বিনোদন

ন ডরাই: কেমন হলো দেশের প্রথম সার্ফিং চলচ্চিত্র?1 min read

ডিসেম্বর ৮, ২০১৯ 5 min read

author:

ন ডরাই: কেমন হলো দেশের প্রথম সার্ফিং চলচ্চিত্র?1 min read

Reading Time: 5 minutes

আমার চোখে সব কিছু ঝাপসা মনে হয়।

আমার মনে সব কিছু কেন এলোমেলো লাগে।

গানের জগত সম্পর্কে যারা খোঁজ রাখেন তারা ইতোমধ্যে লিরিক্সটি চিনে ফেলেছেন। মোহন শরীফের কণ্ঠেযন্ত্রণাগানটি সপ্তাহ কয়েক ধরেই নেটিজেনদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। ইউটিউব বলছে এর ভিউ বর্তমানে ২৭ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

শুধু সঙ্গীতের মূর্ছনাতেই নয়, বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে এক সাহসী পদক্ষেপ হিসেবেও আলোচনার মধ্যমণি এখন ডরাই তানিম রহমান অংশুর পরিচালনা এবং মাহবুব রহমানের গল্পে দেশের প্রথম সার্ফিং নিয়ে চলচ্চিত্র এটি। বিষয় নির্বাচনে যেমন নতুনত্ব ছিল, তেমনি পোস্টার এবং উপস্থাপনেও ছিল বৈচিত্র্যের ছোঁয়া। ফলে আগ্রহউদ্দীপনাআশা সবটাই ছিল বাড়তির ঘরে। ২৯ নভেম্বর মুক্তি পাওয়ার পর সেই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারলো এই ছবি

কাহিনি সংক্ষেপ

পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। ভৌগোলিক গুরুত্বের কারণে প্রতিবছর লাখো পর্যটক টানে এই জোয়ার ভাটার বসত। এই পরিযায়ী লোকের বাইরেও এখানকার স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে এক সমাজসেই সমাজেও আছে নানান উত্থানপতন, জোয়ার ভাটা। কক্সবাজার উপকূলবর্তী স্থানীয়দের জীবন জীবিকাকে উপজীব্য করেই গড়ে উঠেছে গল্পের কাঠামো।

ছবির মূল চরিত্রআয়েশা’- যার ধ্যানজ্ঞান সমস্তই সার্ফিংকে ঘিরে। আয়েশাসহ কক্সবাজারের বহু কিশোরতরুণের সার্ফিংয়ের হাতেখড়ি হয়েছে আরেক স্থানীয় যুবক আমিরের মাধ্যমে। আমির এবং বাবার সমর্থন থাকলেও সামাজিক বলয়ের বাঁধা দোটানার জালে জর্জরিত হয়ে বারবার স্বপ্ন থেকে ছিটকে পড়ে এলাকার সেরা সার্ফার আয়েশা। এই চরিত্রটি নির্মিত হয়েছে আরেক বাঙালি সার্ফার নাসিমার ছায়াকে আশ্রয় করে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে পেশাদারি সার্ফিংয়ে যুক্ত হন নাসিমা।বিগিনার সার্ফিং বিভাগনামক প্রতিযোগিতায় সেরার মালাটাও জয় করেন তিনি।

কনের সাজ আর সার্ফিং বোট- অকল্পনীয় যুগলবন্দী ছিল ‘ন ডরাই’ এর পোস্টারে

নাসিমার আদলে আয়েশাকে ভাবা হলেও ছবিতে কিন্তু সেরার সম্মানটা তার কপালে জোটে না। সামাজিক কুৎসার ভয় এবং বদরাগী ভাইয়ের অত্যাচারে বালির সার্ফিং চ্যাম্পিয়নশিপের পুরষ্কার অধরাই রয়ে যায়। আবার এই ঘটনাই বদলে দেয় তার শৈশবের সঙ্গী সোহেলের জগত। 

ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আয়েশা বাধ্য হয়ে বিয়ে করে তার চাইতে বয়সে তিনগুন বড় এক মাছ ব্যবসায়িকে। অন্যদিকে ডকুমেন্টরি নির্মাতা এস্থারের প্রেমে সোহেল পাড়ি জমায়অনিশ্চয়তার শহর ঢাকায়। নির্যাতন নিপীড়নের দীর্ঘ সংগ্রামের পর রুগ্ন আয়েশা ফিরে আসে আমিরের ঘরে। ঘটনাচক্রে সোহেলেরও  ঠাই মেলে সেখানে। অব্যক্ত বিরহ প্রেমকে সঙ্গী করে নতুন জীবনের অদম্য স্বপ্ন বোনে দুই তরুণ সার্ফার। পেছনে পড়ে থাকে ক্লেদাক্ত সমাজের নগ্নদেহ। 

কারিগরের কথা

‘ছোটপর্দার নির্মাতারা নাকি বড়পর্দা বোঝেন না!’ এমন নাকউঁচু মন্তব্যকে এই জমানার পরিচালকেরা থোড়াই কেয়ার করেন। তেমনই তানিম রহমান অংশু। বিজ্ঞাপন, মিউজিক ভিডিও এবং নাটকের পর দৃপ্ত কণ্ঠে হয়তো নিজেকে নিজেই বলেছিলেনরূপালি পর্দাকে মুই ডরাই তার প্রমাণও মিলেছে কয়েকবার। প্রথম চলচ্চিত্রআদি ট্রেইলার মুক্তি পেলেও শেষমেশ আর আলোর মুখ দেখেনি তবে গত বছরের ২১ ডিসেম্বরস্বপ্নের ঘরমুক্তি পায় কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে। 

ডরাইপ্রযোজনা করেছেন স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারপার্সন মাহবুব রহমান। এর প্রধান চরিত্র আয়েশার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মডেল অভিনেত্রী সুনেরাহ বিনতে কামাল, ‘আইসক্রিমখ্যাত সুদর্শন শরিফুল রাজকে দেখা গেছে সোহেলের হৃদয়গ্রাহী চরিত্রে। মূল ভূমিকায় এই দুজন থাকলেও আলাদা করে নজর কেড়েছেন আমির চরিত্রে সাইদ বাবু এবং আয়েশার ভাই চরিত্রে ওয়াসিম সিতার। বিস্মিত শিক্ষানবিস কিংবা দায়িত্বশীল সার্ফিং প্রশিক্ষকদুই ভূমিকায়ই অনবদ্য ছিলেন বাবু। তাঁর দৈহিক গড়ন এবং তামাটে বর্ণের গুণে আরও বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছেআমির ওয়াসিম সিতার নতুন হলেও প্রতিভার স্বাক্ষর যেমন রেখেছেন তেমনি নেতিবাচক চরিত্র হলেও দর্শকমনে স্পষ্ট ছাপ রেখেছেন সফলভাবে।আমিরের প্রশিক্ষক হিসেবে টমি হিন্ডলেকে বেশ দুর্বল লেগেছে। জসেফিন লিন্ডেগার্ড অবশ্য হতাশ করেননি। তাঁর স্বভাবজাত মিষ্টতায় ঠিকই মাতিয়েছেন দর্শকমহলকে। 

একটি সফল চলচ্চিত্র নির্মাণে চিত্রনাট্যকার থেকে শুরু করে এর স্পটবয়সকলেরই অবদান রয়েছে। ডরাইনির্মাণের পেছনের গল্পটাও এমন। এর চিত্রনাট্যের দায়িত্বে ছিলেন ভারতের শ্যামল সেনগুপ্ত। নাম না জানলেও ক্ষতি নেই। তাঁর পোর্টফলিও তে আছে রাহুল বোসঅপর্ণা সেনের অন্তহীন (২০০৯), দেবেরবুনোহাঁস’ (২০১৪) এবং অমিতাভতাপসি পান্নুর বহুল আলোচিত ছবিপিংক’ (২০১৬) তবে প্রত্যাশার চাইতে খানিকটা খামতিই মিলেছে তাঁর কাজে। অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি প্রশস্ত চরিত্রের বিপরীতে সংলাপ ছিল নিরস। হতে পারে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের কারণে সংলাপ চিত্রনাট্যকার গাম্ভীর্য এড়িয়ে গেছেন।  বিশেষত ডকুমেন্টরি নির্মাতা দলের সংলাপ অনেক ক্ষেত্রে বিরক্তির উদ্রেক করেছে।আয়েশা মুখ থেকেও বলিষ্ঠ কোন ভাবনার খোঁজ মেলেনি। 

ছবির জন্য আলাদা করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন সিনেমাটোগ্রাফার সুমন সরকার। ড্রোনের ব্যবহার হরহামেশা চললেও ডরাইয়ে এই ড্রোনশটই দিয়েছে আলাদা স্বস্তি। উত্তাল সমুদ্রের হাতছানি অথবা আঁকাবাঁকা পথে ছুটে চলা জিপের আপারশট মুগ্ধ নয়নে দেখেছে দর্শক। ফ্রেমের একপাশে আয়েশা আরেকপাশে অসীম শূন্যতার দৃশ্যায়নও জানান দিয়েছে ফ্রেম গল্পে অপটু নন তিনি। তবে এটা মানতেই হবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজারকে আরও বিস্তৃত মনোরম ভাবে আবারও চিনিয়েছে ডরাই 

‘অ্যাডভেঞ্চার অফ আয়েশা’ নামে কমিক বইও প্রকাশিত হয়েছে

সুরে উত্তাল 

২০১৯ সালের সবচেয়ে আলোচিত বাংলা গান কোনটি? এই প্রশ্নে যে কেউ চোখ বুজে আউড়াবেনযন্ত্রণা নাম। মোহন শরীফের মতো বিপরীত স্রোতের গায়কীকে শ্রোতারা সাদরে গ্রহণ করেছেন। এছাড়াও প্রীতম হাসানের রোমান্টিক গানসত্যি নাকি ভুল জেফার রহমানের বলিষ্ঠ কণ্ঠেরহারবো নাগান দুটোও মাধুর্যশালী। 

তবে সামগ্রিক সিনেমায় শব্দের ব্যবহার কিছু স্থানে ছিল অপ্রতুল। ঝড়ে উত্তাল সমুদ্র কিংবা সাগরের চিরন্তন গর্জনের অসামান্য সুর সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে সুরকার দল। সোহেলের খোঁজে বন্ধু আদিল যখন ঢাকার মতিঝিলে দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় তখন আরবি সুরের মূর্ছনা অপ্রাসঙ্গিক হাস্যকর ঠেকেছে। 

বাঁধন ভাঙার গল্প 

ডরাইকে মাত্র সার্ফিং ভিত্তিক ছবি বললে ভুল হবে। আড়াই ঘণ্টার সেলুলয়েডে পরিচালক দেশি সমাজের বহু অসঙ্গতিকেই মোটাদাগে দেখাবার চেষ্টা করেছেন। নারী স্বাধীনতাকে মুখ্য সম্পাদনায় রাখলেও যৌতুক, বিয়েতে বয়স মানসিকতার পার্থক্য, ম্যারিটাল রেপ, বধূ নির্যাতনের বিষয়গুলোও পরিষ্কার ভাবে এসেছে। অন্যদিকে স্বপ্নবাজ তরুণ সোহেলের দস্যিপনা, দুরন্ত সমুদ্রে অভিযান স্পৃহা এবং এস্থারের প্রতি কৃতজ্ঞতাকে প্রেমের সাথে মিশিয়ে ফেলার আত্মনুধাবনের অংশগুলোও ছিল অনবদ্য। 

ছবিতে পরিচালক এবং তাঁর সহযোগী সবচাইতে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন ফ্রেমিংয়ে। সমকালীন বাংলাদেশি খুব কম চলচ্চিত্রেই এই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে। পরিচালক শুধু গুটিকয়েক চরিত্রকে দিয়েই গল্পটা বলেননি, সমুদ্র, বালি, সার্ফিং বোট, আয়েশার ঘরের আয়না, কড়ির মালা, মাছ ধরার জাল ,এমনকি সোহেলের মাচার পাশে মস্ত চাঁদটাকে দিয়েও ভিন্ন দ্যোতনা সৃষ্টি করেছেন পরিচালক।

এর মাঝে দুয়েকটা দৃশ্যের কথা না বললেই নয়। বিয়ের আলোচনাকালে আয়েশা যখন আয়নার সামনে দাঁড়ায়, তখন দর্শক সহজেই আয়েশার দ্বান্দ্বিক রূপ অনুধাবন করতে পারেন। স্বামীর ঘরে নির্যাতিত আয়েশা যখন জালের মধ্য দিয়ে বাইরে তাকায়, সেটাও তার অসহায়ত্বের রূপক দৃশ্যই বলা যায়। সোহেলের ব্যক্তিত্বের দোটানাতেও মন দিয়েছে স্ক্রিপ্ট। স্বপ্নালু সোহেলের সাথে বারবার গোল চাঁদকে দেখিয়ে পরিচালক তার অসীম প্রত্যাশার হাতছানিকেই নির্দেশ করেছেন। ঢাকায় মাদকাসক্ত অবস্থায় আয়েশার হ্যালুসিনেশন এবং ভাঙা জানালাও তার ভগ্ন স্বপ্নেরই পরিচায়ক। তানিম রহমান নানারকম উপাত্ত দিয়ে দুই চরিত্রের মানসিক অবস্থাকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা ঢালিউডে বিরল। 

আলোচনা- সমালোচনা

সময়ের অন্যতম তুখোড় চলচ্চিত্র হিসেবে একে বিবেচনা করা হলেও বহু দর্শকই একেঅহেতুক মেলোড্রামাআনার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। তাছাড়া সার্ফিংও ছিল মাত্র প্রথমার্ধেই। দ্বিতীয় ভাগে মানসিক দোটানার সাথে সার্ফিংয়ের কোন যোগসাজশই ছিল না। আয়েশাসোহেলের প্রেমটাও ছিল অস্পষ্ট। 

এ ছবির দৃশ্যায়নে অভাবনীয় সাবলীল সৌন্দর্য স্থাপিত হলেও এর চিত্রনাট্য কিছু অংশে নিম্নমুখী। বিরতির পর সহসাই সোহেলের সার্ফিং চ্যাম্পিয়নশিপ জয় এবং গ্রামীণ কোলাহলকে মেনে নিতে কষ্টই হয়েছে। প্রথমভাগে যেই স্থিতির পরিচয় দিয়েছেন পরিচালক, দ্বিতীয়ার্ধে সেটাই ছিল নিখোঁজ। 

অনেকের মতে ডরাইভারসাম্য মেনে চলা একটি ছবি। ভালো ছবির অভাব, ক্রমে বন্ধ হতে থাকা সিনেমাহল এবং স্ট্রিমিং সাইটগুলোর আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে প্রসন্নতা দেবে এটি। বহির্বিশ্বে যখন কাহিনি নান্দনিকতা নির্ভর চলচ্চিত্রের জোয়ার চলছে তখন গৎবাঁধা প্রেমের গল্প খুব বেশিদিন এই শিল্পকে টেকাতে পারবেনা। সেদিক দিয়ে এটি নিঃসন্দেহে চৌকস একটি প্রচেষ্টা। 

লেখক- সারাহ তামান্না  

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *