বিশ্ব

আরব দেশগুলো যেভাবে তেলকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল 1 min read

জুলাই ১০, ২০১৯ 3 min read

author:

আরব দেশগুলো যেভাবে তেলকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল 1 min read

Reading Time: 3 minutes

প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে খনিজ তেলমধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো হচ্ছে খনিজ তেলের প্রধান উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরবসহ আরবের দেশগুলো প্রধান তেল উৎপাদনকারী হলেও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কাল পর্যন্ত এই তেল সরবরাহ ও দাম নির্ধারণে কর্তৃত্ব দেখাতো পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশের প্রধান সাতটি তেল কোম্পানি এই সাতটি তেল কোম্পানিকে একত্রে বলা হতো সেভেন সিস্টার্স, এদের কর্তৃত্বেই ছিল প্রায় ৮৫% তেল

সে সময় তেলের দাম ছিল খুবই সস্তা, কারণ তারা কৃত্তিম উপায়ে তেলের দাম সবসময় কমিয়ে রাখতোফলে আরব বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যতটুকু ত্বরান্বিত হওয়ার কথা ততটুকু হচ্ছিল নাএজন্য বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তেল সরবরাহ এবং তেলের দাম নির্ধারণের অধিকার সেভেন সিস্টার্স থেকে সরিয়ে নিজেদের অধীনে আনার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করে

এই উদ্দেশ্যকে সফল করতে ১৯৬০ সালে সৌদি আরব, ইরান, কুয়েত, ইরাক ও ভেনিজুয়েলা মিলে গঠন করে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেক(OPEC)। তারা সিদ্ধান্ত নেয় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোই তেলের দাম নির্ধারণ করবে, তেল কোম্পানিগুলো নয়তেল শিল্পে ওপেকের এমন নতুন নীতি অবলম্বন করার ফলে সেভেন সিস্টার্সের ক্ষমতা অনেকটাই কমে যায় এবং বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়তে থাকে

এদিকে তেলের দাম বাড়ার কারণে শিল্পোন্নত দেশগুলো ও তেল কোম্পানিগুলো খেপে ওঠে কারণ তখন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ এবং জাপানে তেলের চাহিদা বছরে বছরে বৃদ্ধি পাচ্ছিল কিন্তু তেলের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তেলের দাম বাড়িয়ে দিতে থাকে

১৯৭৩ সালে ওপেকের এক বৈঠকে সৌদির আরবের তেল মন্ত্রীর পক্ষ থেকে তেলের দাম প্রায় ৭০% বাড়ানোর প্রস্তাব আসে আবার একই বছর ইসরায়েলের সঙ্গে মিশর এবং সিরিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় একদিকে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ এবং অপরদিকে ওপেকের সঙ্গে তেল  কোম্পানি ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে তেলের দাম নিয়ে  দফায় দফায় বৈঠক

সর্বশেষে ভিয়েনা বৈঠকেযখন ওপেকের সঙ্গে  তেল কোম্পানিগুলোর কোনো সমঝোতা  হলো নাতখন আরবের তেল মন্ত্রীরা নিজেরাই ১৯৭৩ সালেই ১৬ই অক্টোবর কুয়েতে কটি বৈঠকে বসলেন এই বৈঠকে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তেল কোম্পানিদের বাদ দিয়েই একতরফাভাবে তেলের দাম নির্ধারণ করবে এমন এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নে এবং তেলের দাম ৭০% শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়

এদিকে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েলকে নেদারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থন ও সামরিক সাহায্য প্রদান করে। এমন পরিস্থিতিতে সৌদির বাদশা ফসাল বিন আব্দুল আজিজ সর্বপ্রথম তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা শুরু করেনযদিও আরব বিশ্ব অনেকদিন যাবই তেল শিল্পের মাধ্যমে বৈশ্বিক রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাবকে  বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় ছিল। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তেল উৎপাদনকারী দেশসমূহের জন্য তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি হলো

এই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭৩ সালের ১৭ই অক্টোবর কুয়েতে আরবের দেশগুলোর তেল মন্ত্রীদের নিয়ে আবার এক বৈঠক হয় এই বৈঠকে সৌদি আরব ইসরায়েলের মিত্র দেশগুলোতে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব করে এবং ইরাক প্রস্তাব দেয় সমস্ত আরব দেশে যেসব মার্কিন তেল কোম্পানি আছে সেগুলো জাতীয়করণ করার। তবে ইরাকের প্রস্তাবের সঙ্গে অন্য দেশগুলো একমত হলো নাকিন্তু তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাবে ইরাক ছাড়া ওপেকের বাকি সদস্যরা একমত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডে তেল সরবরাহ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঘোষণা করা হয়, যদি মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো থেকে ইসরায়েল সৈন্য সরিয়ে নেয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ড ইসরায়েলকে সাহায্য করা থেকে বিরত হয়, তবে ওপেক এইসব দেশে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে

এই ঘোষণা পর থেকে নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশে তেলের দাম দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে; এমনকি তেলের দাম বাড়তে বাড়তে ৪০০গুণেরও বেশি বেড়ে যায়তখন পশ্চিমা বিশ্বে তেলের ব্যাপক সংকট সৃষ্টি হয় এবং পশ্চিমারা তেলের ব্যবহার কমিয়ে দিতে বাধ্য হয় আরব বিশ্ব তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ফলশ্রুতিতে হঠাৎ করেই বিশ্ব রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্যেও আসে এক বিরাট পরিবর্তন

এতে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো দ্রুত বিপুল সম্পদশালী হয়ে ওঠা শুরু করলো বিশেষ করে সৌদি আরব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেআর এই তেল অস্ত্র ব্যবহার করার মূল পরিকল্পনাকারী বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ, যিনি ১৯৬৪ সালে সৌদি আরবের বাদশাহ হন, তিনি এই তেল শিল্পকে পুঁজি করে সৌদি আরবকে আধুনিকায়ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন যেন তেলের দাম বাড়িয়ে নিজেদের অর্থনীতিকে যেমন সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হয়কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব ফয়সাল বিন আবদুল আজিজের এই পরিকল্পনাকে মোটেও ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেনি

বাদশাহ ফয়সাল দেশের অভ্যন্তরে টেলিভিশন চালু করা, মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি সংস্কারমূলক কার্যক্রমও শুরু করেন। এতে তিনি নিজ পরিবারের কিছু সদস্যসহ সৌদির রক্ষণশীল জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পশ্চিমা বিশ্বের বিপক্ষে গিয়ে তেল অস্ত্র ব্যবহার এবং রক্ষণশীল আরব জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে যাওয়ার ফল তাকে জীবন দিয়েভোগ করতে হয়েছে

১৯৭৫ সালের ২৫শে মার্চ বাদশা ফয়সাল তার রাজপ্রসাদে এক কুয়েতি প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেনএমন সময় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রবেশ করে তার নিজের ভাতিজা, যার নাম ছিল ফয়সালবাদশা ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ তার ভাইপোকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ঝুঁকছিলেন, এমন সময় যুবরাজ ফয়সাল তাকে পরপর তিনটি গুলি করে সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয় কিন্তু সেখানে অল্প পরেই তিনি  ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে গমন করেন আরব বিশ্ব, তেল উৎপাদনকারী দেশসমূহ এমনকি সৌদি আরব হারায় এক সাহসী ও প্রগতিশীল সমাজ সংস্কারক বাদশাকে। 

লেখক- আমিনুল ইসলাম 

আরও পড়ুন- সৌদি যুবরাজের ক্ষমতা অপব্যবহারের নিদর্শন

আরও পড়ুন- খাসোগি হত্যায় সৌদি যুবরাজ সালমান জড়িত: জাতিসংঘ

আরও পড়ুন- মুর্তাজা কুরেইরিসকে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে না সৌদি আরব

আরও পড়ুন- অস্ত্র বাণিজ্যের শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান—প্রধান ক্রেতা সৌদি আরব

আরও পড়ুন- সৌদি-মার্কিন বন্ধুত্বের একাল সেকাল

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *