দশক সেরা দশ কোরিয়ান সিনেমা- পর্ব ১1 min read
Reading Time: 6 minutes‘আমাদের একে অপরকে বুঝতে হলে আগে অনুভূতিদের বোঝা দরকার। ফিল্ম আমাদের জন্য অনুভূতির প্রকাশ মাধ্যম। আমাদের নিজস্ব কিছু আবেগ আছে। এই ছবিগুলো দেখলে বুঝবেন আমরা কখন কাঁদি, কখন হেসে কুটিকুটি হই, কখন নৈরাশ্যের অতলে হারিয়ে যাই।‘
বাংলাদেশে নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি জ্যাং-কিউনের বক্তৃতার মাঝে হারিয়ে যাই আরেক স্মৃতিতে। শাহাদুজ্জামানের কয়েকটি বিহ্বল গল্প’এর উৎসর্গ পাতার কয়েক ছত্র বলে,
‘যে আমার নীরবতা বোঝে না, সে আমার ভাষাও বুঝবে না।‘
অন্তর্জালের কল্যাণে ভিনদেশি সংস্কৃতির সাথে আমাদের নিত্য আনাগোনা। ‘জাত গেল, জাত গেল’ রব যে গোঁড়ামিরই নামান্তর তা জেনে গেছে প্রজন্ম। বিশ্বের প্রতিটি মানুষের অন্তরের আকুতি, আনন্দের কারণ, ইতিহাসের আঘাত জানার জন্য ফিল্ম ক্রমেই সর্বজনীন মাধ্যমে পরিণত হচ্ছে।
কোরিয়ান ফিল্মের ভক্ত সংখ্যা গত কয় বছরে হুহু করেই বেড়েছে। তাদের কথা ভেবেই কোরিয়ান ম্যাগাজিন Cine 21 জানুয়ারিতে প্রকাশ করে গত দশকের সেরা দশ কোরিয়ান সিনেমার তালিকা।
আজ সেই তালিকার প্রথম পাঁচের কথা চলুন শুনি।
১। Parasite (২০১৯)
বছরের শুরু থেকেই ‘Parasite’ বন্দনায় মুখর মিডিয়া। কানে পাম ডি’অর জেতার পর বোদ্ধা থেকে আটপৌরে দর্শক সবারই চোখ পড়ে বং জুন-হোর এই শিল্পীত স্যাটায়ারের ওপর। অবশ্য কোরিয়ান চলচ্চিত্রের খবর যারা কমবেশি রাখতেন তাদের কাছে এই চমক নতুন কিছু নয়।
কাহিনী সংক্ষেপ: পার্ক এবং কিম- সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুই পরিবার। সমাজের উপরতলা ও একেবারে দারিদ্র্য রেখার নিচে দাঁড়ানো একদল মানুষের গল্প নিয়েই এগিয়ে চলে ছবিটি। দরিদ্র কিম পরিবারের প্রত্যেক সদস্য যখন একে একে জায়গা করে নেয় পার্কদের ঘরে, তখনই দর্শকের মনে প্রশ্ন ওঠে ‘তবে কি কিমরাই পরজীবী?’ ‘দারিদ্র্যের নিপীড়নে কি এদের মৃত্যু হবে নাকি নিরন্তর পার্কদের খুন চুষে যাবে এরা?’
চলচ্চিত্র শেষে আশার বাণী শোনা যায় কিমের কণ্ঠে, একদিন ঠিক টাকা জমিয়ে বাবাকে মুক্ত করবে পরজীবী জীবন থেকে। কিন্তু বাস্তবিকেই কি দরিদ্ররাই পরজীবী? ধনতন্ত্রের করাল গ্রাসে সত্যিকার অর্থে পরাধীন কারা?
অস্কার ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোরিয়ান সিনেমা হিসেবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায় এটি। এছাড়াও শ্রেষ্ঠ পরিচালক, অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লে, শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক ফিচার ফিল্মের ক্যাটাগরিতেও একাডেমীর স্বর্ণমূর্তি জিতে নেয়। অন্যদিকে গত বাফটা, গোল্ডেন গ্লোবেও ছিল এর জয়জয়কার।
শুধু গল্পের গাঁথুনি বা ডার্ক কমেডির জন্য নয়, এর শৈল্পিক নির্মাণও একে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। দুই পরিবারের সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে পৃথককারী রেখার ব্যবহার, মন্তাজের মাধ্যমে দীর্ঘ গল্প সংক্ষেপে প্রকাশ, কোরিয়ার আর্থ সামাজিক বলয়ের বিধ্বস্ত অবস্থা সমস্তটাই উঠে এসেছে নান্দনিকভাবে।
মজার ব্যাপার হলো, সিনেমায় পার্ক দম্পতির বাড়ি কিন্তু পুরোটাই ছিল হাতেগড়া সেট। এমনকি এর বাগান ও প্রথম তলাও ভিএফএক্স নির্মিত। এতে অভিনয় করেছেন সং কাং-হো, লি সান-কিউন, চো ইও-জিং, পার্ক সো-দাম, চোই উ-শিক প্রমুখ। ১১.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে নির্মিত ‘প্যারাসাইট’ সাকুল্যে আয় করেছে ২৬৫ মিলিয়ন!
২। Poetry (২০১০)
‘কবিতার লক্ষ্য তো জীবনের সৌন্দর্য খোঁজা, তাই না?’
কবিতা মুখস্ত কইতে না পারলে নাকি এর প্রতি যথাযথ ভালোবাসার প্রকাশ হয় না। কিন্তু কবিতা কি তবে শুধু প্রেম প্রকাশেরই, আত্মোপলব্ধির নয়? ধরুন, সারাদিন চেষ্টা করেও জীবনানন্দের ‘স্থবির- যৌবন’ এর আটাশ লাইনের একটাও মনে থাকছে না। মিনিট দুই পরেই মস্তিষ্কের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাচ্ছে সব। আপনার হৃদয়ে কাব্যের প্রচণ্ড তোলপাড় অথচ বারবার ভুলে যাচ্ছেন অক্ষর অথবা মাত্রাবৃত্তের বাঁধন। সে এক প্রলয়ঙ্করী সংকট!
কাহিনী সংক্ষেপ: ষাট বছর বয়সী মি-জার আচমকাই মনে হলো সে কবিতা লিখবে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোন ধারণাই তাঁর নেই, এমনকি বিদ্যালয়ের চৌহদ্দিও সেই চার দশকেরও আগে ছাড়িয়ে এসেছেন। অগত্যা ভর্তি হলেন এক কবিতা শেখার আসরে, শিখতে থাকলেন ছন্দ-শব্দের দুর্গম দুর্গ।
‘কবিতার জন্য পর্যবেক্ষণ’- কবিতা শিক্ষক সামান্য একটা আপেলকে গতানুগতিক ধারা থেকে সরে দেখতে বলেছিলেন। সেই অভ্যাস ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বর্ষীয়ান মি-জার মধ্যেও। সামান্য বৃক্ষ, নদী, পিচ ফল ক্রমান্বয়ে বিষাদ বিধুর করে তোলে তাঁকে। ওদিকে ষোড়শ বয়সী নাতি জং-উকের দেখাশোনার দায়িত্বও কাঁধে।
আলঝেইমারের গ্রাস, উকের ধর্ষণ ও অন্যান্য কুকীর্তি সম্মুখে এসে দাঁড়ায় সরল মি-জার জীবনে। অভিজ্ঞতা ও ক্ষমা দিয়ে সমস্তটা বুঝতে চায় সে। জটিলতার মাঝে তাঁর একমাত্র মুক্তি হয়ে দাঁড়ায় কবিতার পঙক্তিমালা।
পরিচালক লি চ্যাং-দংয়ের ‘Poetry’ স্নিগ্ধ বিন্যাসে এক বিদ্রোহের নাম। ‘বর্তমান সময়ে কবিতা মৃতপ্রায়‘- ঠিক এই ভাবনাই তাড়িত করেছিল নির্মাণে। তবে এর পেছনে দক্ষিণ কোরিয়ায় এক স্কুলগামী ছাত্রীর গণ ধর্ষণের ঘটনাই প্রাথমিক মদদ যোগায়। জগতের সবচেয়ে সুন্দর শিল্প কাব্য ও এর বিপরীত ধর্ষণকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলেন ঝটপট।
ফিল্মের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন খ্যাতনামা ইয়ুন জিয়ং-হি। ১৫ বছর পর অভিনয়ে ফিরে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ইয়ুন হি। ফলাফল, কান, গ্র্যান্ড বেল,ব্লু ড্রাগনসহ বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার জয় করে এটি।
৩। The Handmaiden(২০১৬)
পার্ক চ্যান-উক মানেই চোখ ধাঁধানো ফিল্মোগ্রাফি, বিশুদ্ধ অথচ জটিল সংলাপের বাতাবরণ আর… আর সিনেমার শেষ দৃশ্যপটে চমকে দেয়া কোন টুইস্ট।
যৌনতা নিয়ে বাড়াবাড়ি মানেই শিল্প নয়, বরং প্রয়োজনীয় যৌন আবেদনের সাথে কাহিনীর উপযোগী সংমিশ্রণই সফল চলচ্চিত্রের লক্ষণ। ‘The Handmaiden’ এর বেলায় ষোল আনা একথা খাটে। কেননা, চ্যান-উকের শ্রেষ্ঠ সম্পদই হলো বলিষ্ঠ গল্প। ওয়েলশ লেখিকা সারাহ ওয়াটার্সের ‘Fingersmith’ (২০০২) উপন্যাসের আলোকে নির্মিত হয় ‘দ্য হ্যান্ডমেইডেন’।
মূল উপন্যাসের পটভূমি বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক লন্ডন হলেও চ্যান-উক তা বদলে নিয়ে আসেন ১৯৩০ এর দক্ষিণ কোরিয়ায়। প্রেক্ষাপট বদলালেও মূল গল্পের আবেদন থেকে একটুও সরে আসেননি পরিচালক।
কাহিনী সংক্ষেপ: কোরিয়া তখন জাপানি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। সেই সাম্রাজ্যেই লেডি হিদেকো উত্তরাধিকারসূত্রে বিশাল সম্পত্তির মালিক। সুশীল, সুন্দরী লেডির পাহাড় প্রমাণ সম্পদের উপর নজর পড়ে ঠগ ফুজিওয়ারার। কৌশলে তাঁকে বিয়ে করে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত প্রমাণের ছকও কাটে সে।
একক কৌশলে জয় কতদূর! তাই সুক-হি নাম্নী আরেক ঠগের সাথে পরিকল্পনা করে এগুতে থাকে ফুজি। সুক-হিকে নিযুক্ত করে হিদেকোর পরিচারিকা হিসেবে। শেষ অব্দি কি সফল হয় ফুজিওয়ারা? নাকি নিজেই জালে বন্দি হয়?
কিম মিন-হি, কিম তায়েরি, হা জুং-উ অভিনীত ছবিটির বিশ্বব্যাপী আয় ৪০ মিলিয়ন ডলার। ৭১তম ব্রিটিশ ফিল্ম একাডেমী এ্যাওয়ার্ডে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের পুরস্কারও জয় করে এটি। সুক হি চরিত্রের জন্য ১৫০০ নতুন মুখের মধ্য থেকে বেছে নেয়া হয় কিম তায়েরিকে।
৪। Right Now, Wrong Then
হং স্যাং-সুর দাবি- তিনি বড্ড অলস। মূল ফিল্মের মাত্র বিশ ভাগ ভেবে কাজে নেমে পড়েন। এরপর ধীরে সুস্থে, আড্ডায়, খানাপিনায় এগিয়ে যায় গোটা টিম। সিনেমাটা তাই একমাত্র নিজের করে ভাবতে পারেন না ‘Right Now, Wrong Then’ নির্মাতা।
কাহিনী সংক্ষেপ: সিনেমার প্রচারণায় সুওনে (দক্ষিণ কোরিয়ার একটি শহর) আসেন মধ্যবয়সী পরিচালক হ্যাম চুন-সু। ব্যস্ততার ফেরেই দুদিনের বেশি হাতে সময় নেই তাঁর। একেবারে আনকোরা শহরের জন্য হাতে স্বল্প সময় নিয়েই বেরিয়ে পড়ে সে। ঘটনাচক্রে পরিচয় ঘটে তরুণী ইয়ন হি-জাংয়ের সাথে, আড্ডায়- উষ্ণতায় কেটে যায় দুজনের একটি দিন। কিন্তু এর পর কী হবে?
অপরিচিত আন্তরিকতার মাঝেই অমোঘ এক আকর্ষণ লুকিয়ে থাকে। ‘Right Now, Wrong Then’ সেই অনুভবকেই আরও জাগিয়ে তোলে। ডাবল টেকে তৈরি ফিল্মটিতে একই চরিত্রের দুইরকম পরিস্থিতি দেখানো হয়। এক পরত কিছুটা কর্কশ, অন্য পর্ব সন্দেশ মিষ্টি। দর্শক কোনটাকে ভালোবাসবেন তা সম্পূর্ণই তাদের স্বাধীনতা।
ছবির প্রধান দুই চরিত্রে দেখা যায় কিম মিন-হি এবং জুং জা-ইয়ংকে।
৫। The Truth Beneath (২০১৬)
থ্রিলার প্রেমীরা এবার একটু নড়েচড়ে বসতে পারেন। তালিকার পঞ্চম চলচ্চিত্রর চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব বর্তেছিল পার্ক চ্যান-উকের ওপর। অতএব অনাকাঙ্ক্ষিত চটকের প্রতীক্ষা অবশ্যম্ভাবী।
কাহিনী সংক্ষেপ: সপ্তাহ খানেক বাদেই নির্বাচন। প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তরুণ রাজনীতিক জং-চ্যান, সাথে পাচ্ছেন সহধর্মিণী কিম ইয়েনের সর্বাত্মক সহযোগিতা। কাজের ভিড়েও স্বাচ্ছন্দ্যে এগুচ্ছিল সব।
সাফল্য যখন সুনিশ্চিত তখনই ঘটে বিপত্তি। রাজনীতিক দম্পতির একমাত্র কন্যা অপহৃত হয় স্কুল থেকে ফেরার পথে। প্রশাসনিক তদন্তের বিস্তর সময়ক্ষেপণের পরে অবশেষে মেলে লাশ। কিন্তু এই খুনের মোটিভ কী? রাজনৈতিক না ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে নারকীয় এই ঘটনার সূত্রপাত?
পুলিশ যখন হাল ছেড়ে দেয় তখনই তদন্তে নামে মা কিম। ভয়ানক এক সত্যের সম্মুখীন হয় সে; যে সত্য পলকেই ভূপাতিত করে দেয় সমস্ত বিশ্বাসের পর্বত।
২০১৬ সালের বুসান ফিল্ম ক্রিটিকস এ্যাওয়ার্ডে সেরা অভিনেত্রীর সম্মানে ভূষিত হন প্রতিভাবান সো ইয়ে-জিন।পরিচালক লি কিয়ং-মিও তাঁর দ্বিতীয় নির্মাণের জন্য দেশেবিদেশে বিপুল প্রশংসা পান।
দীর্ঘকাল জাপানের উপনিবেশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে দুই কোরিয়া। রক্ষণশীলতার চাপে উত্তর কোরিয়ায় সেভাবে সিনেমার বিকাশ ঘটেনি, সাংস্কৃতিক লেনদেনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে জটিল ও অসম্ভবপ্রায়। সেই বৈতরণীর চাপ দক্ষিণে এখন নেই। কিন্তু ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য পিষে যাচ্ছে এর জনতাকে। সেই জনতার বুদ্ধিবৃত্তি, বার্তা ও মেধার স্ফুরণই ঘটে কোরিয়ান ছবিগুলোয়।
লেখক- সারাহ তামান্না
আরও পড়ুন- দশক সেরা দশ কোরিয়ান সিনেমা- পর্ব ২