বিশ্ব

আমেরিকার সরকার বিরোধী সশস্ত্র মিলিশিয়া গ্রুপ1 min read

আগস্ট ৭, ২০১৯ 5 min read

author:

আমেরিকার সরকার বিরোধী সশস্ত্র মিলিশিয়া গ্রুপ1 min read

Reading Time: 5 minutes

মিলিশিয়া আন্দোলন বা মিলিশিয়া মুভমেন্ট এর আধুনিক পর্যায় শুরু হয় ১৯৯০ এর দশকে। মিলিশিয়া মুভমেন্টের আন্দোলনকারীরা স্বকীয়তাবোধ এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বে প্রবলভাবে বিশ্বাসী। এ আন্দোলন বহুকাল আগে থেকে হয়ে আসলেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় ১৯৯০ এর দশকে। মিলিশিয়া আন্দোলনের পূর্বনাম ছিল ‘শার্ট মুভমেন্ট’।

ষাট এর দশকে উগ্র ডানপন্থীদের সশস্ত্র ‘মিনিটম্যান’কে মোকাবেলা করার জন্য মিলিশিয়া গ্রুপের সৃষ্টি। ৭০ এর দশকে যখন দেখা গেল মিলিশিয়া বাহিনী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তখন আমেরিকার ৪০টি অঙ্গরাজ্যজুড়ে মিলিশিয়া বাহিনীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এতে আরও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। গোটা আমেরিকার আনাচে কানাচে গজিয়ে ওঠে মিলিশিয়া গ্রুপ। শ্বেত আধিপত্যবাদী, জায়নবাদ বিরোধী, নব্য-ফ্যাসিবাদ সমর্থক, নব্য-নাৎসিবাদ সমর্থক, অ্যান্টি-সেমেটিক প্রভৃতি ভাবাদর্শ নিয়ে গড়ে ওঠে ছোট-বড় মিলিশিয়া গ্রুপ।

এ গ্রুপ সৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সরকার ও রাষ্ট্র কর্তৃক শোষণ থেকে মুক্তি, পরাধীনতা থেকে রেহাই এবং আমেরিকা কর্তৃক সৃষ্ট সর্বগ্রাসী ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ এর পতন। মিলিশিয়া গ্রুপের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ব্যক্তিগত অস্ত্র মালিকানায় নিষেধাজ্ঞা। তারা এটাকে সরকারি শোষণ মনে করত। এছাড়া বিভিন্ন পণ্যের উপর আরোপিত কর এবং বিভিন্ন আইন মেনে চলাকেও তারা সরকারি শোষণ মনে করে। আর ব্যক্তিগতভাবে অস্ত্র সংরক্ষণকে মিলিশিয়ানরা সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা মনে করে। কারণ তাদের বিশ্বাস রাষ্ট্রীয় বাহিনী তাদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। তাই তারা নিজেরাই নিজেদের নিরপত্তা নিশ্চিত করবে।

এতকিছুর পরও এই মিলিশিয়া আন্দোলন সংঘবদ্ধ হওয়ার অভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছিল না। এর মাঝেই গড়ে ওঠে ‘সারভাইবালিজম’ নামের অদ্ভুত এক রীতির। কিছু মানুষের মাঝে অদ্ভুত এক বিশ্বাস দানা বাঁধতে শুরু করে। তারা মনে করে আমেরিকান নাগরিক সমাজ খুব শীগ্রই পারমাণবিক বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাবে। এই ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষের উচিত শহুরে জীবন ত্যাগ করে গ্রামে বা মফস্বলে গিয়ে থাকা এবং অস্ত্র চালনা শিখে নিজের জীবন নিজে রক্ষা করা। এই সার্ভাইবালিস্টরা মিলে মিলিশিয়ানদের মতো গ্রুপ গড়ে তোলে তবে ভাবাদর্শের দিক থেকে এরা মিলিশিয়ানদের থেকে খানিকটা ভিন্ন।

কিছুদিন পর মিলিশিয়ানদের মাঝে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। কয়েকজন উদারপন্থী মিলিশিয়ান নেতা চাইত সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে সহায়তা করতে। অর্থাৎ সরকারকে একেবারে পরিত্যাগ না করে সরকারি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতোই দেশ ও সমাজের নিরাপত্তা বিধানে কাজ করবে। কিন্তু এ ধরণের মিলিশিয়ানদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। এছাড়াও মিলিশিয়ানদের প্রধান নীতিই ছিল তীব্র সরকারবিরোধী নীতি। তাই তাদের মাঝে সরকারের সাথে বন্ধুতার ইচ্ছাটা বেশিদিন টেকেনি।

অবশেষে ৯০’র দশকের শুরুতে এসে সরকারবিরোধী গ্রুপগুলো একজোট হতে শুরু করে। মিলিশিয়া গ্রুপ, শ্বেত আধিপত্যবাদী গ্রুপ, উগ্র ডানপন্থী গ্রুপ, সারভাইবালিস্ট গ্রুপ, ট্যাক্সবিরোধী গ্রুপ সকলে মিলে একত্রিত হয়ে নতুন এক গ্রুপ তৈরি করে। এ গ্রুপের নাম দেয় ‘প্যাট্রিয়ট মুভমেন্ট’। লোকে বলে, নামেই পরিচয়। ‘দেশপ্রেম আন্দোলন’ নামটা শুনেই তাদের সমর্থকদের সংখ্যা হুরমুড় করে বাড়তে লাগল। দেশব্যাপী তাদের আন্দোলনে সমর্থন আসতে লাগল। সেই সময়টাতেই আবার আমেরিকায় ইন্টারনেট ব্যবহার করা শুরু হয়। তাই প্যাট্রিয়ট মুভমেন্ট ইন্টারনেটের বদৌলতে বিশ্বব্যাপী ছড়াতে শুরু করে।

১৯৯২ সালের ২১ আগস্ট থেকে শুরু হয় আধুনিক মিলিশিয়া আন্দোলন। অনেকটা কাল্পনিক গল্পের মতো ফ্লোরিডার নেপলস শহরের রুবি রিজ নামক স্থান থেকে এর কাহিনী শুরু হয়। অনেকদিন ধরে অস্ত্র মামলায় পলাতক আসামী রেন্ডি উইভারকে অ্যামবুশ করার জন্য মার্কিন মার্শালসের ৬ জন সদস্য সেদিন গিয়েছিলেন রুবি রিজে। মার্শালস গোপন সূত্রে খবর পেয়েছিল যে, রেন্ডি উইভার রুবি রিজে একটি ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে বাস করে। সেই খবরের ভিত্তিতেই এখানে আসা। এসে দেখেন সত্যি সত্যিই উইভার একটি ছোট্ট কুঁড়ে বসবাস করেন। বাড়ির কাছে পৌঁছাতেই বিপত্তি বাঁধে। উইভারের কুকুর স্ট্রাইকার মার্শালসদের উপিস্থিতি টের পেয়ে তীব্র আক্রোশে গর্জন শুরু করে। কুকুরের হইচই শুনে প্রথমে বেরিয়ে আসে উইভারের ১৪ বছরের ছেলে স্যামি ও তার বন্ধু কেভিন। তাদেরকে অনুসরণ করে উইভারও ঘর থেকে বেরিয়ে কুকুরের পেছন পেছন একটি ঝোপের কাছে আসেন যেখানে আগে থেকে মার্শালস সদস্যরা লুকিয়ে ছিলেন। তারপরের দশ মিনিট নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে তবে এটা সত্যি যে, এই দশ মিনিটে তিনটি প্রাণের বিসর্জন ঘটে। উইভারের ছেলে স্যামি, কুকুর স্ট্রাইকার এবং একজন মার্শালস সদস্য বিল ডেগান।

তারপর কোনরকমে উইভার ছেলের মৃতদেহ ঘরের সামনে রেখে ভিতরে ঢুকেন। তার সাথে কেভিনও প্রবেশ করল। আর আগে থেকে ঘরের ভিতরে ছিলেন উইভারের স্ত্রী ভিকি। বাড়িতে বোমা থাকতে পারে এই সন্দেহে তারা ২২ আগস্ট এফবিআই এবং স্থানীয় পুলিশ আনান। সেদিনই তাদের স্নাইপারের গুলিতে নিহত হলেন ভিকি। ঘরের ভেতরে থাকা বাকি দুইজন গুরুতর আহত হয়। তাদেরকে ইউএস মার্শালসরা তখনও গ্রেপ্তার না করে বাড়িতে আটকে রাখেন।

দিকে দিকে ছড়াতে থাকে একটি নির্দোষ পরিবারের উপর স্থানীয় সরকারের নির্মম অত্যাচারের খবর। এগিয়ে আসে ‘আরিয়ান ন্যাশনস’ নামের একটি শ্বেত আধিপত্যবাদী সংঘটন এবং আরো কিছু মিলিশিয়া ভাবাদর্শের সদস্য। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন পপুলিস্ট পার্টির সাবেক রাষ্ট্রপতি মনোনয়নপ্রার্থী বো গির্টজ। এরপর উইভারের জনসমর্থন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ফলে অবরোধ কর্মসূচী এফবিআই এবং মার্শালসদের নিয়ন্ত্রণের  বাইরে চলে যায়। সাধারণ মানুষের চাপে বো গির্টজের নেতৃত্বে ফেডারেল পুলিশ রুবি রিজ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়।

পরবর্তীতে এই ঘটনাটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কোন পক্ষ থেকে আগে গুলি ছোড়া হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে সাধারণ জনগণ বিশ্বাস করে যে, গুলি মার্শালসদের পক্ষ থেকেই আগে ছোড়া হয়েছিল। এ ঘটনায় এফবিআই যুক্ত হবার পর উইভারের স্ত্রী ভিকিকে খুন করা হয়েছিল। বিচারে অবরোধ পরিচালনাকালীন এফবিআইয়ের এর প্রধান মাইকেল কাহো দেড় বছরের কারাদণ্ডে দন্ডিত হন। এ ঘটনার পর এফবিআই এর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমতে শুরু করে। এদিকে মিলিশিয়া গ্রুপের প্রধান নীতিই ছিল সরকারের প্রতি অনাস্থা। রুবি রিজের ঘটনাটি মিলিশিয়া আন্দোঅলনকে আরো একধাপ এগিয়ে নেয়।

রুবি রিজের ঘটনার পর আরিয়ান ন্যাশনের মতো উগ্র ডানপন্থী সংঘটনগুলো রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে ওঠতে থাকে। এরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বন্ধুর পরিবর্তে শত্রু ভাবা শুরু করে। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিজেরাই অস্ত্র রাখতে শুরু করে এবং ছোট বড় গ্রুপগুলো একত্রিত হতে শুরু করে। ৯০’র দশকের মাঝামাঝি থেকে মিলিশিয়ান শ্বেত আধিপত্যবাদীরা স্থানীয় সমস্যায় জড়াতে শুরু করে। সেসব সমস্যা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য তারা জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন ফেডারেল সংস্থা  যেমন— ফরেস্ট সার্ভিস, ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট এর কর্মচারীদের কাজে বাঁধা দেয়, হামলা চালায়।

মিলিশিয়া বাহিনীর জনসমর্থন এবং তাদের জনসমক্ষে তাদের কর্মসূচী দিন দিন বাড়ছিল। কিন্তু সেই বিকাশে বাঁধ সাধে অতি উৎসাহী এক মিলিশিয়ানের ন্যাক্কারজনক কান্ড। টিমোথি ম্যাকভেই নামের সেই ব্যক্তি ভেবেছিলেন বোমা মেরে একটি সরকারি ভবন ধ্বসিয়ে দিতে পারলে তাদের আন্দোলন আরো সক্রিয় হবে। সে লক্ষে, ম্যাকভেই ১৯৯৫ সালে ওকলাহোমায় তার সেই পূর্বপরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞটি চালান। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়। কারণ সেই হামলায় ১৫৮ জনের প্রাণহানি ঘটে।

কিন্তু এতে মিলিশিয়া গ্রুপে তেমন একটা ভাঙন ধরাতে পারে নি। কেননা ততদিনে মিলিশিয়া নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে এবং উগ্র ও অন্ধ সমর্থকদের দলে ভিড়িয়ে নিয়েছে। তখন সমগ্র আমেরিকাজুড়ে গঠিত হয়েছে ৯০০’র অধিক আধাসামরিক গ্রুপ, যাদের মোট সক্রিয় সদস্য সংখ্যা ৪০ হাজারের অধিক। সাথে আরো আছে প্রায় আড়াই লাখের মতো সক্রিয় সমর্থক ও স্থানীয় পৃষ্ঠপোষক। বুশ ক্ষমতায় থাকাকালীন মিলিশিয়া গ্রুপকে কিছুটা দুর্বল ও সংখ্যায় কম মনে হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা মোটেও ঠিক নয়। বরং তখন ছোট ছোট আধাসামরিক গ্রুপগুলো মিলে তৈরি হয়েছিল বড় একটা গ্রুপ।

ইদানিং যেসব মিলিশিয়া আমেরিকায় সক্রিয় অবস্থানে আছে সেগুলো হল, ‘ থ্রি পার্সেন্টারস’, ‘মিশিগান মিলিশিয়া’, ‘মিলিশিয়া মন্টানা’, ‘ওথ কিপারস’ ‘নিউইয়র্ক লাইট ফুট’। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এদের গঠনগত পরিবর্তন এলেও নীতিগত পরিবর্তন হয়নি। এখনও তাদের প্রধান বিশ্বাস হলো ফেডারেল সরকারের ষড়যন্ত্র এবং ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’। অবশ্য সাম্প্রতিককালে মিলিশিয়া গ্রুপগুলো কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শ্বেত আধিপত্যবাদী এবং কট্টর ডানপন্থী।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মিলিশিয়া গ্রুপের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কেননা ট্রাম্প নিজেও একজন শ্বেত আধিপত্যবাদী। এবার তাহলে তারা কিভাবে সরকারের বিরোধিতা করবে? এবার তাদের আন্দোলন একেবারে বন্ধ না করে তাদের বাহ্যিকরূপের কিছুটা পরিবর্তন আনে। এখন তারা পূর্বে সরকারের সাথে একজোট হয়ে কাজ করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে। পোর্টল্যান্ডে তো রীতিমতো রিপাবলিকান সভা সমাবেশের দায়িত্বও মিলিশিয়ানদের দেওয়া হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতের কথা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটা পরিষ্কার যে, রিপাবলিকানরা উগ্র স্বকীয়তাবাদী গোষ্ঠীদের কিছুটা হলেও বশে আনতে পেরেছে। কতদিন এ লোক দেখানো মিষ্টতা টেকে এখন সেটাই দেখার বিষয়।

লেখক- নিশাত সুলতানা                                                                                                                       

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *