চলচ্চিত্রের মহারাজা- সত্যজিৎ রায়1 min read
Reading Time: 4 minutesঘন কাশবনের কলরোল, এর মাঝেই ঝিক ঝিক শব্দে শতাব্দীর নবরথ রেলগাড়ি দৌড়ে যাচ্ছে প্রবল বেগে। আর তারই মাঝে দুই জোড়া কৌতূহলী চোখ আলোড়ন তোলা সেই কালো মেঘ শকটের গায়ে সেঁটে; নয়ন দুখানা অপু– দুর্গার।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচাইতে আলোচিত ও আইকনিক দৃশ্য ‘পথের পাঁচালী’র ‘ট্রেন সিন’। বিশ্বজুড়ে এই ছবির আকাশচুম্বী খ্যাতি – অথচ টাকার অভাবে মাঝপথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নির্মাণ, এমনকি পরিচালকের সহধর্মিণী বিজয়ার গয়নাও বন্ধক রাখতে হয়েছিল। বলছিলাম সত্যজিৎ রায়ের কথা। বাংলা চলচ্চিত্রের ভাষাই যিনি বদলে দিয়েছেন, যার হাত ধরে শৈশব থেকে পরিণতিতে এগিয়েছে গোটা উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের ভাষা।
যখন শৈশবে
১৯২১ সালের ২রা মে কলকাতায় জন্ম সত্যজিৎ রায়ের। পিতা খ্যাতিমান শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় আর মাতা সুপ্রভা দেবী। দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক,প্রকাশক, চিত্রশিল্পী এবং ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম কর্তাব্যক্তি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ইউ এন সনস প্রেসে’ই ছাপা হতো বিখ্যাত ‘সন্দেশ’ পত্রিকা। তাঁর সেই বহুমুখী প্রতিভাই কালক্রমে সত্যজিৎের বাঙালি রেনেসাঁর অভিযাত্রী হতে সহায়ক হয়েছে।
মাত্র আড়াই বছর বয়সকালে সুকুমার রায়ের মৃত্যু হয়। তখন সত্যজিৎকে নিয়ে সুপ্রভা দেবী চলে আসেন অবিবাহিত মামার বাড়ি ভবানীপুরে। অভাব,দৈনন্দিন টানাপোড়েন থাকলেও পারিপার্শ্বিক বলয়ে সবসময়ই ছিল সাংস্কৃতিক আবহাওয়া। রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ সেন সহ প্রমুখের সান্নিধ্য লাভ করেন ছোটকালেই। ৯ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হন শিশু সত্যজিৎ। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে বিএ তে ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। তাঁর ‘অপুর পাঁচালি’ তে সত্যজিৎ বলেছেন, ‘ চাকরি পাওয়া সহজ হবে শুনে ইকোনমিক্সে পড়েছিলাম। স্রেফ মুখস্তবিদ্যার জোরে তাই সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে বের হয়ে আসি।‘
এরপর ১৯৪০ সালে মায়ের আগ্রহেই ভর্তি হন শান্তিনিকেতনের ফাইন আর্টসে। অবশ্য আড়াই বছরের মাথায় শান্তিনিকেতনের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি, কোর্স শেষ না করেই। ওরিয়েন্টাল আর্ট সম্পর্কে তখনই নিজের আগ্রহটা টের পান। শিল্পী নন্দলাল বোস ও বিনোদ বিহারী মুখার্জির কাছে শেখেন চিত্রের খুঁটিনাটি।
যুবাকালের হাওয়া
শান্তিনিকেতন ছাড়ার ফাঁকে ঘুরে আসেন অজন্তা, ইলোরায়। পরবর্তীতে সত্যজিতের মননে যা প্রবল ছাপ রাখে। ১৯৪৩ সালে কলকাতায় এক পরিচিতের মাধ্যমে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডি জে ক্রেমারে মাসিক ৮০ রুপিতে ‘সিনিয়র ভিজুয়ালাইজার’ এর কাজ জুটিয়ে নেন। তবে বিজ্ঞাপন নিয়ে ‘যখন আমি ছোট ছিলাম’ এ এক মজার অভিজ্ঞতার বিবরণ পাওয়া যায় ।
‘তখন দমদম আর বেহালায় ফ্লাইং ক্লাব চালু হয়েছে, বাঙালীরা প্লেন চালাতে শিখছে। এই সব প্লেন থেকে মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপনের কাগজ ফেলা হত। হাজার হাজার কাগজ এক সঙ্গে ছেড়ে দিলে সেগুলো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে শহরের নানান জায়গায় ছড়িয়ে প্রত।একবার খানকতক পড়ল আমাদের বকুলবাগানের বাড়ির ছাতে; তুলে দেখি বাটার বিজ্ঞাপন।‘
ক্রেমারেই ডি কে গুপ্তার সাথে পরিচয় হয় তাঁর। বিখ্যাত সিগনেট প্রেসের মাধ্যমে রাতারাতি প্রকাশনার ধরণই পাল্টে দেন সত্যজিৎ আর গুপ্তা। তখনই বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’র সংক্ষিপ্ত রূপ ‘আম আঁটির ভেঁপু’র প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশনের কাজ করতে গিয়ে পড়া হয়ে যায় বইটি। ছবি নির্মাণের জন্য মোক্ষম গল্প পেয়ে যান সে সময়ই।
বিজ্ঞাপন থেকে ছবিতে
৪০ এর শেষভাগে ফরাসি পরিচালক জাঁ রেনোয়া এসেছিলেন ভারতে, ‘দ্য রিভার‘ ছবির দৃশ্যায়ন পরিকল্পনায়। তখন তাঁর সান্নিধ্যে আরও বিকশিত হয় সত্যজিতের ফিল্মি চিন্তা ভাবনা। স্বল্প আকারে ‘পথের পাঁচালী‘র গল্প তাকে বলেন সত্যজিৎ, প্রত্যুত্তরে পান অনুপ্রেরণা।
এদিকে ১৯৪৭ এর ৫ অক্টোবর বংশী চন্দ্রগুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্ত,আরপি গুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত প্রমুখের সাথে গড়ে তোলেন ‘কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি‘। কলকাতাবাসীকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের সাথে পরিচিত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। ‘Battleship Potemkin’ ছিল তাঁদের প্রথম প্রচারিত চলচ্চিত্র। এসময় বিভিন্ন পত্রিকায় সিনেমা সংক্রান্ত প্রবন্ধ লিখতেন নিয়মিত। ১৯৪৮–৭১ পর্যন্ত প্রকাশিত এসব লেখা পরবর্তীতে ‘Our films,Their films’বইয়ে সংকলিত হয়।
চলচ্চিত্রে আরম্ভ
১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’।প্রথমে অর্থ সংকট থাকলেও পরে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের আর্থিক অনুদানে সমাপ্ত হয় ছবির কাজ। প্রথম ছবিতেই অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করেন তিনি। জিতে নেন দেশ বিদেশের নানান পুরস্কার। ১৯৫৬ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘Best Human Document’ এর পুরস্কারও ঢোকে ছবির ঝুলিতে। পরবর্তীতে এর সাথে ‘অপরাজিত‘ (১৯৫৬) ও ‘ অপুর সংসার‘ (১৯৫৯) মিলে সৃষ্টি হয় ‘অপু ট্রিলজি‘র।
শুধু এই ট্রিলজিই নয়, ‘কাঞ্চনজঙঘা‘, ‘জলসাঘর‘, ‘দেবী‘, ‘চারুলতা‘, ‘ঘরে বাইরে‘, ‘মহানগর‘, ‘তিন কন্যা‘, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘ নায়ক’, ‘ মহাপুরুষ’ প্রভৃতি নন্দিত ছবি তৈরি হয় তাঁরই পরিচালনায়।
জীবদ্দশায় পূর্ণদৈর্ঘ্য, স্বল্প দৈর্ঘ্য মিলিয়ে ৩৬ টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন তিনি।
ফিকশনে- নন ফিকশনে
সত্যজিৎ রায় যে শুধু চলচ্চিত্রেই মনযোগী ছিলেন তা কিন্তু নয়। তাঁর হাত ধরে এসেছে বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ সব সৃষ্টিও। ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু প্রভৃতি কালজয়ী চরিত্রের পত্তন তাঁর হাতেই।
পুরস্কারের ফল্গুধারা
সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবনকালে ভারত সরকারের ৩২ টি ‘ন্যাশনাল ফিল্ম এ্যাওয়ার্ড’ তো পানই, এর পাশাপাশি ১৯৬৫ সালে ‘পদ্মভূষণ’ এবং ১৯৮৫ সালে অর্জন করেন ‘দাদা সাহেব ফালকে এ্যাওয়ার্ড’। তবে ভারতরত্নের খেতাবটা আসে মৃত্যুর কিছুদিন পর।
১৯৫৬ সালে ‘অপরাজিত’র জন্য ‘গোল্ডেন লায়ন’ পুরস্কার আসে তাঁর ঝুলিতে। ১৯৭৯ সালের ১১তম মস্কো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে। ‘বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে’ পরিচালনার জন্য ‘সিলভার বিয়ার’ পুরস্কারটি লাভ করেছেন একাধিকবার, তিনি ছাড়া মাত্র ৪ জনের আছে এই বিরল সম্মাননা। তবে ১৯৮২ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে “Hommage à Satyajit Ray” তাঁর পুরস্কারের পালকে যুক্ত করে নতুন দিগন্ত।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রিও পান তিনি।১৯৯২ এ সান ফ্রান্সসিসকো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘ আকিরা কুরোসওয়া এ্যাওয়ার্ড ফর লাইফটাইম এচিভমেন্ট ইন ডাইরেক্টিং ‘ও লাভ করেন । এরকম অসংখ্য পুরস্কারের মধ্য দিয়েই বর্ণাঢ্য চলচ্চিত্র জীবনের স্বীকৃতি পান তিনি।
২০০৪ সালে বিবিসি আয়োজিত ‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালির’ তালিকায় ১৩ তম নির্বাচিত হন। Entertainment Weekly এ ’৯৬ সালে তাঁকে বিশ্বের সেরা ৫০ পরিচালকের তালিকায় রাখে ২৫ তমে।
অস্কারে সম্মাননা
১৯৯২ সালে অস্কার কর্তৃপক্ষ ‘সম্মানসুচক অস্কার’ প্রদান করে সত্যজিৎ রায়কে। সেবারের অস্কারে তাঁর নাম ঘোষণা করেন তাঁরই প্রিয় অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন। অসুস্থতার জন্য মূল অনুষ্ঠানে অংশ নিতে না পারলেও হাসপাতালের শয্যা থেকে ভিডিওর মাধ্যমে ঠিকই ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তিনি।
বিরল প্রতিভা
কথার চালে একবার সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘প্রতিভা সর্বদেশে সর্বকালে বিরল।‘ সেই অতি অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি নিজেই। একাধারে লেখক, পরিচালক, সুরকার, গীতিকার, আঁকিয়ে, শিল্পবোদ্ধা– সবদেশে যেকোনো কালেই যা বিরল। এই গুণী শিল্পীর কর্মজীবন এত সুবিস্তৃত ও মুখর যে কখানা শব্দ গল্পে এঁটে উঠবে না। দীর্ঘদিন রোগাক্রান্ত থাকার পর ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।