বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

পাবজিঃ নয়া প্রজন্মের নয়া আসক্তি1 min read

সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০ 4 min read

author:

পাবজিঃ নয়া প্রজন্মের নয়া আসক্তি1 min read

Reading Time: 4 minutes

এ কথা বোধ করি সকলেরই জানা, নতুন প্রজন্মের স্মার্টফোন আর কম্পিউটারে আসক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ ভিডিও গেমস। বর্তমানে স্মার্টফোন গেমগুলোর মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয় গেমের নাম “প্লেয়ার আননোনস ব্যাটল গ্রাউন্ডস” বা সংক্ষেপে পাবজি। প্রতি ২৪ ঘন্টায় কমপক্ষে ৩ কোটি মানুষ পাবজি খেলে। প্রায় সকলের কাছে দারুণ জনপ্রিয় এই গেমটি নিয়ে দুনিয়াজুড়ে রয়েছে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা।

সে সবে যাওয়ার আগে পাবজি গেম কিভাবে খেলে সে গল্পটুকু জেনে নেয়া যাক।

পাবজি গেম একাধিক পরিত্যক্ত শহরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সেসব পরিত্যক্ত শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে নানান ধরণের যুদ্ধাস্ত্র। খেলার শুরুতে ১০০ জন খেলোয়াড়কে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় যেকোনো একটি শহরে। এরপর বিমান থেকে লাফিয়ে প্যারাসুটের সহায়তায় নিচে নামতে হয়।

অবতরণের পর খেলোয়াড়ের প্রথম কাজ হল পরিত্যক্ত স্থান থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম খুজে বের করা। এরপর শুরু হয় আসল কাজ। টিকে থাকার জন্য খুঁজে খুঁজে শত্রুকে মেরে ফেলাই হল এই খেলার মূল টার্গেট। শেষে যে টিকে থাকবে সেই বিজয়ী।

গোলাবারুদ, অতর্কিত হামলা, স্নাইপার সহ নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার মোদ্দাকথা যুদ্ধংদেহী একটা অনুভূতি খেলোয়াড় পেয়ে যায় পাবজিতে। প্রতিবার একটি পূর্ণাঙ্গ রাউন্ডের পাবজি খেলতে সময় লাগে ৩০ মিনিট। একজন খেলোয়াড় যুদ্ধের ময়দানে কতবেশি প্রতিপক্ষকে হত্যা করেছে এবং কতক্ষণ অব্দি টিকেছিল তার সমীকরণ মিলিয়ে প্রদান করা হয় পয়েন্ট। এই ধরণের খেলার পোষাকি নাম ‘ব্যাটল রয়্যাল’।

বিশ্বব্যাপী ভিডিও গেমের নেশায় আসক্ত খেলোয়াড়েরা অনেকদিন ধরেই ব্যাটল রয়্যাল গেমের স্বাদ পেতে চাইছিল। ব্যাটল রয়্যাল হল আদতে নির্দিষ্ট এরিয়ার মধ্যে বেশ কিছু খেলোয়াড় থাকবে, যাদের লক্ষ্যই হল একে অপরকে খুঁজে বের করে মেরে ফেলা। আর শেষে টিকে থাকা খেলোয়াড়টি হবে বিজয়ী। ব্যাটল রয়্যাল গেমের প্রথম উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, এই শতকের শুরুতে জাপানি সিনেমা ‘বাতারু বোয়াইয়ারু বা ব্যাটল রয়্যাল’। এটি ছিল ‘ব্যাটল রয়্যাল’ নামে লিখিত একটি বইয়ের চলচ্চিত্র রূপ।

মূল কাহিনীতে দেখা গেছে ৪২ জন জাপানি শিক্ষার্থীকে একটি দ্বীপে ছেড়ে দেয়া হয় এবং তাঁদের একে অপরকে হত্যা করতে বাধ্য করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না শুধু একজন বেঁচে থাকে। এর এক যুগ পর ২০১২ সালে হলিউডে প্রায় একই রকম কাহিনীর উপর ভিত্তি করে মুক্তি পায় ‘দ্য হাঙ্গার গেমস’ সিনেমাটি। এটি মুক্তির পরপরই ব্যাটল রয়্যাল গেমের প্রতি আকর্ষণ ও চাহিদা দুই-ই উচ্চহারে বাড়তে থাকে। কিন্তু তখনও গেমের দুনিয়ায় এ ধরণের কোনো পূর্ণাঙ্গ গেম ছিলনা। তবে সে সময় একজন ব্যক্তি এ ধরণের গেমের পূর্ণাঙ্গ রূপ বাজারে আনতে একেবারে প্রস্তুত ছিলেন বলা চলে। তিনি ‘ব্র্যান্ডন গ্রীণ’। পাঠক জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি আইরিশ এই ওয়েব ডিজাইনারের ছদ্মনাম ছিল ‘প্লেয়ার আননোন’। তিনি দুটি গেমের প্রতি আসক্ত ছিলেন, যেগুলোর নাম আরমা ও ডেইজি।

আরমা হচ্ছে অতি বাস্তববাদী সামরিক যুদ্ধের আদলে তৈরি করা গোলাগুলির গেম। নিখুঁত আর জীবন্ত গ্রাফিক্সের অসাধারণ সমন্বয়ের কারণে খুব দ্রুতই গেমারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আরমা। এতে করে অল্পদিনেই অন্য গেম ডেভেলপাররা এর কিছু পরিবর্তিত ভার্সন গেমের জগতে নিয়ে আসে। সেগুলোর মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয় ছিল ব্র্যান্ডন গ্রীণের তৈরি করা ব্যাটল রয়্যাল গেম ‘ডেইজি’।

এক সময় সনি অনলাইন এন্টারটেইনমেন্ট ‘কিং অব দি কিল’ নামে একটি নতুন গেম তৈরি করতে ব্রান্ডন গ্রীণকে নিযুক্ত করে। এরপর ২০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ব্লু হোল থেকে ব্র্যান্ডন গ্রীণের নিকট আরো বড় ধরণের প্রস্তাব আসে। তখন ব্র্যান্ডন কোরিয়ার গেম নির্মাতা চ্যাং হ্যান কিম ও তার দলের সাথে যুক্ত হয়ে যৌথভাবে বানিয়ে ফেলে বহু কাঙ্ক্ষিত পূর্ণাঙ্গ ব্যাটল রয়্যাল গেম ‘পাবজি’ বা প্লেয়ার আননোনস ব্যাটল গ্রাউন্ডস। খেলোয়াড়েরা একে অপরের অচেনা বলেই শুরুতে ‘প্লেয়ার আননোনস’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

বাজারে পাবজির আবির্ভাব ঘটে ২০১৭ সালের মার্চে। সে সময় এর বেটা ভার্সন বাজারে এলেও পরে একই বছরের ডিসেম্বরে এর পূর্ণাঙ্গ ভার্সন প্রকাশিত হয়। সে সময় এরকম গেম বাজারে দ্বিতীয়টি ছিলনা। অসাধারণ গ্রাফিক্স আর দারুণ একশন মিলিয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টিতে জুড়ি নেই পাবজির। ফলে গেমাররা দ্রুত লুফে নেয় এই গেম।

গেমটির অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হল এর ভার্চুয়াল জগত। পাহাড়, নদী হতে শুরু করে নানা ধরণের মানব নির্মিত অবকাঠামো আর স্থাপনার আদলে তৈরি করা হয়েছে এই গেমটি। শুরুতে এর মূল্য ছিল ২০ ডলার। আর মুক্তির ৩ দিনের মাথায় এটি আয় করে বসে ১১ মিলিয়ন ডলার। প্রথম সপ্তাহ থেকেই ক্রমাগতভাবে এর খেলোয়াড় সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ফলশ্রুতিতে গেমটি প্রথম মাস শেষেই দশ লাখ কপি বিক্রি হয়। আর এর পরের দুই মাসের মাথায় পাবজির খেলোয়াড় সংখ্যা ৪০ লাখে এসে দাঁড়ায়।

পাবজি দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা গেম ‘লীগ অব লেজেন্ডস’কে ছাড়িয়ে জনপ্রিয়তার সিংহাসনে বসে। এরপর চাইনিজ গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেনসেন্ট পাবজির এন্ড্রয়েড ও আইওএস সংস্করণ তৈরি করে। সেই থেকে পাবজি নিজের জনপ্রিয়তা ক্রমশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

এখন পর্যন্ত সমস্ত প্ল্যাটফর্ম মিলিয়ে এটি ৬০০ মিলিয়নের বেশি ডাউনলোড করা হয়েছে। যা সর্বকালের সেরা বিক্রিত গেমগুলোর মধ্যে অন্যতম। রোজ অন্তত ৩ কোটি মানুষ পাবজি খেলে। গ্লোবাল চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে শুরু করে সব ধরণের চ্যাম্পিয়নশিপ ও টুর্নামেন্টের আয়োজন হয়ে থাকে পাবজিকে ঘিরে। বাংলাদেশেও এ ধরণের আয়োজন করা হয়।

প্রচন্ড জনপ্রিয় এই গেমের গায়ে লেপ্টে আছে বিতর্ক আর সমালোচনার দাগ। অনলাইনে গেমটির প্রতি শিশুরা বেশ কৌতুহলী। অভিভাবক সমাজের অভিযোগ এই গেমে আসক্ত হওয়ার পর স্বভাবগত দিক থেকে  শিশুরা আক্রমণাত্বক মনোভাবের হয়ে উঠছে। এছাড়া এই গেমে আসক্ত শিশুরা এই গেম খেলা ছাড়া আর কোনো কিছুকেই প্রাধান্য দিতে চায়না। তাঁদের ধ্যানজ্ঞানই থাকে এই গেমে জয়ী হওয়া।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই গেম কেবল শিশু নয়, প্রাপ্ত বয়স্কদেরও মানসিক বিকৃতি ঘটাতে পারে। মাদকের মতোই নেশায় আবিষ্ট করার ক্ষমতা রাখতে পারে এই গেম। কেউ কেউ এই গেম নিষিদ্ধ করার পক্ষেও আওয়াজ তুলেছেন। প্রথমবারের মত ভারতের গুজরাটে গেমটি নিষিদ্ধ করা হয়। দশজন কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে এই গেম খেলার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় গুজরাটে। এছাড়া অভিভাবক পাবজি খেলতে না দেওয়ায় অভিমান করে সন্তানের আত্মহত্যার খবরও পাওয়া গেছে।

অতি সম্প্রতি ভারত-চীন সীমান্ত সংঘাতের জেরে চাইনিজ পণ্য নিষিদ্ধের অংশ হিসেবে পাবজি নিষিদ্ধ করে ভারত সরকার। এতে করে মাত্র এক সপ্তাহেই ৩৪ মিলিয়ন ডলার লস হয় পাবজির। কারণ পাবজি গেমারদের একটা বড় অংশের বাস ভারতেই।

গেমটির সহিংস বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে দূর্বল করে তোলে ও মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে বিধায় সাম্প্রতিককালে নেপালে গেমটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই কারণে পাকিস্তানেও এ বছর নিষিদ্ধ করা হয়েছে গেমটি। এমনকি গেমটি খোদ চীনেও নিষিদ্ধ । উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহিংস মনোভাব সৃষ্টির অভিযোগে পাবজি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।

২০১৯ সালের মার্চে নিউজিল্যান্ডের মসজিদে ভয়াবহ হামলার কথা অনেকেরই মনে আছে। অতর্কিতভাবে বন্দুকহাতে মসজিদে প্রবেশ করে অর্ধশতাধিক মুসুল্লিকে হত্যাকারী ঘাতক এ জাতীয় অনলাইন সহিংসতামূলক গেমের প্রভাবে প্রভাবিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাই পাবজি কোনো হেলাফেলার বিষয় নয়।

পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে দেশে ২০ লাখেরও বেশি সক্রিয় তরুণ পাবজি খেলোয়াড় রয়েছে। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো যেকোনো কিছুরই রয়েছে ভাল খারাপ দুটো দিকই। তাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি করছে, কোন পথে এগুচ্ছে তা খেয়াল রাখাটাও বিশেষ জরুরী। কারণ দিনশেষে ভালোটাই যেন আমাদের হয় সে প্রত্যাশা সকলের।

লেখক- মাহের রাহাত

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *