সুশান্ত সিংয়ের মৃত্যু: বলিউড নেপোটিজমের মুখোশ উন্মোচন1 min read
Reading Time: 8 minutesচাঁদে জমি কিনেছিলেন উনিশের জুনে, তখন কে জানতো ওই মহাকাশের শুন্যতাতেই এত দ্রুত ঘর পাতবেন সুশান্ত সিং রাজপুত!
গত ১৪ জুন মুম্বাইয়ে সুশান্তের বান্দ্রার ডুপ্লেক্স বাড়ি ‘ম ব্ল’ থেকে তার ফ্যানে ঝোলানো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এখন অব্দি ধারণা করা হচ্ছে এটি আত্মহত্যার ঘটনা। মানসিক বিষণ্ণতাকে দায়ী করলেও অধিকাংশেরই মতামত, নিষ্ঠুর বলিউড সংস্কৃতিই কেড়ে নিয়েছে এই সজীব, মেধাবী অভিনেতার প্রাণ।
বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। বলিউডের ঝলমলে দুনিয়ায় থেকেও কমেনি বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা। ছবির প্রয়োজনেই ২০১৮ তে নাসায় গিয়েছিলেন সুশান্ত। International Lunar Land Registration এর সদস্য হিসেবে ছিলেন প্রায় ৫ বছর। একমাত্র ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে কিনেছিলেন চাঁদের এক টুকরো জমিও।
চাঁদের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক অর্থাৎ ‘মেয়ার মাস্কোভিয়েন্স’ বা ‘সি অফ মাস্কোভি’ এর জমি কিনে আগস্টে নিজের ইনস্টাগ্রামে পোস্টে লিখেছিলেন ,
‘The My side of Moon.’
প্রকৌশল থেকে অভিনয়ে
কৃষ্ণ কুমার সিং ও ঊষা সিং এর ঘর আলো করে ১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারি পাটনায় জন্ম নেন সুশান্ত সিং রাজপুত। ২০০২ সালে মায়ের মৃত্যুর পর দিল্লিতে সপরিবারে চলে আসেন। মায়ের আকস্মিক বিদায়ই পরবর্তীতে বিশাল প্রভাব ফেলে তাঁর জীবনে।
২০০৩ সালে All India Engineering Entrance Exam এ দশ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে সপ্তম স্থান অধিকার করেছিলেন। ফিজিক্স অলিম্পিয়াডও জিতেছিলেন। দিল্লি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময়েই নাচ শেখেন। অ্যালান আমিনের কাছে মার্শাল আর্টেও হাত পাকান। ব্যারি জোনসের ড্রামা স্কুলে থাকতেই টের পান অভিনয়ই তাঁকে বেশি টানছে। ফিল্মফেয়ার ও কমনঅয়েলথের অনুষ্ঠানে ব্যাকগ্রাউন্ডে নাচার সুযোগ উসকে দেয় আগুন।
তাই চতুর্থ বর্ষেই ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে দেন পুরোদস্তুর। ২০০৬ সালে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান ফিল্মি দুনিয়ার স্বপ্ন নিয়ে। নাদিরা বাবরের ‘একজুটে’ নাট্যদলের সাথে মঞ্চে নিয়মিত কাজ করতে করতেই বালাজিতে ডাক পান। এর মধ্যে নেসলে মাঞ্চের ‘মাঞ্চিফিকেশন’ বিজ্ঞাপনের বদৌলতে ভারতে পরিচিত মুখও হয়ে উঠেছেন।
’০৮ এ ‘কিস দেশ মে হ্যায় মেরা দিল’ দিয়ে টেলি দুনিয়ার যাত্রা শুরু হয়। অল্প সময়েই প্রতিভা গুণে ভালোবাসা পান সিরিয়াল প্রেমিদের। তবে মূল লাইমলাইট পড়ে ২০০৯ এর জি টিভির ‘পবিত্র রিশতা’র মানব দেশমুখের চরিত্রে। হার্টথ্রবের তকমা এসে যায় অচিরেই।
‘জারা নাচকে দিখা’ রিয়েলিটি শোয়ে তাঁর জবরদস্ত দক্ষতা বিস্মিত করে অনেকেই। তখন থেকেই বলিউডের দিকে প্রগাঢ়ভাবে ঝুঁকে পড়েন সুশান্ত। ফলাফল, ২০১১ সালে টেলি দুনিয়াকে বিদায় জানিয়ে নেমে পড়েন সংগ্রামের মাঠে। এবার লক্ষ্য বলিউড।
বলিউডে নতুন আলোড়ন
বলিউডে বিগ ব্রেক না মিললেও মেধার সাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন প্রথম ছবিতেই। অমিত সাধ, রাজকুমার রাওয়ের সাথে চেতন ভগতের জনপ্রিয় উপন্যাস “Three Mistakes of My Life” এর রিল প্রকাশ ‘কাই পো চে’ তে আবির্ভাব ঘটে তাঁর। ২০১৩ সালের অন্যতম সেরা এই ছবির পরিচালক ছিলেন অভিষেক কাপুর। চেতন ভগত সে সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন, ‘সারাদিন কাজের পর সন্ধ্যায় সবাই বিশ্রাম নিতো বা টিভি দেখতো। কিন্তু সুশান্ত ঠিকই জিমে নিজেকে শানিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাতো।‘
এরপরেই যশরাজ ফিল্মসের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন এই তরুণ তুর্কী। পরিণীতি চোপড়া আর বাণী কাপুরের সাথে জুটি বেঁধে ‘শুদ্ধ দেশি রোমান্স’ এও সহজাত অভিনয় দিয়ে অকূল প্রশংসা পান। আমির খান-আনুস্কা শর্মার ‘পিকে’তে ছোট চরিত্র ‘সরফরাজ’ও তাঁকে এগিয়ে দিয়েছিল চার কদম।
রাজকুমার হিরানির পর দিবাকর ব্যানার্জির ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সি’তে তুখোড় অভিনয় করলেও সফল হয়নি ছবিটি।
তবে মেধার যথার্থ মূল্যায়ন পান মহেন্দ্র সিং ধোনির বায়োপিক ‘এম এস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’র জমকালো সাফল্যে। এই ছবিই রাতারাতি তারকা বানিয়ে দেয় তাঁকে। ধোনির ফ্রেম টু ফ্রেম অনুকরণ শুধুমাত্র এই বিহারি পুত্রের পক্ষেই সম্ভব বলে মানেন অনেকেই। ধোনিও স্মৃতিচারণে সুশান্তের কৌতূহলী স্বভাবকেই শক্তি হিসেবে মানেন, ‘ও সারাদিন আমার কাজ, জীবন নিয়ে এত প্রশ্ন করতো একটা সময় বিরক্ত হয়ে ধমকও দিয়েছিলাম। উত্তরে ও বলল, পর্দায় আমাকে নয় আপনাকেই খুঁজবে ভক্তরা, তাদের ঠকাই কী করে বলুন?’
এই ছবির জন্য দিনরাত ক্রিকেট চর্চাও করতেন। এমনকি ক্রিকেট ঈশ্বর শচিনও তাঁকে ব্যাটিং করতে দেখে পেশাদার ক্রিকেটার ভেবে বসেছিলেন।
মেধাই যখন শত্রু
বিজ্ঞান, গণিত আর অভিনয়- এই তিনেই ভুবন ভরেছিল সুশান্তের।
মেকানিক্যালের মাঠ ছাড়লেও পদার্থবিজ্ঞান আর গণিতের প্রতি প্রেম ছিল অটুট। অন্দরমহলে Meade 14 LX600 telescope দিয়ে প্রায়ই অনুসরণ করতেন শনির বলয়কে। নানা বিষয়ে পড়াশোনাতেও ছিল বিপুল আগ্রহ। জৌলুসের বদলে জ্ঞানেই ঠাসা ছিল বইয়ের সেলফ।
তাঁর জীবনে প্রথম বসন্ত নিয়ে আসেন ‘পবিত্র রিশতা’র সহ অভিনেত্রী অঙ্কিতা লোখান্ডে। ৬ বছর তুমুল প্রেমের পর ২০১৬ সালে ভেঙে যায় সম্পর্ক। সম্প্রতি দুজনের বন্ধু সন্দীপ সিং প্রকাশ করেন অঙ্কিতার নেমপ্লেটে এখনো শোভা পাচ্ছে প্রাক্তনের নাম।
মিডিয়ার তোপ তখন পড়েছিল সুশান্তের ঘাড়ে। যদিও তিনি বরাবরই নিজেদের ভিন্নভাবে বেড়ে ওঠাকে নির্দেশ করেছিলেন। অঙ্কিতাকে ভিক্টিম দেখিয়ে ক্রমাগত মিথ্যে খবর প্রচার করতে থাকে মিডিয়া। যার প্রভাবে কৃতি শ্যাননের সাথে ‘রাবতা’র কপাল পোড়ে। কিন্তু এর পেছনের মূল কারণ ছিল যশরাজ ফিল্মসের চুক্তিপত্র।
চুক্তি অনুসারে যশরাজের সাথে তিনটি ছবি করার কথা তাঁর। ‘শুদ্ধ দেশি রোমান্স’, ‘‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সি’র পর আদিত্য চোপড়া প্রস্তাব দিয়েছিলেন ‘বেফিকরে’র। চিত্রনাট্য পছন্দ না হওয়ায় ফিরিয়ে দিতেই ক্ষেপে ওঠে প্রযোজনা শিবির। চুক্তির নামে আটকে রাখেন তাঁকে। অন্যদিকে ‘রামলীলা’, ‘ফিতুর’এর মতো নন্দিত-বিগ বাজেট ছবি হাতছাড়া করতে বাধ্য হন ছোট শহরের এই যুবা।
শেষমেশ শেখর কাপুরের ‘পানি’ দিয়েই চুক্তি খতম হতে পারতো। দুই বছর খেটেছিলেন উদয়াস্ত। কিন্তু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান যশরাজ ফিল্মস সরে আসে প্রযোজনা থেকে। ফলে গত ছয় মাসের মধ্যে সাতটি ছবি হাতছাড়া হয় সুশান্তের। অথচ চুক্তি সত্ত্বেও রণবীর সিং একাধিক অন্য ছবিতে অভিনয়ের অনুমতি পান। করণ জোহরের প্রযোজনায় ‘ড্রাইভ’ ছবি নিয়ে দ্বৈরথ ছিল, তাঁকে না জানিয়েই নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছিল এটি।
২০১৮ সালে সাড়া আলী খানের সাথে ‘কেদারনাথ’ এ সমালোচকের স্তুতি পেলেও বক্স অফিসকে টলাতে পারেনি। ২০১৯ সালে তিনটি ছবি মুক্তি পায় যার মধ্যে ‘ছিছোড়ে’ ও ‘সোঞ্চিড়িয়া’ এর সুবাদে আবার উত্থানের স্বপ্নে বিভোর হন সুশান্ত। যদিও বিগ বাজেটের ছবির তলে চাপা পড়ে যায় এদের সাফল্য। কাকতালীয়ভাবে ‘ছিছোড়ে’র মূলবার্তাই ছিল আত্মহত্যার বিরুদ্ধে। ২১৫ কোটি টাকার ব্যবসা করে শ্রদ্ধা কাপুর, প্রতীক বাবর, বরুণ শর্মার সাথে স্ক্রিন ভাগ করে নেয়া এই ছবি।
নেপোটিজমের বলি
সুশান্তকে নেপোটিজমের বলি বলেই ধরে নিচ্ছেন অনেকে। করণ জোহরের ধর্ম প্রোডাকশন, যশরাজ ফিল্মস, সালমান খান, ভাট শিবিরের দিকে আঙুল তুলছেন সমালোচক-দর্শকরা।
তারকা সন্তানদের নিয়ে ছবি করায় অভ্যস্ত করণ। তার হাত ধরেই আলিয়া ভাট, বরুণ ধাওয়ান, অনন্যা পাণ্ডে, টাইগার শ্রফরা রাজত্ব করছেন বলিউডে। ফ্লপ, বুদ্ধিহীন কিছু ছবি সত্ত্বেও তাদের ক্যারিয়ার গ্রাফ উপরে রাখতেই তৎপর মিডিয়া।
অন্যদিকে ‘রাবতা’র পতনের সাথে সাথে সুশান্তকে বাতিলের খাতায় ফেলতে ব্যস্ত হয়েছিল ‘ব্লাইন্ড আইটেম’ তৈরিতে সিদ্ধহস্ত সাংবাদিকেরা।
পরিচালক শেখর কাপুর লিখেছেন, ”আমি জানতাম তুমি কী যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছো। আমি সেই খারাপ মানুষগুলির কথা জানতাম, যাঁরা তোমায় টেনে নিচে নামাতে চেয়েছিল। তুমি আমার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে পারতে। গত ৬ মাস যদি তোমার সঙ্গে থাকতাম, তাহলে খুব ভালো হতো। যা ঘটেছে, সেটা তোমার কর্মফল নয়। ”
তবে সুশান্তই তো প্রথম এর শিকার নন, তিন দশক ধরে বলিউডে স্বজনপোষণের ঝাণ্ডার আঘাতে ক্যারিয়ার হারিয়েছেন বহু প্রতিভাবানই। বিবেক ওবেরয়, গোবিন্দ, ঐশ্বরিয়া রাই, জিয়া খান, আফতাব শিবাদাসানি ক্যারিয়ারের আলোকোজ্জ্বল সময়েই হারিয়ে গেছেন বলিউড রাজনীতির তোপে।
আয়ুষ্মানের কথাই ধরুন। ২০১৫ সালে নিজের লেখা বই ‘ক্র্যাকিং দা কোড: মাই জার্নি ইন বলিউড’এ প্রত্যাখ্যানের নিয়ম নিয়ে সোজাসাপ্টা সামনে এসেছেন তিনি। আয়ুষ্মান লিখেছেন, ‘ঘটনাটা ২০০৭ সালের। রেডিও জকি হিসাবে কাজ করার সময় একবার করণ জোহরের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখনই করণকে অভিনয়ের ইচ্ছার কথা জানাই। করণ নিজেই তাঁর প্রযোজনা সংস্থার অফিসের ল্যান্ডলাইন নম্বর দেন। উৎসাহের বশে সেই নম্বরেই তিনবার ফোন করেন। প্রতিবারই বিভিন্ন অজুহাতে এড়িয়ে যান সংস্থার কর্মীরা। চতুর্থবার জানান ,তারা শুধুমাত্র তারকাদের সঙ্গেই কাজ করেন, তাই তাঁর সঙ্গে কাজ করার প্রশ্নই ওঠে না।‘
‘গালিবয়’ খ্যাত সিদ্ধান্ত চতুর্বেদী বলেন, ‘স্টারকিডদের সংগ্রাম যেখানে শুরু হয়, সেখানেই আমাদের সংগ্রামটা শেষ হয়।‘ মানে প্রথম ছবি পেতেই হিমশিম খেয়ে অর্ধেক ডুবে থাকেন ‘বহিরাগত’রা।
অহনা কুমরার মুখেও একই বোল, ‘বাইরে থেকে এসেও যারা স্থান পান, তাদের অধিকাংশই নির্দিষ্ট কিছু শিবিরের দাস হন। পরে নিজেদের গোঁড়াই ভুলে যান, কাউকে সাহায্য করেন না।‘ জিম সার্বও ইশান খাট্টারকে সরাসরি বিদ্ধ করেছিলেন যুক্তিতে, ‘ আপনার কাছে অডিশন দেয়াটাকে সংগ্রাম মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের কাছে অভিনয়, নাচ শেখার পর মুম্বাইয়ে পাঁচজনের সাথে ঘর ভাগ করে নেয়াটা সংগ্রাম। অডিশনের খোঁজ পাওয়া তো আরও কঠিন। ওখানে গেলেও দেখি দুই ভাগে বিভক্ত নতুন অভিনেতারা- তারকা সন্তান আর বহিরাগত।‘
সরব হয়েছেন স্বরা ভাস্কর, সুরভিন চাওলা, কৃতি শ্যানন, তাপসি পান্নু, মনোজ বাজপেয়ী, আনুশকারা। জিয়া খানের মা রাবিয়া আমিন জানিয়েছেন সালমান খানের জন্যই সুরাজ পাঞ্চোলি আত্মহত্যায় ইন্ধন দিয়ে পাড় পেয়েছেন। আথিয়া শেঠি, সোনম কাপুর, অর্জুন কাপুরের মতো অভিনয় না জানারাও পাচ্ছেন মনোযোগ।
কাঠগড়ায় করন,আলিয়া, ইয়াশ
‘কফি উইথ করণে’ এর র্যাপিড ফায়ারে তামাশা করেই সুশান্তকে খুন করার কথা বলেছিলেন আলিয়া, সাথে করণের সায়ও ছিল প্রবল। একই অনুষ্ঠানে সোনম কাপুরও অপমানজনক ইঙ্গিত করেছিলেন তাঁর প্রতি।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শহিদ কাপুর, করণের সুশান্তকে এড়িয়ে যাওয়ার ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে নিয়মিত। আর সেগুলোই নেটিজেনদের ক্ষোভে রসদ যোগাচ্ছে। ইতোমধ্যে করণ হারিয়েছেন তার ৬ লাখ ফলোয়ার, অন্যদিকে আলিয়াও ১২ লাখকে খুইয়েছেন।
সাহসী কঙ্গনা, সরব বলিউড
মিলেনিয়ামের আরম্ভেই বিবেককে পেয়েছিল বলিউড। ‘রোড’, ‘কোম্পানি’, ‘সাথিয়া’, ‘কাল’-এর মতো সফল ছবির পরও হারিয়ে যেতে হয় তাঁকে। ঐশ্বরিয়া রাইয়ের সাথে প্রেম এবং সালমানের দৌরাত্মের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলাতে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় সব সম্ভাবনা।
২০০১ সালে ‘স্টাইল’ দিয়ে বলিউডে নাম লিখিয়েছিলেন সাহিল খান। সুঠাম শরীর আর অভিনয় গুণে দর্শকের নজর কেড়েছিলেন তখন। এর সুবাদেই স্টারডাস্ট ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আসেন সালমান ও শাহরুখ খানের সাথে।বলিউডে তখনও সিক্স প্যাকের ঢেউ জাগেনি, তাই প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবেই উঠেপড়ে লেগেছিলেন সালমান। সাহিল বলেন, “আমি নতুন ছিলাম, তবুও ওর সঙ্গে এক ফ্রেমে জায়গা পাই আর সেই জন্যই বোধহয় ইচ্ছে করে আমায় বিভিন্ন ছবি থেকে বাদ দিতে শুরু করেন তিনি। মডেলিং জগত থেকে জন আব্রাহাম বাদে আর কেউ দাঁড়াতেই পারেনি এই কুড়ি বছরে। সুশান্ত এদের আসল চেহারা সামনে এনে দিয়েছে। ‘
নিজের ইউটিউব চ্যানেলে সোনু নিগম ভিডিও প্রকাশ করে বলেন, ‘আজ সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু হয়েছে, কাল কোনও গায়ক, কোনও সঙ্গীত, পরিচালক, গীতিকার, সুরকারের সঙ্গেও এমনটা ঘটতে পারে। ফিল্মের থেকেও বড় মাফিয়া সঙ্গীত জগতে রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মিউজিক ডিরেক্টর , প্রযোজক কাজ করতে চায়, অথচ শেষ সময় মিউজিক কোম্পানি গিয়ে আটকে দেয়।আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে দুটো কোম্পানির হাতেই সমস্ত ক্ষমতা রয়েছে। ওরাই ঠিক করেন, কে গাইবে, কে গাইবে না।‘
এর সাথে অরিজিত সিং এবং তাকে সরিয়ে সালমান খানের প্লেব্যাককেও নির্দেশ করেন সোনু। পায়েল রাহোতগিও তাকে অন্যায়ভাবে ছবি থেকে সরিয়ে দেবার অনুযোগ করেন একতা কাপুর ও করণের বিরুদ্ধে।
কোয়েনা মিত্র একসময় স্থায়ী জায়গা করে নিচ্ছিলেন বলিউডে, কিন্তু মডেলিং জগত থেকে আসায় বলিউড মাফিয়াদের সাথে পেরে ওঠেননি। দীর্ঘ স্ট্যাটাসে বলেন, ‘বলিউড গুণ্ডাদের আখড়া। মর্জি মোতাবেক না চললে কাজ পাবেন না। কেউ এখানে কারুর পরোয়া করে না। বাইরে থেকে, মডেলিং থেকে আসলে আপনাকে গোনায় ধরবে না।‘
তবে আগুনে ঘি ঢেলে একাই লড়ে চলেছেন কঙ্গনা রানাওয়াত। সুশান্তের বিদায়ের পরেই এক ভিডিওবার্তায় জানান, ‘মন্দ সময়ে তথাকথিত কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী গায়ে পড়ে তাঁকে আত্মহত্যার কথা বলে উসকাতেন। আজ যারা সুশান্তকে দুর্বল মনের অধিকারি হিসেবে প্রমাণ করতে চাচ্ছেন তারা কি জানেন না, এই ছেলে স্কলারশিপ পেয়েছিল, র্যাংক করা ছাত্র ছিল? সামাজিক মাধ্যমে ও বারবার বলতো ‘আমার কোন গডফাদার নেই। আমাকে ইন্ডাস্ট্রি থেকে বের করে দিচ্ছে। আমার ছবি দেখুন।‘
‘গালিবয়ে’র মতো গড়পড়তা ছবির জয়জয়কারের পাশে ‘ছিছোড়ে’র ম্লান অবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন কঙ্গনা। তোপ দাগেন আদিত্য চোপড়ার বিরুদ্ধেও। ‘সুলতান’ ছবির প্রস্তাবে না-ই কাল হয়েছিল। বলিউডচ্যুত করবার হুমকিও পেয়েছিলেন ক্রমাগত। আর ‘কফি উইথ করণ’ এ করণকে সপাটে ‘নেপোটিজমের পতাকাবাহক’ হিসেবে তো নির্দেশ করেছিলেন বছর তিনেক আগেই।
‘দাবাং’ দিয়ে সালমানের ক্যারিয়ার বাঁচিয়েছিলেন অভিনব কাশ্যপ। পরে মতবিরোধের জেরে সালমান খান, আরবাজ খান, সোহেল খান-রা তাঁর ক্যারিয়ার কার্যত নষ্ট করতে তৎপর। তাঁকে খুনের হুমকি, পরিবারের মহিলা সদস্যদের ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ করেন অনুরাগ কাশ্যপের এই পরিচালক ভাই।
মিডিয়ার অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন অভয় দেওল। ইনস্টা পোস্টে বলেন, ‘জিন্দেগি মিলেগি না দোবারা’য় আমার আর ফারহানে চরিত্রও ঋত্বিকের মতো গুরুত্ববহ ছিল। কিন্তু এ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে আমাদের ফেলে দেয়া হয় ‘সাপোর্টিং’ এর তালিকায়।‘
ফারহান আখতারও ‘কুম্ভীরাশ্রু’ ত্যাগ করে কাজে নামতে বলেছেন দর্শকদের। মনোজ বাজপেয়িও লড়ে যেতে বলছেন নবীনদের, ‘এখন আত্মসমীক্ষার সময়। এটা শুধু চলে যাওয়া নয়, এটা বদলের আঘাত।‘ প্রকাশ রাজও নিজের ক্ষোভ উগড়ে জানান, তিনিও এর ভুক্তভোগী।
পুলিশি তদন্ত
আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে ইতোমধ্যেই দর্শকের কাঠগড়ায় আছেন নামজাদা বলিউড পরিবার, প্রযোজকেরা। যশরাজের চুক্তিনামা জমা নিয়েছে পুলিশ। এর সাথে সুশান্তের প্রেমিকা রিয়া চক্রবর্তীর নামও জোরেশোরে শোনা গেছে। মৃত্যুর আগের দিন তাকে ফোন করলেও ধরেননি তিনি।
বিহারের মুজাফফরপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে, শুনানির দিন ২৪ জুন। গত সপ্তাহেই সুশান্তের মৃত্যুর পর আইনজীবী সুধীর কুমার ওঝা করণ জোহর, একতা কাপুর, সালমান খান, সঞ্জয় লীলা বানশালি, রিয়া, মহেশ ভাটসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এদিকে মুম্বাই পুলিশ ১১ ঘণ্টা জেরাও করেছে রিয়াকে।
সুশান্তের চিকিৎসক কেরসি চাওলা জানান অঙ্কিতা লোখান্ডেের সাথে বিচ্ছেদ নিয়েও বিপর্যস্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। তবে ইন্ডাস্ট্রিতে যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন বেশি।
১৭ জুন তাঁর অন্তিম সংস্কারে উপস্থিত ছিলেন শ্রদ্ধা, রণবীর শোরে, রাজকুমার, কৃতি, রিয়া, বিবেক, একতা সহ বেশ কিছু তারকা।
‘সোনচিড়াইয়া’র প্রচারণায় ভূমি পেদনেকারের সাথে পিঙ্কভিলায় গুগল প্রশ্নের জবাবে সুশান্ত ছিলেন সপ্রতিভ। সেখানে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আমার সবসময় ঘুম পায় কেন?’
চটপটে সুশান্তের ঝটপট উত্তর ছিল ,’কারণ, আপনি স্বপ্নবাজ।‘
মাত্র তিন শব্দই বলে দেয় কতটা ইতিবাচক ছিলেন বলিউডে বহিরাগত সুশান্ত সিং রাজপুত। ১৮ জুন তাঁর দেহভস্ম গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলেও হারিয়ে যাননি কেদারনাথ, জাগ্রত করেছেন অসংখ্য গুণগ্রাহীকে, প্রতিবাদি করেছেন সুঅভিনেতাদের।
লেখক- সারাহ তামান্না