বিনোদন

ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (পর্ব: ৮): Panchayat- এক পশলা নির্মলতা1 min read

এপ্রিল ২৭, ২০২০ 5 min read

author:

ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (পর্ব: ৮): Panchayat- এক পশলা নির্মলতা1 min read

Reading Time: 5 minutes

‘আমি ভেবেছিলাম এটা টিভি। মাফ করে দেবেন।‘

সাতসকালে দরজা খুলেই অদ্ভুত চিরকুট পেলেন গ্রাম পঞ্চায়েত সচিব অভিষেক। সামনে ধুলোয় মোড়া মনিটর যা কিনা এর আগের দিনই হাপিশ করে দিয়েছিল কেউ। মানে, চুরি হয়েছিল আর কি!

কপাল কুঁচকে ভাবছেন, এই জমানায় কেউ মনিটর আর টেলিভিশনের তফাৎ জানে না, তা হয় নাকি! একে মূর্খতা বলবেন না সারল্য?

এত ভাবনা বাদ দিন। বলছিলাম ওয়েব প্ল্যাটফর্মে ঝড় তোলা নতুন সিরিজের খণ্ডকথা। স্রেফ প্রাণ উজাড় করে হাসবার জন্য হলেও দেখে ফেলুন অ্যামাজন প্রাইমের নতুন ওয়েব সিরিজ ‘Panchayat’.

গত ৩ এপ্রিল অ্যামাজন প্রাইমের প্লাটফর্মে কমেডি- ড্রামা জনরার ওয়েব সিরিজ ‘Panchayat’ (পঞ্চায়েত) মুক্তি পায়। তবে এর নির্মাণের মূল কুশীলব TVF বা দ্য ভাইরাল ফিভার।

কাহিনী সংক্ষেপ

অভিষেক ত্রিপাঠি, টেনেটুনে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশের হ্যাপাটা কলেজ ছাড়তেই টের পেয়েছে সে। কাছের বন্ধুর পকেটে যখন লাখ টাকার চাকরি, তখন সে প্রায় বেকার। এরই মধ্যে একখানা সরকারি চাকরি মিলে বটে। কিন্তু সে আর দশটা সরকারি চাকরির মতোই মহার্ঘ্য নয়, পদটা প্রত্যন্ত এক গ্রামের পঞ্চায়েত সচিবের।  আর মাসান্তে ২০ হাজার টাকা বেতন।

দাঁতমুখ চেপেই ভারতের উত্তর প্রদেশের ফুলেরা গ্রামে উপস্থিত হতে হলো তাকে। অপরিচিত পথ, শহুরে আমেজ থেকে বিস্তর ব্যবধানের পৃথিবীতে এসে যেন মাথায় বাজই পড়লো অভিষেকের।

অচিরেই আবিষ্কার করলো গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান মঞ্জু দেবীর স্থলে তাঁর স্বামী ভূষণ দুবেই সবের হর্তাকর্তা। তাঁর সব কাজের সাথী হয়ে সর্বদাই সচেতন পেল্লাই সহকারী প্রধান প্রহ্লাদ পাণ্ডে। স্ত্রীর পদে নির্বিঘ্নেই কাজ করে যাচ্ছেন এই ভূষণ সাহেব। গ্রামের সোলার প্যানেল স্থাপনের সিদ্ধান্ত, ভূতের দৌরাত্ম্য, পরিবার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে গ্রামীণ বিয়ের অদ্ভুত রেওয়াজ আর খামখেয়ালিপনার সাথে ধীরে ধীরে পরিচিত হতে থাকে নতুন সচিব অভিষেক।

প্রহ্লাদ- ব্রিজ ভূষণ- যে বন্ধুত্বে বয়স বাধা নয়; Photo: Amazon

পল্লী জন অরণ্য হলে কী হবে, অভিষেকের হৃদয় শূন্যই রয়ে যায় অযুক্তিতে বন্দি গ্রাম ফুলেরায়। বড় চাকরির আশায় প্রস্তুতি নেয় এমবিএর। ওদিকে একাকীত্বের তাড়নায় জীবিকায় অসন্তোষও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে অন্তর্মুখী এই যুবকের ।

শেষমেশ কী ঘটে অভিষেকের বেলায়? ফুলেরার উৎফুল্ল, আন্তরিক পরিবেশে কি সে মিশে যায়? না বিকাশ, ভূষণ, মঞ্জুর ভালোবাসার বন্ধন টুটে চলে আসে পুরনো শহুরে জীবনে?

২৩-৩৫ মিনিট পরিব্যাপ্তির আটটি পর্বের প্রত্যেকটিতেই আছে পরিচ্ছন্নতার ছাপ। রোমহর্ষক গল্পের বদলে চিরাচরিত জীবনযাপনের অনির্বাণ সৌন্দর্যই এর মূল পুঁজি। ‘গ্রাম পঞ্চায়েত ফুলেরা’, ‘ভূতা পেড়’, ‘চাক্কে ওয়ালি কুরসি’, ‘হামারা নেতা ক্যায়সা হো?’, ‘বহুত হুয়া সাম্মান’, ‘লাড়কা তেজ হ্যায় লেকিন…’ এবং ‘জাব জাগো তাবহি সাভেরা’ শিরোনামে দেখা যায় সিরিজের পর্বগুলোকে।

ভারতীয় ওয়েব সিরিজ নিয়ে বাংলাইনফো টিউবের অন্যান্য পর্যালোচনা পড়তে ক্লিক করুন এখানে- INDIAN WEB SERIES

যে জীবন পঞ্চায়েত সচিবের

‘রাত্রি গভীর। একা প্রান্তর বাহিয়া আসিতেছি। জ্যোৎস্না অস্ত গিয়াছে। কোনো দিকে আলো দেখা যায় না, এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা- এ যেন পৃথিবী হইতে জনহীন কোনো গ্রহলোকে নির্বাসিত হইয়াছি।‘

লাইনগুলো বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ থেকে তুলে দিলেও অভিষেকের যাপিত কালের সাথেই মিশিয়ে ফেলা যায়। নির্বান্ধব, একাকী গ্রামীণ জীবনে চার মাসেও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা তরুণ পঞ্চায়েত সচিব তাই ইনস্টাগ্রামে বন্ধুর আনন্দ দেখে দুখী হয়, খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায় নীরবতায়।

সিরিজের প্রথম পর্বেই হতোদ্যম ছিল অভিষেক। তার মনোবল চাঙ্গা করতে চেষ্টাও করেছিল কলেজের বন্ধু। গ্রামের গুণকীর্তনের সাথে সাথে তুলনা দিয়েছিল ‘স্বদেশ’ এর মোহন ভারগভের সাথে। কিন্তু চলচ্চিত্রের ঝকঝকে দুনিয়ায় যেই নায়কের দেখা মেলে, বাস্তবেও কি সে এক?

‘পাশের বাড়ির ছেলে’- তকমাটা যেন জিতেন্দ্র কুমারের বেলাতেই মানানসই; Photo: IMDb

বলিউডের প্রথাবদ্ধ নায়ক চরিত্রের একেবারে বিপরীত অভিষেক। ‘আর্টিকেল ফিফটিন’ বা ‘স্বদেশ’ কোন মাপের সাথেই এই তরুণকে মেলানো যায় না। ভারতের আমজনতার প্রতিভূই এই যুবক, যার স্বপ্ন এক লাফে আকাশ ছুঁয়ে ফেলা নয়, অল্প স্বল্পে জীবিকা আর সম্মান অর্জনই তার লক্ষ্য।

অন্যদিকে পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হলেও মঞ্জু দেবী নিশ্চিন্তে সেই দায়িত্ব ছেড়ে দেন অর্ধাঙ্গ ভূষণের হাতে। এতে জোর জবরদস্তির প্রকট কোন চিহ্ন নেই, নেই ক্ষমতা হরণের কোন চেষ্টাও। গ্রামীণ স্বভাবজাত জীবনের মতোই নারী ঘরের কাজে সুখী, ওদিকে পুরুষ সদস্যটি বাইরের কাজে যেমন পটু তেমনি গৃহিণীর মতামতেও আন্তরিক। সংসারে দম্ভের চেয়ে সৌহার্দ্যই যে বড় কেজো মঞ্জু- ভূষণের রসায়ন তাই জানান দেয়।

চাকা ওয়ালা চেয়ার নিয়ে প্রধান পতির সূক্ষ্ম ঈর্ষার বিষয়টি কোন গুরু আবর্তেই ফেলেননি চিত্রনাট্যকার চন্দন কুমার। বরং ‘দুলহে রাজা’ র হাস্যকর গোসসা দিয়েই আচমকা সমধান করে ফেলেছেন ভারি আবহ। এমনকি গ্রাম্য রাজনীতিকে নোংরামির পর্যায়ে না টেনে তাতে ব্যক্তিগত মানসিকতার বহুরূপেই তুলে ধরেছেন পরিচালক। কুসংস্কার এবং পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানেও দেখা গেছে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি।

সারল্যে সাফল্য

‘ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল

গড়ি তোলে মহাদেশ, সাগর অতল।‘

সিরিজের সাফল্যের মোক্ষম অস্ত্রই এর সামান্যতা। বাগাড়ম্বরের বদলে ছোট ছোট কাহিনীকে উপজীব্য করেই এগিয়েছেন এর নির্মাতা দল। এজন্যই টানা আট পর্ব দেখার পর স্নিগ্ধতার আবেশটাই টানে দর্শককে।

অভিনেত্রী নিনা গুপ্তার আশঙ্কা ছিল, অ্যামাজন প্রাইমের মতো প্ল্যাটফর্মে সহজ-সরল গল্প একেবারে মাঠে মারা যাবে। মঞ্জু দেবীর ভূমিকায় বরাবরের মতোই বলিষ্ঠ পারফরম্যান্স ছিল এই প্রবীণ অভিনেত্রীর। অন্যদিকে ব্রিজ ভূষণ চরিত্রে অভিনয় করা রঘুবীর যাদব প্রথম থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। রাজীব মাসান্দের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তারই প্রকাশ মেলে, ‘এতদিন যাবত কাজ করে এটুকু বুঝেছি, সরলতাই লোকের মন কাড়ে বেশি। আর ‘পঞ্চায়েত’ তো একেবারে সজীব হাওয়ার মতো আরাম দেয়।‘

অভিষেক ত্রিপাঠির চরিত্র রূপদান করেছেন সদ্যই বলিউডে পা রাখা জিতেন্দ্র কুমার। TVF বা দ্য ভাইরাল ফিভার ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে পরিচিত মুখ বেশ কবছর ধরেই। সিরিজের ভাবনা প্রসঙ্গে খানিকটা স্মৃতি হাতড়েই শুরুটা বললেন, ‘২০১৭ সালের দিকে আমাদের সবার মাথাতেই নতুন গল্পের ভাবনা ঘুরছিল। এক আড্ডার বরাতেই মনে হলো, গ্রাম থেকে শহরে আসা যুবকের কাহিনী তো হামেশাই পর্দায় দেখি, কিন্তু শহর থেকে গ্রামে পাড়ি জমালে কী হয়? উলটো ভাবনা থেকেই আসলে এর পথচলা। পরে ২০১৮ সালে চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন চন্দন কুমার।‘

সরল যুবক বিকাশের চরিত্র ছিল জীবন ঘনিষ্ঠ; Photo: IMDb

আট পর্বের সিরিজে আরও দুই চরিত্রের কথা না বললেই নয়। সচিব সহকারী বিকাশ শুক্লা ও সহকারী পঞ্চায়েত সদস্য প্রহ্লাদ পাণ্ডে চরিত্রে যথাক্রমে চন্দন রায় ও ফয়জাল খান অভিনয় করেছেন। বন্ধুর মাধ্যমেই অডিশনে দাঁড়িয়েছিলেন চন্দন। মাত্র আধা ঘণ্টার মাঝেই প্রস্তুতি নিয়েই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয় তাকে। পরবর্তীতে রঘুবীর যাদবের পরামর্শেই বিকাশ চরিত্র মিলে যায়।

অভিনীত চরিত্রকে জ্যাকেটের সাথে তুলনা করতেই ভালোবাসেন চন্দন। নিজের ভাষাতেই চরিত্রের রূপান্তর সম্পর্কে বলেন, ‘বিকাশের চরিত্র পাওয়ার সাথে সাথেই আত্মস্থের প্রক্রিয়ায় নেমে যাই। মনে হচ্ছিল, ওটা একটা জ্যাকেট, যখনই আমি পরবো তখনই বিকাশে রূপান্তরিত হয়ে যাবো; আগের চন্দনের সাথে যার বিন্দুমাত্র মিল নেই।‘

