গাছ কথা বলে?1 min read
Reading Time: 3 minutesযদি বলি গাছের জীবন আছে, সবাই বলবেন এ আর নতুন কি! আমরা সবাই জানি। কিন্তু যদি বলি গাছ কথা বলে? পাগল ঠাওরাবেন কি? তার আগে একটু জেনে নেন বিজ্ঞান কি বলছে।
২০১৫ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ বই, দ্য হিডেন লাইফ অফ ট্রিস এ দাবি করা হয় গাছেরা আসলে একে অপরের সাথে কথা বলতে পারে। কিন্তু আসলেই কি তাই? লেখক পিটার ওলেবেন কিন্তু তাই বলছেন। তার মতে গাছ যে শুধু যোগাযোগ করতে সক্ষম তা নয়, এরা সামাজিক প্রানীও বটে। এদের মধ্যে একটা বিস্তৃত নেটয়ার্ক ছড়িয়ে রয়েছে, অনেকটা একপাল পশুর মত।
ওলেবেন মনে করেন গাছেরা ইলেকট্রিক সিগনাল ব্যবহার করে যোগাযোগ করে, বন্ধুত্ব করে, এমনকি কোন আঘাতপ্রাপ্ত গাছকে বছরের পর বছর বাচিয়েও রাখতে পারে।
যেমন, ঘাস কাটার সময় একটা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘ্রাণ তৈরিতে যে কেমিক্যালগুলো কাজ করে তারাই অন্য সব ঘাসকে সতর্ক করে দেয় আক্রমণের ব্যাপারে অথবা পোকামাকড়কে ডেকে আনে তাদের রক্ষা করতে। এই ঘ্রাণটি আসলে তাদের কান্না বা সাহায্যের আকুতি দুটোই হতে পারে।
লেখক এর উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। কয়েক বছর আগে বিজ্ঞানীরা আফ্রিকান জংগলে একটি বিশেষ ঘটনা লক্ষ্য করেছিলেন। তারা দেখেন যে, এক পাল জিরাফ আম্ব্রেলা থর্ন একাসিয়াস গাছের পাতা খাচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একাসিয়াস গাছ নিজের পাতার মধ্যে এমন কিছু বিষাক্ত উপাদান ছড়িয়ে দিয়েছিল যে জিরাফের দল গাছের পাতা খাওয়া ছেড়ে দিয়ে সরে গিয়েছিল। কিন্তু জিরফেরা সরে গিয়ে অন্য আম্ব্রেলা থর্ন একাসিয়াস গাছের পাতা খেতে শুরু করেনি। তারা ১০০ মিটার দূরে গিয়ে অন্য আরেক জাতের গাছের পাতা খেতে শুরু করছিল। তার মানে দাঁড়ায় প্রানীকুল হয়ত বুঝতে পারে যে একই স্থানের গাছেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে।
যখন গাছেরা দূর্বল হয়ে যায় বা অসুস্থ হয়ে পড়ে, তারা তাদের আশেপাশের বাতাসে এমন কিছু মলিকিউল ছড়িয়ে দেয় যা অন্য গাছ গ্রহণ করে, হতে পারে তা একই জাতের বা অন্য জাতের কোন গাছ। ফলে এই গাছ গুলো সতর্ক হয়ে যায় এবং ঐ রোগের প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি গাছে হঠাৎ দেখা দেয় তা নয়, বরং যে সব গাছেরা নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করে তাদের জীনগত পরিবর্তনের কারণে দেখা যায়।
এটারও প্রমাণ রয়েছে যে এক এলাকার গাছ থেকে নির্গিত কেমিক্যালস অন্য এলাকার থেকে কিছুটা ভিন্ন। মানে গাছেরা যে শুধু কথা বলে তা না, এলাকা ভেদে তাদের ভাষার আঞ্চলিকতাও রয়েছে! কি আজব ব্যাপার!
তথ্যগুলো আজব মনে হলেও সাধারণ মনে এটি এতটাই দাগ ফেলেছে যে বইটি ১৯ দেশে অনুবাদিত হয়ে ৩,০০,০০০ কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে।
ওলেবেনের হিসেবে একই পরিবেশে থাকা গাছেদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব হয় সেটিই সবচেয়ে অনন্য। একটা মজার তথ্য দিয়েছেন তিনি। লক্ষ্য করেছেন কি এক জায়গায় বেড়ে ওঠা গাছেদের ডালপালাগুলো দূরে সরে সরে যায়! কারণ তারা একে অন্যের জায়গা দখল করে সূর্যের আলো আসার রাস্তা আটকাতে চায় না।
গাছেরা কি আসলেই কথা বলে? এটা কি সত্যিকারের যোগাযোগ? এই প্রশ্ন তারপরও থেকে যায়। আসলেই কি গাছেরা রাসায়নিকগুলো ইচ্ছা করেই ছড়িয়ে দেয়? নাকি এটা নিছকই একটি প্রাকৃতিক বিষয়?
কিছু কিছু গবেষণা বলছে এই কেমিক্যালসগুলো আসলে অন্য গাছের উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয় না, বরং সেই গাছেরই অন্যান্য অংশে বার্তা পাঠানোর জন্য ছড়িয়ে দেয়া হয়। সাধারণত ইনফেকশন বা পোকামাকড় গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে চলাফেরা করে। সেই ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ডাল বা অংশ এইসব কেমিক্যালস গাছের অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়ে তাদের সতর্ক করে দিতে পারে যে একটি ইনফেশন বা পোকার আক্রমণ কাছে আসছে, সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। গাছ এই সতর্কবার্তা অনেক লম্বা দূরত্ব পার করতে পারে, গাছ যত বড়ই হোক না কেন।
আবার অপরদিকে, এই কেমিক্যালসগুলোই বাতাসে ভেসে অন্য গাছের কাছে চলে গেলে সেই গাছও সতর্ক হয়ে তার ডিফেন্স সিস্টেম উন্নত করে ফেলতে পারে যাতে ইনফেকশন বা পোকার আক্রমণ তাদের কাবু করে ফেলতে না পারে।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে যে, গাছের এই নিজস্ব বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থাটি যাকে ইন্টারনাল মেসেজিং বলা হচ্ছে, এটিই অন্য গাছকেও সাহায্য করতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আবার এ নিয়ে খানিক মতভেদ রয়েছে যে, এই কেমিক্যালস এর যে গন্ধ তাতে অন্য পোকামাকড় আকৃষ্ট হতে পারে। ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে।
তবে গাছ যে শুধু বাতাসের মাধ্যমেই যোগাযোগ করে তা না। যেহেতু গাছের একটা বিস্তর অংশ মাটির নিচে তাই শিকড়ের মাধ্যমেও যেযোগাযোগের একটা বড় অংশই যে মাটির নিচে হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পিটার ওলেবেন সে বিষয়েও বিস্তর আলোচনা করেছেন তার বইটিতে। এই বিষয়টিকে বলে ফানজাল নেটওয়ার্ক (Fungal Network)। যেহেতু মাটিতে অবস্থিত ফানজি (Fungi) এবং গাছের শেকড়ের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে তাই এই নামকরণ।
এই নেটওয়ার্ক শুধুমাত্র একই জাতের গাছের উপর কাজ করেনা বরং ভিন্নভিন্ন প্রজাতির গাছের মধ্যেও সম্পর্ক স্থাপন করে।
১৯৯৭ সালে প্রকাশিত নেচার ম্যাগাজিনের একটি ইস্যুতে এরকম একটি পরীক্ষার কথা জানা যায়। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার বনে পাশাপাশি অবস্থিত কিছু গাছের মধ্যে কার্বন, নাইট্রোজেন এবং পানির চলাচলকে দেখার জন্য বিজ্ঞানীরা রেডিও আইসোটোপ ব্যবহার করেন। তিনি যখন একটি গাছে এই সব উপাদান প্রয়োগ করেন, তিনি লক্ষ্য করেন উপাদানগুলো অন্যান্য গাছেও ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা করার বদলে তারা বরং এই ফানজাল নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে একে অপরকে সাহায্য করছে।
গাছের যোগাযোগ বা কথা বলার ভিত্তি আছে কিনা সেটা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে তবে আশার কথা হচ্ছে গাছপালার ব্যাপারে এমন অনেক না জানা তথ্য নিয়ে বিজ্ঞানীরা বেশ সরব। কদিন আগেও যেখানের গাছের কথা বলা রূপকথা বলে মানা হতো, আজ তা গবেষণার বিষয়। সেদিন হয়ত দূরে নয় যেদিন মানুষ গাছের কথা শুধু প্রমানই করবে না, তা হয়ত আয়ত্বও করে ফেলবে।
– Peter Wohlleben এর The hidden life of trees অবলম্বনে