বলিউডের ‘আয়ুষ্মান’ ভবিষ্যৎ1 min read
Reading Time: 6 minutes‘Slow and steady wins the race.’ – প্রবাদটার সাথে আয়ুষ্মান খুরানাকে মেলানোই যায়। বলিউডের অন্যতম শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে এই তারুণ্যেই নিজের জাত চিনিয়ে ফেলেছেন তিনি। এই ১৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেতে যাচ্ছে তাঁর বহুল আকাঙ্ক্ষিত ছবি ‘ড্রিমগার্ল’। আর পরের দিন? পা দিতে যাচ্ছেন ৩৫তম বসন্তে!
তবে শুধু নিজের জীবনেই বসন্ত নয়, বলিউডেও বসন্তের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। বলিউডের অন্য নায়কেরা যখন সিক্স প্যাক অ্যাবস, ধুন্ধুমার অ্যাকশনের পথে হাঁটছেন সেখানে অভিনব গল্প আর উপস্থাপনের দিকেই মনোযোগ আয়ুষ্মানের। চলুন জেনে নেই বলিউডের এই ‘ড্রিমবয়ে’র আদ্যোপান্ত।
পরিবারেই প্রথম পাঠ
পুনম খুরানা আর খ্যাতিমান জ্যোতিষ পি খুরানার ঘরখানা শূন্য ছিল দীর্ঘ একটা সময়। ১৯৮৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সেই শূন্যতায় পূর্ণতা নিয়ে আসে শিশু ‘নিশান্ত খুরানা’। পুনমের পাঁচবার মিসক্যারিজের পর জন্ম হওয়ায় স্বভাবতই বেশ আদরে মানুষ হতে থাকে চণ্ডীগড়ের নিশান্ত। তিন বছর বয়সে বাবা নাম বদলে রাখেন ‘আয়ুষ্মান খুরানা’।
ঘরের পরিবেশে সবসময়ই ছিল সংস্কৃতির ছোঁয়া। মা পুনম বার্মিজ হলে কী হবে, হিন্দিতে এমএ’র সুবাদে অগাধ পান্ডিত্য ছিল এই ভাষায়। আয়ুষ্মানও হিন্দি ভাষা–সাহিত্য চর্চা করতেন ছোটকাল থেকেই। অন্যদিকে বাবা পি খুরানা তো চণ্ডীগড়ের স্বনামধন্য জ্যোতিষী। ফলে সেখান থেকেও শিক্ষার সরঞ্জাম মিলতে থাকে। পি খুরানা বাঁশিও বাজাতেন। সেখান থেকেই সংগীতে আগ্রহ জন্মে আয়ুষ্মানের। ক্লাসিকালের তামিলও নেন কিছুকাল। তবে সবচাইতে আলাদা ছিলেন দাদী। তিনিই প্রথম আয়ুষ্মানের মাঝে অভিনয়ের বীজ বুনে দেন। দেব আনন্দ, দিলিপ কুমারের নকল করে চমকে দিতেন নাতিকে, এমনকি সিনেমা হলেও নিয়ে যেতেন। আয়ুষ্মান এক সাক্ষাতকারে তাই বলেই ফেললেন, ‘ আমাদের পরিবারে সাহিত্যের প্রভাব ছিল। কিন্তু তাঁর চাইতেও বেশি ছিল ফিল্মের উত্তাপ।‘
তবে আয়ুষ্মান মনে করেন তাঁর প্রতিভা চর্চার সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র ছিল কলেজ জীবন। চণ্ডীগড়ের সেন্ট জনস হাই স্কুলে প্রথম ভাগের পড়াশোনা শেষ করেই ডেভ কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স করেন। এই সময়টাতেই থিয়েটারে পাকা অবস্থান গড়তে বন্ধুদের দিয়ে তৈরি করেন ‘আঘাজ’ ও ‘মঞ্চতন্ত্র’ নামক দুটি নাট্যসংঘ। চণ্ডীগড়ে পথনাটক বেশ জনপ্রিয় হওয়ায় ঘুরতেও হতো প্রচুর। পথনাটকের সুবাদে ‘মুড ইন্ডিগো’, ‘অসিস’ সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সেরার পুরস্কারও জেতেন। পাবলিক স্পিকিংয়ের জন্যও বেশ ক’বার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার আসে তাঁর ঝুলিতে। এভাবে টানা ৫ বছর নাটকের সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে ‘গণ যোগাযোগে’ মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
রোডিস থেকে শোবিজ
পড়াশোনা শেষ করে দুমাসের একটা লম্বা ছুটি চেয়েছিলেন আয়ুষ্মান। কিন্তু বাবার প্রেরণায় মাস্টার্স শেষের পরদিনই মুম্বাই পাড়ি জমাতে হয় তাঁকে। ছোটবেলা থেকেই অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছে ছিল গাঢ়। তাই মুম্বাই আসাটা অবশ্যম্ভাবী ছিল আগে থেকেই। ২০০২ সালে চ্যানেল ভি’র ‘পপস্টারস’ এ সর্বকনিষ্ঠ প্রতিযোগী ছিলেন তিনি। এছাড়া কলেজে থাকতেই এমটিভির জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো ‘ রোডিস’ এর দ্বিতীয় সিজনে চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলেন। সে অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই এগুতে থাকলেন স্বপ্নের শহর মুম্বাইয়ে।
তবে ভাগ্যদেবী চাইছিলেন অন্যকিছু। অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছায় পোর্টফলিও জমা দিলেও শেষমেশ তাঁর চাকরি মেলে দিল্লীর বিগ এফএম রেডিওতে। তবে সেখান থেকে খালি হাতে ফিরতে হয় নি তাঁকে। দুই বছর ধরে ‘মে তেরা আয়ুষ্মান’, ‘বিগ চায়ে’ প্রভৃতি জনপ্রিয় শো’র বদৌলতে ২০০৭ সালেই ‘ইয়াং এচিভার এ্যাওয়ার্ড’, ‘ভারত নির্মাণ এ্যাওয়ার্ড’ পান।
এরপরের ধাপটা ছিল আয়ুষ্মানের জন্য মাইলফলক। এমটিভিতে ‘Wassaup’, ‘The voice of youngistan’ উপস্থাপনা করেন। ‘India’s Got Talent’, ‘Stripped’, ‘Music ki Maha Muqabla’, ‘Just Dance’, ‘Mtv Rock On’ প্রভৃতি অনুষ্ঠানেও নিয়মিত উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। তবে ‘Extra Innings T20 –Indian Premier League season 3’ তাঁকে বাড়তি সম্মান এনে দেয়। এর আগে লেগ স্পিনার হিসেবে ‘অনূর্ধ্ব–১৯’ এ খেলার অভিজ্ঞতাও ছিল।
চলচ্চিত্রের নতুন রাজপুত্র
অভিনয়জগতের টানেই মুম্বাই এসেছিলেন আয়ুষ্মান। ছবিতে নাম লেখানোর আগে বেশ কিছু কাজও করেছিলেন। স্টার প্লাসের ‘কায়ামাত’, জি নেক্সটের ‘এক থি রাজকুমারী’, এমটিভির ‘চেক দে ইন্ডিয়া’ তে দেখা যায় তাঁকে।
২০১২ সালের ‘ভিকি ডোনার’ দিয়ে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু করেন তিনি। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে পরিচালক সুজিত সরকার এমটিভিতে আয়ুষ্মানের উপস্থাপনা দেখেই নির্বাচন করে ফেলেন তাঁকে। এরপরের গল্পটা ইতিহাস। সে বছরের অন্যতম ব্যবসাসফল ছবিতে পরিণত হয় ‘ভিকি ডোনার’। ফিল্মফেয়ার, স্টারডাস্ট সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেরা উদীয়মান অভিনেতা, সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতে নেন। এই ছবিতে আয়ুষ্মানের গাওয়া ‘পানি দা রাং’ গানটিও বিপুল জনপ্রিয়তা পায়, সাথে সেরা গায়কের পুরস্কারও উঠে আসে হাতে।
এরপরের বছরই ‘নটাংকি সালা’ মুক্তি পায়। খুব একটা সাড়া না পড়লেও আয়ুষ্মান প্রশংসিত হন এতে। সোনম কাপুরের বিপরীতে ‘বেওকুফিয়া’ (২০১৪), পরিণীতি চোপড়ার সাথে ‘মেরি পেয়ারি বিন্দু’ (২০১৭), ‘হাওয়াইজাদে’ (২০১৫) বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। তবে রোমান্টিক কমেডি ‘দাম লাগা কে হাইসা’ (২০১৫) দিয়ে আবার নিজ ফর্মে ফিরে আসেন।
তবে ২০১৭ সাল ছিল আয়ুষ্মানের জন্য ছিল পয়মন্ত। ‘শুভ মঙ্গল সাবধান’ এবং ‘বারেলি কি বারফি’র সুবাদে দর্শকের ভালোবাসা পুরোদমে ফিরে পান। ভূমি পেদনেকারের সাথে তাঁর জুটি সব মহলের দর্শকের কাছে প্রশংসা কুড়ায়। ‘বারেলি কি বারফি’ তে রাজকুমার রাওয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করাও পায় আলাদা নজর।
তবে সব ছাড়িয়ে যায় ২০১৮ এর সাফল্যে। ‘আন্ধাধুন’ ও ‘বাধাই হো’র অসামান্য সাফল্যের পর গোটা বলিউড নড়েচড়ে বসে। ‘আন্ধাধুনে’ অন্ধ পিয়ানবাদক চরিত্রে টাবুর সাথে অপূর্ব রসায়ন চমকে দেয় সবাইকে। আর ‘বাধাই হো’ চটকদার গল্পই বুঝিয়ে দেয় আয়ুষ্মানের স্ক্রিপ্ট বাছাইয়ের ধরণ আর সবার থেকে একেবারেই আলাদা। আন্ধাধুনের কল্যাণে জাতীয় পুরস্কার সহ ফিল্মফেয়ার, জি সিনে এওয়ার্ডস বগলদাবা করেন তিনি।
সর্বত্র আয়ুষ্মান
নায়ক হিসেবেই শুধু নয়, গায়ক হিসেবেও সমান পরিচিত আয়ুষ্মান। ‘পানি দা রাং’, ‘ইয়ে হি হু মে’, ‘ও মন’, ‘নাজম নাজম’, ‘মেরা মান’ প্রভৃতি গান গেয়ে শ্রোতামনে ঠাই পেয়েছেন আগেই।
কঠিন সময়ের লড়াই
একেবারে বাইরের কেউ এসে বলিউডে শক্ত জায়গা করে নিয়েছে –তেমন একটা দেখা যায়না। সেদিক দিয়ে আয়ুষ্মানের যাত্রাটাও সহজ ছিলনা। ‘নায়কের মতো চেহারা নয় তোমার।’- এ কথাও বহুবার শুনতে হয়েছে। তবে দমে যাননি। ধাপে ধাপে এগুনোর পাশাপাশি বলিউডের কিছু অন্ধকার রূপও দেখা হয়েছে তাঁর। প্রাথমিক দিকে পোর্টফলিও নিয়ে বেশ কিছু পরিচালকের কাছে ধর্না দিলেও কাজ মেলেনি। উল্টে কাস্টিং কাউচের প্রস্তাবও পেয়েছিলেন এক সমকামী খ্যাতিমান পরিচালকের কাছ থেকে। ‘ভিকি ডোনারে’র পর পরিচালক কুনাল কোহলির সাথে একটি ছবিতে কাজ করার কথা থাকলেও পরে ছেড়ে দেন। কুনাল আয়ুষ্মানের দিকে আঙুল তুললেও মিডিয়ার কাছে নিজস্ব যুক্তি তুলে ধরেন বিনয়ের সাথেই।
২০১১ সালে ছোটবেলার প্রেমিকা তাহিরা কাশ্যপের সাথে গাঁটছড়া বাঁধেন। দুজনেরই প্রথম প্রেম, বন্ধুত্বটাও ছিল বরাবরের মতো অটুট। প্রতিটি ছবি সাইনের আগে তাহিরার সাথে আলোচনা করে নেন আয়ুষ্মান। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তাহিরার ক্যান্সার ধরা পড়ে। রাজিভ মাসান্দের এক সাক্ষাতকারে সে সময়ের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে জানান, ‘ তাহিরার প্রথম কেমো থেরাপি পড়েছিল ‘বাধাই হো’ মুক্তির দিন। একপাশে তাহিরা, আরেকপাশে বক্স অফিস কালেকশনের উপাত্ত– দুটাতেই সমান মনোযোগ দিতে হচ্ছিল আমাকে। সময়টা কঠিন হতে পারতো, কিন্তু তাহিরা বরাবরই নিজে শক্ত ছিল। ওই আমাকে শক্তি দিয়েছে বেশি।‘
এ বছরের চমক
সহস্র বছরের ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে সংগীত, নৃত্যকলা, সাহিত্যের ইতিহাস। কিন্তু এর পাশে দগদগে ঘা হয়ে এই একুশ শতকেও টিকে আছে ঘৃণ্য জাতিবিভেদ। ভারতীয় সংবিধানের ১৫তম অনুচ্ছেদে যদিও সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সমান অধিকারের উল্লেখ আছে, কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও ধর্ম– বর্ণের নামে হত্যা, দাঙ্গা, রাজনীতি ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। ‘Article 15’ ছবির গল্পটাও এই প্রেক্ষাপটেই নির্মিত। এতে পুলিশ অফিসার অয়ন রঞ্জন চরিত্রে ইতোমধ্যেই দর্শক–সমালোচকের নজর কেড়েছেন।
এবছর আরও দুটি ছবিতে পাওয়া যাবে তাঁকে। ১৪ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেতে যাচ্ছে কমেডি ঘরানার ‘ড্রিমগার্ল’, যেখানে নারিবেশি একজন কলসেন্টার কর্মীর চরিত্রে দেখা যাবে আয়স্মানকে। এই ছবির জন্য নারী কণ্ঠে কথা বলাও আয়ত্ত করতে হয়েছে তাঁকে। এছাড়া বছরের শেষ ভাগে ‘বালা’ ছবিতে নামচরিত্রে মিলবে ‘কেশহীন’ আয়ুষ্মানের দেখা। দুই ছবি নিয়েই দর্শকের আগ্রহের পারদ বেশ উপরে।
২০০৭ সালের সুনসান রাত। ব্যালকনি থেকে ‘ওম শান্তি ওমে’র বোর্ডিং দেখে আয়ুষ্মান প্রায়ই ভাবতেন ‘ইস! এই বোর্ডটিতে যদি আমি থাকতাম!’ পাঁচ বছর পর সেই স্বপ্নটাই পূরণ হয়েছিল, ‘ভিকি ডোনারে’র হাত ধরে। কাজকে ভালোবেসে ধৈর্যের সাথে এগিয়ে যাওয়াই বলিউডের নতুন পথিকৃতের একমাত্র প্রয়াস। সামনের দিনগুলোতে ভিন্নধারার কাজ করেই দর্শকদের বিনোদিত করতে চান তিনি।