হলদে শেডেই পুরো সিরিজের আলোকসজ্জা করা হয়েছে। যেহেতু আটপৌরে জীবনকে ক্যামেরায় আনাটাই মূল লক্ষ্য ছিল অতএব খুব আড়ম্বরের প্রয়োজন পড়েনি। অমিতাভ সিং এর হাতে তাই পুরো সিনেমাটোগ্রাফির দায় ছেড়ে ছিলেন পরিচালক দীপক।

অনুরাগ সাইকিয়ার সুরায়োজন ছিল গল্পের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ওদিকে প্রিয়দর্শিনী মজুমদারের পোশাক নির্বাচনে বাড়তিপনার চেয়ে পরিপক্বতাই ছিল বেশি।

রঘুবীর- নিনা; দুই তুখোড় অভিনেতার রসায়ন জুগিয়েছে নির্মল আনন্দ; Photo: Amazon Prime

আন্তরিক নির্মাণ

‘গড্ডালিকা-প্রবাহে অর্থাৎ ভিড়ের সঙ্গে মানুষ গা ভাসিয়ে দেয় কেন? তাতে সুবিধে এই- আর পাঁচজনের যা গতি, তোমারও তাই হবে। এবং যেহেতু সংসারের আর পাঁচজন হেসে-খেলে বেঁচে আছে, অতএব তুমিও দিব্য তাদেরই মত সুখে-দুঃখে বেঁচে থাকবে।‘

সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘জলে ডাঙায়’ যেই একপালে হেঁটে চলা লোকের কথা আউড়েছিলেন, তা যেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের রথীমহারথীর বেলাতেও খাটে। নেটফ্লিক্স, হুলু, শো টাইম, ভুট, অ্যাপেল প্লাস- সবখানেই হয় থ্রিলার বা ধুন্ধুমার ড্রামার জয়কার। সেখানে ‘পঞ্চায়েত’ সম্পূর্ণই আলাদা। সরলতাই এর সবচেয়ে বড় শক্তি, সহজবোধ্যতাই এর মাধুর্য।

পুরো সিরিজ পরিচালনা করেছেন দীপক কুমার মিশ্র। দ্য ভাইরাল ফিভার এর সূত্রে তিনিও অপরিচিত নন। এর আগে ‘Permanent Roommates’, ‘Humorously Yours’ দিয়ে ভক্ত সংখ্যা বাড়িয়ে নিয়েছেন তিনি।

সিরিজের শেষ পর্বে পঞ্চায়েত প্রধান মঞ্জু দেবীর আপন দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার দৃশ্য ক্লাইমেক্সে ভরপুর না হয়েও মন কেড়েছে হাজারো দর্শকের। শুধু কর্তব্যনিষ্ঠ প্রধান হিসেবেই নয়, সংসারের অপর সদস্যটিকেও পাশে নিয়ে এগুবার দৃপ্ত বার্তা ছিল এতে। ভারতীয় স্বদেশপ্রেমের সাথে গ্রামীণ জীবনের নিবিড় ঘনিষ্ঠতার ধারণাটা বিস্মিতই করেছে। কন্যা রিংকিকেও দেখা গেছে অল্প কয়েক মুহূর্তের জন্য।

ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেড়ানো নগর জীবন থেকে সামান্য জিরিয়ে নেবার রূপকই যেন এই সিরিজ। এই করোনা কালে ঘরবন্দি জীবনে সম্পর্কের উষ্ণতাই এখন অমূল্য। সে হিসেবে ‘পঞ্চায়েত’ নিবিড়তার অপরূপ প্রতিচ্ছবি। প্রথম কিস্তিতেই বাজিমাত করায় দ্বিতীয় সিজন নিয়েও ভাবছেন এর নির্মাতা দল। তার আগেই নাহয় দেখে নিন আইএমডিবি তে ৮.৯ বাগিয়ে নেয়া এই সিরিজটি।

লেখক- সারাহ তামান্না

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *