ভারতীয় সিরিজ পর্যালোচনা (পর্ব -৯): Breathe: Into the Shadows- অভিষেকের প্রত্যাবর্তন1 min read
Reading Time: 7 minutes‘রামায়ণ মহাকাব্যের নায়ক রামচন্দ্র রাজপুত্ত্বর, ধর্মপরায়ণ, বীর, ধীর, সুসভ্য, সুকান্ত, জ্ঞানী, গুণী ইত্যাদি শত শত গুণাত্মক বিশেষণে ভূষিত। পক্ষান্তরে রাবণ – বিকলাঙ্গ (দশমুণ্ড), স্বৈরাচারী, অসভ্য, রাক্ষস, কামুক ইত্যাদি শত শত দোষাত্মক বিশেষণে দুষ্ট। কিন্তু বাস্তবিকই কি তাই? হয়তো আর্য-ঋষি বাল্মীকি — আর্যপ্রীতি ও অনার্যবিদ্বেষ বশত শ্রীরামকে প্রদীপ্ত ও রাবণকে হীনপ্রভ করার মানসে একের প্রোজ্জ্বল ও অন্যের মসিময় চিত্র অংকিত করেছেন নিপুণ হস্তে রামায়ণের পাতায়। কিন্তু তার তুলির আঁচড়ের ফাঁকে ফাঁকে প্রকাশ পাচ্ছে রাবণের কৌলিন্য, শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের আসল কান্তির ছিটেফেঁটা; যার ঔজ্জ্বল্য রামচরিত্রের উজ্জ্বলতার চেয়ে বহুগুণ বেশী।‘
_রাবণের প্রতিভা –আরজ আলী মাতুব্বর
কালে কালে রাবণকে হীন- নির্দয়- দুশ্চরিত্র প্রমাণে ব্যতিব্যস্ত ছিল কুলীন সম্প্রদায়। মাইকেল মধুসূদন তাঁর ‘মেঘনাদ বধে’ পুরো তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরিয়ে উপস্থাপন করেছেন রাবণ-চরিত্র। বাল্মিকির কথন যাই বলুক না কেন এর পৃথক পৃথক বিবরণে রামকেই চাতুর্য বিশিষ্ট মনে হয়। বরং রামায়ণে রাবণ-নিন্দাকে অধুনাকালের রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার সাথে তুলনা করা ভালো।
দশরথ পুত্রের শত্রুর সাথে আংশিক সাদৃশ্য রেখেই নির্মিত হয়েছে থ্রিলার জনরার সিরিজ ‘ব্রিদ’ এর দ্বিতীয় কিস্তি ‘Breathe:Into The Shadows’। গত ১০ জুলাই অ্যামাজন প্রাইমের প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে বারো পর্বের এই হিন্দি সিরিজ।
কাহিনী সংক্ষেপ
অবিনাশ, আভা আর সিয়া- তিনজনের মিষ্টি চড়ুই ঘর। ছয় বছরের সিয়ার বায়নাক্কা সামলে খুনসুটিতে কেটে যায় শেফ-সাইকিয়াট্রিস্টের সংসার। ষোলোআনা সুখের মাঝেই হুট করে কালো মেঘ এসে নামে। বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠান থেকে লাপাত্তা হয় ছোট্ট সিয়া।
ওদিকে এর কিছুদিন আগেই দিল্লির মেধাবী মেডিকেল ছাত্রী গায়ত্রী মিশ্রও ঘরে ফেরার পথে অপহৃত হয়। দুয়ে দুয়ে চার মেলায় সাইকিয়াট্রিস্ট অবিনাশ, আশঙ্কা করে দুই ঘটনাই এক সূত্রে গাঁথা।
শঙ্কা সত্যের মুখ আর দেখে না। মাস পেরুলেও সন্ধান মেলে না সিয়ার। অবিনাশ-আভার দাম্পত্যের মাঝে দাঁড়ায় গূঢ় হতাশা, সিয়া অপহরণ মামলায় আসে ধীর গতি। ওদিকে মুম্বাই ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে বদলি হয়ে দিল্লিতে আসেন ইনস্পেক্টর কবির সাওয়ান্ত আর সহকারী প্রকাশ কাম্বলে। প্রথম কিস্তিতেই দর্শকের পরিচয় হয়েছিল কবিরের সাথে।
আচমকাই দম্পতির দোরে মেলে সিয়ার অপহরণকারীর ভিডিওবার্তা। সিয়াকে জীবিত জেনে হাঁফ ছাড়লেও দুর্বৃত্তের দাবিতে চমকে ওঠে সাভারওয়াল দম্পতি। সিয়ার প্রাণের বিনিময়ে হত্যা করতে হবে শহরের নির্ঝঞ্ঝাট কিছু লোককে।
একদিকে সন্তান, অন্যদিকে ভয়ংকর মাইন্ড গেমার অপহরণকারী- কী করবে আভা-অবি? মাথা পেতে নেবে সকল খুনে আবদার নাকি পুলিশের শরণাপন্ন হবে? এ যাত্রায় কবিরের ভূমিকাই বা কী?
মাধাবন বনাম অভিষেক
বিশ বছর আগে ‘রিফিউজি’র হাত ধরে অভিষেক বচ্চন বলিউড তলে তাঁবু পেতেছিলেন। ‘গুরু’, ‘যুবা’, ‘সরকার’-এ মেধার সাক্ষর রাখলেও মাঝপথে খেই হারান, সমালোচনাও কম শুনতে হয়নি তখন। ওদিকে ইন্ডাস্ট্রির নির্দয় চেহারা তো সর্বজনবিদিত।
ফের ফেরার ধ্বনি দিয়েছিলেন অনুরাগ কাশ্যপের ‘মানমারজিয়া’ দিয়ে। তবে এর সাথে যুক্ত হলেন নয়া জমানার ওয়েব দুনিয়াতেও। ২০১৮ সালের সফল থ্রিলার ‘Breathe’ এর দ্বিতীয় কিস্তিতে প্রধান চরিত্র রুপায়নে দেখা মিলল তাঁর।
অমৃতসর থেকে ফেরার পথেই পরিচালক মায়াংক শর্মার ফোন পান অভিষেক। প্রথম কিস্তিতে মাধাবন ঊর্ধ্বমুখী একটা গ্রাফ এঁকে দিয়েছিলেন। তাই পোক্ত কাহিনী ছাড়া সাইন করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণই মনে হয়েছিল প্রথমে।
ভুল ভাঙে পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার মায়াংক-বিক্রম তুলির সাথে আলোচনার পর। পৌরাণিক-মনস্তাত্ত্বিক-মহাকাব্যিক আবহের ছাপ আগ্রহী করে তোলে প্রথম সাক্ষাতেই। তবে দোটানা থেকেই যায়- মাধাবনের সাথে টক্করে নামবেন না সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকেই গড়ে তুলবেন নিজেকে?
ছয় সপ্তাহ প্রস্তুতির সময় পেয়েছিলেন অভিষেক। তবে সিরিজের সাফল্যকে পরিচালক ও চিত্রানাট্যকারের কৃতিত্বই দাবি করেন জুনিয়র বচ্চন। ডিটেইলিং আর প্লট নিয়ে মুগ্ধ হলেও দর্শক মাত্রেই বুঝবেন প্রথম সিজনের তুলনায় এর মাত্রাটা স্বল্প।
ফুটবল কোচ ড্যানি মাস্কেরানহাসের ভূমিকায় দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়েছিলেন মাধাবন। একমাত্র সন্তানের সাথে তাঁর রসায়ন আর আকুতিটাও ছিল অনুভবযোগ্য। নাটকীয়তা থাকলেও চরিত্র সম্পাদনে খুঁত রাখেননি।
অভিষেকের দক্ষতাও সেক্ষেত্রে ফেলনা নয়, কিন্তু কন্যার সাথে পিতার স্নেহের যোগাযোগ জ্বলে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি স্ত্রী আভার চরিত্র রুপায়নকারী সহজাত নিথিয়া মেননের সাথেও মিশে যেতে পারেননি।
চেনা প্লট, জানা পরিবেশন
থ্রিলারের মূল দাবিই থাকে ইঁদুর-বিড়াল দৌড়ের রোমাঞ্চ। জমজমাট রুদ্ধশ্বাস রহস্যে মোড়া গল্পের সাথে এগিয়ে যায় এর চরিত্রেরা।
প্রথম সিজনের মূল ন্যারেটিভটাই এসেছিলে ড্যানির (মাধাবন) মাধ্যমে। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের মোটিভের সাথে দর্শকের পরিচিতি ছিল সূচনাতেই, এমনকি তাঁর প্রতি ছিল সহমর্মিতাও। ‘Into the Shadows’ এ এমন দাবি করা যায় না। সাত পর্বের পরেই মেলে টানটান উত্তেজনার আভাস।
জটিল, মনস্তাত্ত্বিক সংকটের সাথে পুরাণের সাদৃশ্য খোঁজার ধারণাটা “অসুর”, “পাতাললোক”-এর পর এখানেও নজরে এসেছে। কিন্তু মিশ্রণে বালি-জলের মতোই বিভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয়। রাবণের দশ অনুভূতি- ক্রোধ, কাম, ভয়, বিশ্বাসঘাতকতা, ভ্রম, অনুরক্তি, অহং, অসংবেদনশিলতা, স্বার্থপরতা এবং গর্বকে অবিনাশের পৃথক ব্যক্তিত্ব ‘জে’র মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন পরিচালক। অভিষেক সচেষ্ট থাকলেও নড়বড়ে লেখনীর তোড়ে ভেসে গেছে মূল আবেদন।
প্রসঙ্গ ক্রমেই দর্শক সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন বেশ কিছু চলচ্চিত্র ও সিরিজের সাথে। ডেভিড ফিঞ্চারের ‘Seven’ এ যেমন সাতখানা পাপের আলোকে খুনে জন ডো আতঙ্কের রাজ্য কায়েম করতে চায়, তেমন উপস্থাপন মেলে এখানেও। এমনকি হালের আরেক ওয়েব সিরিজ ‘অসুর’ এর সাথেও প্রক্রিয়াগত মিল পাওয়া যায়।
মাইকেল সি হল অভিনীত জনপ্রিয় সিরিয়াল কিলিং সিরিজ ‘Dexter’ এর সিজন ৬ এ আবির্ভাব ঘটেছিল মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভোগা ‘ডুমসডে কিলারে’র। ‘Book of Revelation’ এ বর্ণিত সাত ঘটনা সম্পাদনের পর দুনিয়ার ধ্বংস ও স্বর্গের প্রত্যাবর্তনই ছিল লক্ষ্য।
মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার নিয়ে ভুরি ভুরি ছবি আছে। ‘Fight Club’, ‘Sibyl’, ‘Primal Fear’, ‘3 faces of Eve’,’ Identity’- প্রচুর ছবির খোঁজ মেলে হলিউডে। অত পুঙ্খানুপুঙ্খ না হলেও অভিষেক বেশ উতরে গেছেন দ্বিব্যক্তির অভিনয়ে।
তবে ক্লাইম্যাক্সে তাঁর ঘনঘন ব্যক্তিত্ব বদল মোটেও বিশ্বাস্য লাগেনি। মাঝে ‘Raavan’, ‘Paa’ –রেফারেন্সও হাস্যকর ঠেকেছে। অথচ একটু তাকালেই হয়তো ‘Raavan’ সহাভিনেতা চিয়ান বিক্রমের ‘Aparichit’ চোখে পড়তো। জেরার মুখে বিক্রমের তিন তিনটে ব্যক্তিত্বের আনাগোনা নিঃসন্দেহে ভারতীয় ফিল্মিপাড়ার অন্যতম সেরা কাজ।
মনোজ বাজপেয়ীর ‘গালি গুলিয়া’তেও আছে চাইল্ড ট্রমা আর অ্যামনেসিয়ার সুদক্ষ রুপায়নের সন্ধান। সুযোগ থাকলেও এর ধারে যাননি অভিষেক।
প্রথম বলে ছক্কা পেটানোর মতোই পারফরম্যান্স ডেলিভার করেছিলেন অমিত সাধ। ২০১৮ এর প্রথম সিজনে পুলিশ ইনস্পেক্টর কবির সাওয়ান্ত রূপে তাঁর অভিনয় জ্বলজ্বলে হয়ে আছে এখনও। তবে কিছুটা ভিন্নতার দাবি ছিল দ্বিতীয় কিস্তিতে।
অপরাধবোধে বধ কবির নেশায় চূর থাকতেন। এবারের দৃশ্যপট পৃথক, তবে স্পর্শ আছে এক পশলা শ্রাবণের। মেঘনার (প্লাবিতা বোরঠাকুর) পঙ্গুত্বের জন্য নিজেকে দায়ী করলেও এক তুড়িতেই সে ভাবনা উড়িয়ে দেয় সদাহাস্য এই তরুণী।
হৃষীকেশ জোশি ও শ্রীকান্ত ভার্মার প্রকাশ-জয়প্রকাশ জুটি দমবন্ধ পরিস্থিতির মাঝে সজীব হাওয়ার মতোই ছিলেন।
আরও পড়ুন- ভারতীয় ওয়েব সিরিজের অন্যান্য পর্যালোচনা
লুপহোলের সমাহার
‘অসুর’এর ফরেনসিক রিপোর্ট আর কারিগরি অনুষঙ্গের প্রতি অভিযোগ ছিল দর্শকদের। তবে এটাও ঠিক, থ্রিলার ও অভিনয়ের জালে বল জড়াতে পেরেছিল এই ভুট অরিজিনালস সিরিজ। এদিকে মাঠে মারা গেছে ‘ব্রিদ’ এর প্রচেষ্টা। বারবার রাবণকে টেনে একই কথা বোঝানোয় লম্বা হয়েছে সিরিজের পর্ব।
থ্রিলে তো জল ঢেলেছেই সাথে একরাশ ভ্রান্তিও চোখে পড়েছে। যেমন- সিয়ার অপহরণের কিছুদিন পর অস্বাভাবিক শান্ত দেখা যায় সাভারওয়াল দম্পতিকে, মাঝে যে নয় মাস কেটে গেছে বোঝার উপায়ই নেই। দিল্লী ক্রাইম ব্রাঞ্চের সিস্টেম হ্যাক করা যায় মুহূর্তেই, অবিনাশ কবিরের গাড়িতে ওষুধের প্যাকেট ফেলে রাখলেও চোখে পড়ে না কারো, নিজে একটি খুনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার পরেও কীভাবে অপরিচিত শারলিকে গাড়িতে তোলে আভা? নাতাশা হত্যার পুরো প্রক্রিয়াটা এত সহজ কী করে হলো? সবচেয়ে বিস্ময়ের কথা অবিনাশের ধ্বংসাত্মক ডিজঅর্ডার থাকার পরেও নামী সাইকিয়াট্রিস্ট হলো কীভাবে? পুলিশের সাথে কাজ করে অবিনাশ, অথচ তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড তদন্ত করলো না কেউ?
সিনেমাটিক শটে মুনশিয়ানা না দেখালেও এস ভরদ্বাজ বেশ কিছু দৃশ্যে নতুনত্বের চেষ্টা করেছেন; যেমন- চতুর্থ পর্বে মেলায় রাবণ বধের দৃশ্য, সোফায় শোয়া অবস্থায় অবিনাশের আপার শট, অবিনাশ-আভার অসহায়ত্বের চিত্রায়ন ইত্যাদি। তবে কালারাইজেশন ছিল ভয়ানক রকম ক্লান্তিকর। একই প্ল্যাটফর্মের ‘The Family Man’ দেখে যেখানে তৃপ্তি মেলে সেখানে চোখ কুঁচকে আপ্রাণ বোঝার ভার নিতে হয়। গোটা সময়ে মনোযোগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হলেও ক্লিফহ্যাঙ্গার রাখায় অভিযোগের পাল্লা কিছু হালকা হয়।
রাবণ –নায়ক না খলনায়ক?
রাম-রাবণের দ্বৈরথ, সীতা হরণের বিশদ উপমহাদেশে লোকপ্রিয় এক কাহিনী। হিন্দু ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ এই মহাকাব্যের সৃষ্টি সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে, পুরাণমতে ত্রেতা যুগে।
বাল্মিকি রচিত মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ এ লঙ্কা সর্বেশ্বর রাবণকে আগাগোড়া মন্দ হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়নি। উল্টো কিছু দিক থেকে রামের চাইতে রাবণের গুণ সংখ্যাই বেশি। অথচ অতি প্রচারণায় রাবণই হয়ে উঠেছে খলনায়কের সমার্থক।
অথচ রাবণের লঙ্কা কাব্যে-পুরাণে স্বর্ণ নগরী হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। সুশাসক ও ন্যায় ছাড়া নগরের উন্নয়ন যে অসম্ভব তা বলাই বাহুল্য। রাবণ জ্ঞানী হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছে বারবার। লক্ষণকে রাজধর্মের খুঁটিনাটি পরামর্শও দেবার নজিরও আছে।
গুণীর তালিকাতেও রাখা যায় তাকে- বীণা পাণিতে নিলেই নাকি অপার্থিব সুরে মোহিত হতো শ্রোতা। ‘নাড়ি পরীক্ষা’, ‘অর্ক শাস্ত্র’, ‘অর্ক পরীক্ষা’ সহ বিখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্রগ্রন্থের লেখকও মানা হয় লংকারাজকে। জ্যোতির্বিদ্যা ও চার বেদ- ছয় উপনিষদ নখদর্পণে ছিল শূর্পণখা ভ্রাতার।
ব্রাহ্মণ সন্তান কৃষি, রাজনীতিতেও ছিলেন পারদর্শী। জনহিতে তো বটেই দেব আরাধনাতেও ছিলেন তুখোড়, করেছেন ‘শিব তাণ্ডব’ সাস্ত্রের রচনাও।
এই রাবণকে ফের খলনায়ক রূপে উপস্থাপন করতে বসে অহেতুক জল ঘোলা করেছেন মায়াংক শর্মা। ‘পাতাললোকে’ যেমনটি দেখা যায়, সহজ মেটাফোরিক আলাপেই একে সাড়তে পারতেন। সীতা হরণের বদলে সিয়া অপহরণ জমেনি মোটেই। রাবণের শত গুণের মাঝে দশ দৌর্বল্যকে ঘেঁটে দেখাতেও পারেননি গভীরভাবে। অলোকনন্দা দাশগুপ্ত ও করণ কুলকারনির সুরায়োজন ছিল যথেষ্ট।
লাইমলাইটে অমিত
তবে মন্দেরও ভালো আছে। অমিত সাধ, সায়ামি খের আর নিথিয়া মেননের অভিনয় মনে রাখার মতো। অভিষেকের তুলনায় কম স্ক্রিন টাইম পেলেও তাতেই মন জিতে নিয়েছেন এই তিন অভিনেতা। প্রথম সিজনে তো শার্টে ওয়াইন ছিটিয়ে সেটে আসতেন অমিত!
কাম্বলের পুরনো বন্ধুর সাথে মোলাকাত, মেঘনার নাগরদোলার শট, আভা-কবিরের শীতল তর্ক, শারলির বুনো সৌন্দর্য- পুষিয়ে দিয়েছে অনেক ক্ষতিই। গায়ত্রী চরিত্রে রেশাম শ্রীবর্ধন ও সিয়া চরিত্রে ইভানা কৌরের সজল-স্বাচ্ছন্দ্য অভিনয় ব্রি লারসনের ‘Room’ এর কথা ভাবায়।
দেরিতে হলেও পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন অমিত। এই সিজনে তাঁর শারীরিক পরিবর্তনও চমৎকৃত করেছে অডিয়েন্সকে।সংলাপের চাইতে তাঁর নীরব শারীরিক ভঙ্গিমাই দৃশ্যপটকে নিখুঁত করেছে।
দীর্ঘ সময় ইন্ডাস্ট্রির ঘাত-প্রতিঘাতের পর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেনি অমিতের। চেষ্টা চালিয়ে গেছেন নিরন্তর। এক সময় দারোয়ানের কাজ করেছেন, ফুটপাতেও থেকেছেন বছর দুই। কঠিন বাস্তবের আলোকেই তাই ইন্ডাস্ট্রিকে সামান্য উদার হতেও তাগাদা দেন এই তরুণ প্রতিভা।
‘সন্তানের মঙ্গলের জন্য খুন ন্যায় না অন্যায়, কেউ বলতে পারে না।‘
গোটা সিরিজের সারাংশই বলে দেয় এই সংলাপ। দুর্নিবার থ্রিলের সাথে যোগ না করতে পারলেও একেবারে নিরাশ করেনি ব্রিদ কিস্তি। অভিষেকের ডাবল পারসোনালিটি, শৈশবের ট্রমা, পারিবারিক সহিংসতা ও নিপীড়নের উপস্থাপন বেশ গাঢ় প্রভাব রাখতে বাধ্য। শেষ দৃশ্যেও দারুণ ক্লিফহ্যাঙ্গার দিয়ে উদগ্রীব করেছে দর্শককে। পরবর্তী সিজনে আভার স্থলে শারলি যে গুরুত্ব পাবে এবং রাবণ রূপী ‘জে’ই যে প্রকট খুনী হিসেবে আবির্ভূত হবে- চোখ বুজে বলা যায়। সেজন্য ব্রিদপ্রেমিরা কিছুদিন অপেক্ষা করতেই পারেন।
দীর্ঘ স্ক্রিন টাইমের পরেও ডিটেলিং এ আলোকপাত না করার পুরো দায় বর্তে লিখিয়েদের ঘাড়েই। উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের ফলে তাই নির্মাতাদের উপর পাথরের ভার চাপে। পূর্ণেন্দু পত্রী ‘সাহিত্য ও সিনেমা’য় তাই যথার্থই বলেছেন,
‘নির্মাতার ঘাড়ে চাপ পড়লেও ডিটেলকে এড়িয়ে গেলে চরিত্রদের আভ্যন্তরীণ মনোভঙ্গি বা সাইকোলজির উন্মোচন অসমাপ্ত ও অসম্পূর্ণ থেকে যেতে বাধ্য। সুতরাং সুরাহা সৃষ্টির বদলে নিয়ে আসছে এক ধরণের দুরূহ চ্যালেঞ্জ।‘
লেখক- সারাহ তামান্না