট পর্দার প্রিয়মুখ দীপক কুমার মিশ্রকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নেন।
পুরো শহরের দৃশ্যায়নে ড্রোনের ব্যবহার থাকলেও তা কখনোই বাড়তি মাত্রায় আনেননি সিনেমাটোগ্রাফির জেরিন পল। শেষ দৃশ্যে ‘রিওয়াইন্ড শট’ও করেছেন ধীর স্থিরভাবেই। কোটায় স্বপ্ন দেখা যে অলীক নয়- সেই মেটাফোরই টেনেছেন এখানে।
টানা ৩১ দিন ধরে চলেছে সিরিজের শুটিং। বৈভব চরিত্রে অভিনয় করা ময়ূর মোরে অবশ্য শুটিং নিয়ে মাথা ঘামাননি। নির্দেশকের নির্দেশে পুরো সময়ই চষে বেড়িয়েছেন গোটা কোটা রাজ্যে। কুশীলবদের মধ্যে শুধুমাত্র রঞ্জন রাজ অর্থাৎ মিনা আর জিতেন্দ্র কুমারেরই আইআইটির অভিজ্ঞতা আছে।
আবিষ্কারেই চমক
সার্বিক বিবেচনায় কোটা ফ্যাক্টরি মূলধারার তথা ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজকে আকৃষ্ট করতে পেরেছে। বিগত তিন দশকে আইআইটির চাহিদার আকাশচুম্বী রূপই এর কারণ। ফলে বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী এর সাথে নিজেদের অভিজ্ঞতার মিল খুঁজে পেয়েছেন। সিরিজে জনপ্রিয় ছবি ‘ থ্রি ইডিয়টস’এর খানিকটা আভাস মেলে। উদয়ের মুখে ‘এটা কিন্তু সিনেমায় যেমন দেখায় তেমন নয়।‘ সংলাপ যেন ভিন্ন পথে বলিউডি বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতির চকচকে উপস্থাপনকেই নীরবে চপেটাঘাত করে। জিতু ভাইয়ার অনুপ্রেরণামূলক মনোলোগ ও বৈভবের রসায়ন সংক্রান্ত মনোলোগ নজর কাড়ে সহজেই। মিনার স্বভাবজাত চাঞ্চল্য, বর্তিকার মিঠে রোদ্দুরের মতো হাসি কিংবা উদয়ের বিভ্রান্ত অথচ সরল চরিত্র খুব সহজেই দর্শক মিলিয়ে নিতে পেরেছে পরিচিত জনের সাথে। বাস্তবঘেঁষা বলেই সমালোচকদেরও হাততালি পেয়েছে সিরিজটি। তবে অনেকের মতে Unacademy এর ‘পণ্য উপস্থাপন মাত্রা’ দৃষ্টিকটু লেগেছে।
কার্ত্তিক রাও ও সিমরান হোরার সুরায়োজনে ১২টি মৌলিক ট্র্যাকও পেয়েছে এর দর্শক। আইএমডিবিতে ৯.৫ রেটিং এর পাশাপাশি ২০ মিলিয়ন দর্শকের দুরন্ত রেকর্ডও ছুঁয়েছে এটি।
সাফল্যটা আকস্মিক নয়
মারাঠা চলচ্চিত্রের বেশ পরিচিত মুখ ময়ূর। ‘ফাটাক’(২০১৪) দিয়ে বড় পর্দায় যাত্রা তার। ‘উমরিকা’(২০১৫), ‘লাকি(২০১৯) প্রভৃতির পাশাপাশি নিয়মিত মঞ্চেও কাজ করে যাচ্ছেন। বলিউডে অভিষেকও হয়েছে এর আগে। ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’ (২০১৬), ‘শচীন: আ বিলিয়ন ড্রিমস’ (২০১৭), ‘আনারকলি অফ আরাহ(২০১৭), ‘টিকলি এন্ড লাক্সমি বম্ব(২০১৭) এ পার্শ্বচরিত্রে থাকলেও রাতারাতি খ্যাতি মেলে কোটাতেই। ‘স্যাক্রেড গেমস’ কে পেছনে ফেলা এই সিরিজের বদৌলতে আইডব্লিউএমবাজ ডিজিটাল এওয়ার্ডসে সেরা জনপ্রিয় অভিনেতার পুরস্কারও পান ময়ূর।
টিভিএফের প্রায় জন্ম থেকেই নিবেদিত জিতেন্দ্র কুমারও সম্প্রতি আলোচনায় এসেছেন আয়ুষ্মান খুরানার বিপরীতে ‘শুভ মঙ্গল জেয়াদা সাবধান’দিয়ে। আর কিংবদন্তীতুল্য ‘জিতু ভাইয়া’ চরিত্রের জন্য ওয়েব সিরিজের জমানায় শক্ত অবস্থানও তৈরি করতে পেরেছেন তিনি।শিশুশিল্পী হিসেবে পরিচিত হলেও বছর পাঁচেক হলো এহসাস চান্না আর আলমখান নিজেদেরখোলস বদলাচ্ছেন।
প্রযুক্তিগত একনিষ্ঠতার সুফলের হাওয়া ভারতে জেঁকে বসছে ক্রমেই। তবে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও কম নয়। তাই জিতু ভাইয়ার সংলাপেই শেষ করছি আজকের আলাপন-
‘কী দেয় কোটা? আই আইটির নাম জপতে জপতে দুইটা বছর চলে যায়। ওদিকে কোন দেশের সরকার পতন হলো, কার বিয়ে হলো, আইপিএলে কে জিতলো- এগুলোর গুরুত্ব থাকেনা জীবনে। ছাত্র ছাত্রীরা তো কোটা ছেড়ে যায়, কোটা তো ছাড়েনা। বাবামা, আত্মীয়- পরিজন সব পিছনে হারিয়ে যায়। নবীন কালে মন প্রাণ উজাড় করে যখন কেউ কিছু চায়, তখন স্রেফ দুটো জিনিস হয়। যদি পেয়ে যাও তো প্রশান্তি, আর না পেলে? ঈর্ষা, আত্ম সংশয়, ঘেন্না সব জাঁকিয়ে বসে। এরপর যত ভালো কলেজেই পড়ো না কেন,মন ভরেনা। স্নাতকের চার বছর আর চাকরির তিন বছর – মোট সাত বছর লেগে যায় এই দুই বছরের গ্লানি ভুলতে।‘