বিনোদন

ওশিমার চোখে মুজিব1 min read

জুলাই ২, ২০২০ 5 min read

author:

ওশিমার চোখে মুজিব1 min read

Reading Time: 5 minutes

প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্রের বদৌলতে বিশ্ব দরবারে সুপরিচিত নাম নাগিসা ওশিমা। সমসাময়িক আরেক নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়ার মুনশিয়ানায় প্রভাবিত হয়ে জাপানে সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারার আরম্ভ করেছিলেন। বিতর্কিত, অস্পৃশ্য কোন বিষয়কেই এড়িয়ে যাননি; বরং ফ্রেমের বাতাবরণে দিয়েছেন অন্য মাত্রা।

পলিটিক্যাল হিস্ট্রির ছাত্র বলেই হয়তো রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল রন্ধ্রে। তারই প্রকাশ ঘটে ‘Night & Fog in Japan’(১৯৬১), ‘Shonen’ (১৯৬৯),‘Death by Hanging’ (১৯৬৮) প্রভৃতি ছবিতে। জাপানি পরিচালক হওয়া সত্ত্বেও দেশের রাজনীতি অথবা সংস্কৃতির কট্টর দিক তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি। সাহসী কাজের জন্য আদালতের ধর্নাও দিতে হয়েছিল বেশ কবার।

রাজনীতির বিষয় আশয়ে বিপুল আগ্রহই তাঁকে টেনে এনেছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কোলে। নবজন্মের দাগ তখনও দগদগে মানচিত্রে। সংগ্রাম ও রক্তস্নানের পর শিশু দেশটিকে নিয়ে তিনটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন ওশিমা।

‘জয় বাংলা’ (১৯৭২), ‘রহমান, ফাদার অব বেঙ্গল’ (১৯৭৩) আর ‘গোল্ডেন ল্যান্ড অব বেঙ্গল’(১৯৭৬)-এই তিনটি তথ্যচিত্রই তৎকালীন বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার দালিলিক প্রমাণ বহন করে।

মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে মাঝের তথ্যচিত্র সম্পর্কেই আলোচনা করা হবে এই লেখায়। মাত্র ২৮ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডের ফ্রেমে সুষমভাবে উঠে এসেছে বেশ কয়েকটি বিষয়। তৎকালীন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উপার্জন ক্ষমতা, দারিদ্র্যের রূপ, স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতি এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন দর্শন।

ক্যামেরা হাতে নাগিসা ওশিমা; Photo:Mubi

সমকালীন দারিদ্র্যনামা

‘জয় বাংলা’ নির্মাণকালে নাগিসার শুটিং দল ঘুরে বেরিয়েছেন শহরের গলি-ঘুঁজিতে, সেখানেই পেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলার নানান রসদ। তবে ‘রহমান: ফাদার অব বেঙ্গল’ এর ইতিহাসের খোঁজে প্রথমবারের মতো গ্রামাঞ্চলেও পা রাখেন এই জাপানি ফিল্মমেকার।

প্রতিপাদ্য যখন শেখ মুজিব, সূচনাতেই তাঁর জন্মস্থান দর্শনকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন ওশিমা। সেই আমলে ফরিদপুরের রাস্তা এতটা সুগম ছিল না, তাই জলপথই ভরসা। যাত্রাপথেই ভাটিয়ালির মূর্ছনার পাশাপাশি তখনকার অর্থনৈতিক অবস্থার একটা ক্ষুদ্র চিত্র দেখান তিনি।

ঢাকা থেকে ফরিদপুর যাবার ভাড়া ছিল ৪ টাকা, জাপানি হিসাবে ১৬০ ইয়েন। লঞ্চের প্রথম শ্রেণিতে ৩৭.৫ টাকা খরচা করতে হয়েছিল শুটিং টিমকে। জাপান তখন বেশ অগ্রগামী, তাদের জন্য এই ভাড়া অনুপযুক্ত মনে না হলেও সাধারণ বাঙালি শ্রমিকের জন্য তা ছিল পাহাড় সমান।

ধর্মীয় নিরপেক্ষতার উপর ভিত্তি করে স্বাধীন বাংলার জন্ম হলেও এদেশের মানুষের ধর্মের প্রতি অনুরাগ অস্বীকার অসম্ভব। সীমিত সময়ে সে অংশটিও নজর এড়ায়নি তাদের।

জনগণ এবং মুক্তির সনদ

সুদীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। এর পুরোটা সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন আন্দোলন ও স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমান। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে ভগ্ন দেশটি নবীন উদ্যমে গঠনের আশা দেখা দেয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট ভবনে প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ মুজিবুর রহমান এবং রাষ্ট্রপতি পদে আবু সায়িদ চৌধুরী শপথ গ্রহণ করেন।

আলাপনে রাসেল 

বঙ্গবন্ধুর পাশে সবসময় এক ছোট্ট, মিষ্টি ছেলের দেখা মিলতো। প্রায় সকল অনুষ্ঠানেই তাঁর পাশের আসনখানা দখলে রেখে আদায় করে নিতো প্রবাদপ্রতিমের আদর। এই বিষয়টিও গভীরভাবে অভিভুত করেছে জাপানি নির্মাতাকে।

তথ্যচিত্রের ফাঁকে ফাঁকেই তাঁর সাথে মুজিবের সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। প্রসঙ্গ ক্রমে প্রশ্ন করেন সেই শিশুটিকে নিয়েও।

‘ওশিমা: প্রায়ই সরকারি অনুষ্ঠানগুলোতে আপনার সাথে এক বালককে দেখি। তাঁর বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই। তাঁর নাম কী, বয়সই বা কতো?

মুজিব: তাঁর এখন সাত চলছে। নাম রাসেল, শেখ রাসেল।

ওশিমা: তাঁকে সবসময় সাথে রাখার কারণ কী?

মুজিব:  তার জীবনের সিংহভাগ সময়েই আমি জেলে ছিলাম। একারণেই আমার খুব ন্যাওটা। ওর বয়স যখন ১৫ মাস তখন জেলে যাই, তিন বছর ছিলাম। ফেরার দেড় বছর বাদে আবারও জেলে ঢুকতে হয়। তাই ভাবে বাবাকে আবার হারিয়ে ফেলতে পারে।‘

বঙ্গবন্ধু রাজনীতিক হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগেই গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন চাচাতো বোন বেগম ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে। মা-বাবার মতেই বিয়ে হয় তাঁদের। বেগম ফজিলাতুন্নেসা মাত্র আড়াই বছরেই হারিয়েছিলেন পিতাকে, মাতার প্রস্থান ঘটে পাঁচ বছর বয়সেই। এরপর অভিভাবক হিসেবে দাদা থাকলেও তিনিও বছর দুই পর মারা যান।

রাজনীতি সচেতনতার পত্তন

দীর্ঘ সময় ধরেই এই রাষ্ট্রনায়কের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন নাগিসা। রাজনীতিপ্রিয় হিসেবে দূরদর্শী প্রশ্ন রাখেন মুজিবের টেবিলে। প্রশ্ন করেন বাঙালির আত্মগর্ব প্রসঙ্গে।

ইসলামিয়া কলেজে পাঠ গ্রহণ কালেই প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে যুক্ত হন শেখ মুজিব। ‘সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র সংগঠন’ এ যোগ দেন ১৯৪০ সালে। এর বছর তিন বাদে ‘বেঙ্গল মুসলিম লীগের’ সদস্য হন। এই সময়গুলোয় শুধু মাঠে নয় বিশ্ব রাজনীতি পাঠেও ছিল তাঁর অখণ্ড মনোযোগ।

ওশিমাকে বঙ্গবন্ধু জানান,

‘চাহিদামাফিক সব বই আমরা পড়তে পারতাম না। ব্রিটিশরা অনেক বিপ্লবী বই নিষিদ্ধ করেছিল। তবে গোপনে সেগুলো আমরা সংগ্রহ করে পড়তাম। আমি মার্ক্স পড়েছি। এর আগে ফরাসি বিপ্লব পড়েছি। সান ইয়াত-সেনের আন্দোলন নিয়েও পড়েছি। মধ্যপ্রাচ্য আন্দোলন, আমেরিকার স্বাধীনতা পড়েছি। লেনিনের বিপ্লব সম্পর্কেও বেশ অনেকগুলো বই পড়েছি।‘ 

রাশভারী কণ্ঠে স্মিত হেসে মুজিব তুলে ধরেন বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাস। ব্রিটিশ সংগ্রামের পুরোধায় এই অঞ্চলের সন্ত্রাসী আন্দোলন ছিল বিখ্যাত। এখান থেকেই অধিকার রক্ষায় নিরন্তর লড়েছিলেন তিতুমীর, সুভাষচন্দ্র বসু, এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি প্রমুখ। জ্ঞানে, কাব্যে ক্রমাগত গণমানুষকে উজ্জীবিত করেছেন কাজী নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বাংলার উর্বর ভূমির লোভেই শাসনের শকুন বারেবারে হানা দিয়েছে এদেশে। কিন্তু প্রবল প্রতিরোধ ব্যতিরেকে অন্যায় কোনদিন মাথা পেতে নেয়নি এদেশের তরুণেরা। সিপাহী বিদ্রোহের তরবারি এদেশেই গর্জে উঠেছিল এককালে। শিল্পমনা বাঙালির আছে নিজস্ব পল্লিগীতি, পোশাক আশাক ও ভাষা চেতনা।

জাতির জনক প্রসঙ্গে

বাংলাদেশের সংগ্রামকে সুদূর জাপান থেকে দেখেছিলেন ওশিমা। এর অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও আবেগের অংশটুকু অনেকখানিই প্রচ্ছন্ন তাঁর কাছে। তাই প্রশ্ন করেন,

‘আপনাকে বঙ্গবন্ধু বলে ডাকা হয়। যার অর্থ হচ্ছে ‘বাংলার বন্ধু’। কিন্তু এই নাম দেয়ার কারণ কী? আমার তো মনে হয় আপনাকে ‘বাংলার জনক’ বলে ডাকাটাই যুক্তিসঙ্গত।‘ 

উত্তরে সরলভাবে ব্যাখ্যা দেন জাতির পিতা,

‘লড়াই চলার সময় এই উপাধি আমি পেয়েছিলাম। পাকিস্তানিদের সাথে তখনও প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নামিনি আমরা। ওরা আমাদের বাঙালি পরিচয় পছন্দ করতো না। বাংলার নাম পাল্টে পূর্ব পাকিস্তান রাখতে চায়। আমরা প্রত্যাখ্যান করি। জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের সময় এই উপাধি দেয় বাংলার জনতা। বাংলা আমার মাটি, আমার সাহিত্য, আমার সব। এটা আবেগের ব্যাপার, জনগণ সে কারণেই এই নাম দিয়েছিল।‘ 

অনাড়ম্বর আপ্যায়ন

পারিবারিক আবহে শেখ মুজিব; Photo:100 years of Mujib

সংবিধান বলবতের অনুষ্ঠানের ফুটেজও মেলে এই তথ্যচিত্রে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ সঙ্গীতের সামনে হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধুকে দেখা যায় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে। সেখানে বাড়তি কোন আড়ম্বর নেই। সাধারণ সমুচা, মাখন রুটি, কেক আর কলাতেই আপ্যায়িত হন অতিথিবৃন্দ।

দেশপ্রধান হয়েও পরিমিতির কথা ভোলেননি। তাই বিনা খবরে চিত্রধারণকারী দল যখন নাস্তার টেবিলে হানা দেয় তখন মুগ্ধতাই ঝরে পড়ে তথ্যচিত্রটির কথক মুতশিরো তোরার কণ্ঠে। সামান্য চা, রুটি, দই দিয়েই সজ্জিত ছিল তাঁর সকালের নাস্তা।

ভবিষ্যৎ শঙ্কা

সাত কোটি জনতার অন্নদাতা হিসেবে তখনি বিধৃত মুজিব। সমালোচনার প্রতি উদারনীতিতেও বিশ্বাস করেন বলে জানান। তবে ভবিষ্যতে দেশের চার নীতি: ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের স্বরূপ নিয়ে তর্ক উঠতে পারে; যা দেশের শৈশব সময়ে আভাস করা সহজ নয়।

বাংলাদেশের সাহসী সুহৃদ নাগিসা ওশিমা; Photo:Film Geek

সদ্যপ্রয়াত লেখক-সাংবাদিক নিমাই ভট্টাচার্যের ‘জার্নালিস্টের জার্নাল’ ঘাঁটলে পাওয়া যায় মুজিব শুধু রাজনীতিকই ছিলেন না প্রখর অনুপ্রেরণা দানেও ছিলেন অতুলনীয়। তেয়াত্তরে যখন দিল্লী যান তখন সবল রসিকতায় ‘গোধূলিয়া’ লেখককে উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন,

‘আমরা পলিটিসিয়ান। নানা কারণে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য, কিন্তু আপনারা সাহিত্যিকরা, শিল্পীরা মুক্তমনের মানুষ হন বলেই ইতিহাসের পাতা থেকে পলিটিসিয়ানের নাম মুছে গেলেও আপনাদের কেউ ভোলে না।‘ 

অনুরূপ ক্ষুদ্র প্রয়াসই ওশিমার ‘ রহমান: ফাদার অফ দ্য বেঙ্গল’। চিত্র সমাপ্তিতে উন্নত শির মুজিব মূর্তিতে যেন প্রতিধ্বনিত হয় তাঁরই উক্তি,

‘আমি জনগণকে অসীম ভালোবাসি, তারাও আমাকে এত ভালোবাসে যে আমাকে জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করে।‘‘ 

লেখক- সারাহ তামান্না 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *