আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ এবং তুর্কি রাজনীতি1 min read
Reading Time: 3 minutesগত ২৭ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যকার যুদ্ধে মস্কোর মধ্যস্থতায় আপাতত বিরতি দেয়া হয়েছে। রুশ পররাষ্টমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ জানান দুই দেশ এখন ‘স্বতন্ত্রভাবে’ আলোচনা করবে। মূলত মরদেহ উদ্ধার এবং বন্দী বিনিময়ের সুবিধার জন্য এই যুদ্ধ বিরতি।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত পতনের পর নাগোর্নো কারাবাখ অঞ্চলকে ঘিরে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যে দ্বন্দের শুরু, সেটিই আবার নতুন করে শুরু করেছে দুই দেশ। নব্বই পরবর্তী সময়ে দফায় দফায় দুই দেশের মাঝে সংঘর্ষ হলেও তার স্থায়িত্ব ছিল খুবই কম।
নাগোর্নো কারাবাখ বিরোধ
নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন বেশ কিছু বিরোধপূর্ণ অঞ্চল তৈরি করে গিয়েছিল। আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া দুটোই সোভিয়েত ভাঙ্গনের ফলে সৃষ্ট রাষ্ট্র। আর প্রতিবেশী এই দুই দেশের মাঝে সংঘাতের ইতিহাস অনেক পুরাতন। আজারবাইজান মূলত মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র। তুরস্কের সাথে যাদের সদ্ভাব খুব বেশি। অটোমান শাসনামলেই আজারবাইজান ও তুরস্ক একত্রে চুক্তি ও ভ্রাতৃপ্রেমে আবদ্ধ ছিল। পক্ষান্তরে আর্মেনিয়া খ্রিস্টান রাষ্ট্র। যাদের সবচেয়ে বড় মিত্রের তালিকা করতে গেলে প্রথমেই আসে রাশিয়ার নাম।
সোভিয়েত পতনের সময় থেকেই নাগোর্নো কারাবাখ অঞ্চলের মালিকানা ছিল আজারবাইজানের। আন্তর্জাতিকভাবেও এই অঞ্চলটি আজারবাইজানের বলে স্বীকৃত। ৮০’র দশকের শেষভাগে আর্মেনিয়ান সংসদ এই অঞ্চলকে আর্মেনিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।
সোভিয়েত পতনের পর বেশ কিছু সময় নাগোর্নো কারাবাখ বিরোধ নিয়ে উত্তপ্ত ছিল আজারবাইজান-আর্মেনিয়া অঞ্চল। পাশ থেকে ইরান, রাশিয়া ও তুরস্ক ছিল প্রভাবক হিসেবে। ১৯৯০ পর্যন্ত এই অঞ্চল নিয়ে চলমান সংঘাতে ১ লাখের বেশি মানুষ গৃহহারা হন। মারা যায় প্রায় দশ হাজার বেসামরিক লোকজন। ১৯৯৪ সালে রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে জাতিগত আর্মেনিয়ানরা এই অঞ্চলকে দখল করে নেয়।
তবে মূল ঘটনার বাঁক আরেকদিকে। নাগোর্নো কারাবাখ অঞ্চলে বসবাসকারী জাতিগত আর্মেনিয়ানরা নিজেদের স্বাধীন দাবি করে। তাদের নিজস্ব সংবিধান ও সামরিক বাহিনীও আছে। কিন্তু আজারবাইজান-আর্মেনিয়া কোন দেশই তা মেনে নেয়নি।
তুরস্ক কেন এত আগ্রহী
আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখছে তুরস্ক। তুরস্কের হস্তক্ষেপ করার কারণেই পুরো যুদ্ধে অনেক বেশি এগিয়ে আজারবাইজান। অন্যদিকে আর্মেনিয়ার মিত্র ফ্রান্স ও রাশিয়া এখনো বিবৃতি ও হুশিয়ারি দিয়ে চলেছে। আর্মেনিয়ানদের ভরসার জায়গা সিরিয়ার বাশার আল আসাদ। যিনি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বিরোধী এবং সেই সূত্রে আর্মেনিয়াকে সাহায্য করছেন।
এই যুদ্ধে তুরস্কের এত আগ্রহের পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যার প্রথমটি জ্বালানী সরবরাহ। আজারবাইজানের ওই ককেশাস অঞ্চল জ্বালানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জ্বালানির উৎস এবং সরবরাহ ব্যবস্থা- এই দুই কারণে তুরস্ক এখন পর্যন্ত রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই অঞ্চল আজারবাইজান দখলে আনতে পারলে রাশিয়ার কাছ থেকে সরে আসা এরদোয়ান সরকারের জন্য অনেক সহজ হয়ে উঠবে।
তুরস্কের আমদানি হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে দেশের মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ গ্যাস তারা আমদানি করেছে আজারবাইজানের কাছ থেকে। আজারবাইজান কাস্পিয়ান সাগরে পাওয়া তেলও তুরস্কের কাছেই বিক্রি করে।
রাশিয়ার সাথে তুরস্কের চলমান জ্বালানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২১ সালে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম দাবী করছে, এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে নতুন করে চুক্তি নবায়ন করবে না আঙ্কারা। তার বদলে ট্রান্স আনাতোলিয়ান গ্যাস পাইপলাইন ব্যবহার করে আজারবাইজান থেকে তেল আনবে তুরস্ক।
এর বাইরেও দুটি আলাদা কারণ আছে। প্রথমত তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধীদল উভয়েই আজারবাইজানের প্রতি সংবেদনশীল। এর বাইরেও আঞ্চলিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সেই দেশটির সমর্থন ব্যাপক প্রয়োজন তুরস্কের। আর সেই সাথে ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে তুরস্ক ও আজারবাইজান শপথ নিয়েছিল একে অন্যের পাশে থাকবার।
তুর্কি-আজারি সন্ধি
যদিও দুটো দেশ সেই অনাদিকাল থেকেই আলাদা। তারপরেও তুর্কি এবং আজারি নাগরিকদের বিশ্বাস, তাদের উৎস এক এবং তারা একে অন্যের ভাই। তাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসও একই।
তুরস্ক যখন অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে তখনই নিজেদের মাঝে সন্ধি স্থাপন করে দেশ দুটি। ১৯১৮ সালে আজারবাইজান- আর্মেনিয়া ও রাশিয়ার আক্রমণের স্বীকার হলে অটোমান শাসকরা আজারবাইজানকে সাহায্য করে। এবং তারাই আজারবাইজানকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল। তখন থেকেই আজারি ও অটোমান শাসকরা চুক্তিবদ্ধ হয়, তারা যেকোন বিপদে একে অন্যের পাশে থাকতে প্রস্তুত।
এছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান শাসকরা বহু আর্মেনিয়ান নাগরিক হত্যা করে। সেসময় অটোমান শাসকরা আর্মেনিয়ানদের সন্দেহ করতো কেবলমাত্র খ্রিস্টান হবার কারণে। আর্মেনিয়া তখন অটোমান শাসনের অধীনে থাকলেও তারা অনুগত ছিল খ্রিস্টান দেশগুলোর। এই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞকে আর্মেনিয়া গণহত্যা বলে উল্লেখ করে এবং এখনো এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। প্রতি বছরের ২৪শে এপ্রিল আর্মেনিয়া গণহত্যার সূচনা দিবস পালন করে থাকে।
ক্ষয়ক্ষতি
আর্মেনিয়ার স্টেপানাকার্ট শহরে আজারি বাহিনীর হামলার একটি ভিডিও ফুটেজ এরইমাঝে প্রকাশ করেছে আর্মেনিয়া রাজধানী ইয়েরেভান। আর্মেনিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আজারবাইজানের হামলায় বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে। এছাড়াও এক টুইটার বার্তায় আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, আজারি বাহিনী স্টেপানাকার্ট ও শুশি শহরে তীব্র রকেট হামলা চালিয়েছে।
আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আন্না নাগদলায়ান বলেন, সোমবার স্টেপানাকার্টে অনবরত হামলা চালিয়েছে আজারবাইজানের সামরিক বাহিনী।
অন্যদিকে, আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবী, আর্মেনিয়ার বাহিনী রোববার বাকুর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর গানজা ও চতুর্থ বৃহত্তম শহর মিনগেসভিরে হামলা করে। এরপর আরো তিনটি শহর বেইলাগান, বারডা ও টার্টারে হামলা চালিয়েছে আর্মেনিয়ান সামরিক বাহিনী।
আজারবাইজানের বৈদেশিক নীতি বিষয়ক বিভাগের প্রধান হিকমত হাজিয়েভ এক টুইটে জানিয়েছেন, মিনগেসভিরে শহরে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। সেখানে এক লাখ লোক বসবাস করছে। উল্লেখ্য, মিনগেসভির শহরটি আর্মেনিয়া সীমান্ত থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।
এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী, ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে তিনশ’র বেশি মানুষ মারা গেছেন এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের জনসংখ্যার অর্ধেক প্রায় ৭০ হাজার মানুষ ঘড়ছাড়া হয়েছেন।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