বিশ্ব

একজন মাহাথির মোহাম্মদ ও মালয়েশিয়ার রাজনীতির বাঁক1 min read

মার্চ ৭, ২০২০ 3 min read

author:

একজন মাহাথির মোহাম্মদ ও মালয়েশিয়ার রাজনীতির বাঁক1 min read

Reading Time: 3 minutes

সাল ১৯২৫। বিশ্ব কয়েক বছর আগেই প্রত্যক্ষ করল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা। পৃথিবীর  মানুষ তখন অসাধারণ পরিবর্তনের প্রতীক্ষায়। সময়টায় ছিল বিজ্ঞানের উৎকর্ষেরও। সেই বছরের ১০ জুলাই অখ্যাত মালয়েশিয়ার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় কেদাহ অঞ্চলের সেতার নামক গ্রামে জন্ম নেয় একশিশু।

তখন কে বা ভেবেছিল এই শিশুই একদিন হবে আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি। হ্যাঁ আপনি ঠিক ধরেছেন। এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের কথাই এতক্ষণ বলছিলাম। যার পুরো নাম মাহাথির বিন মোহাম্মদ।

নয় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মাহাথির মোহাম্মদ। তার স্কুল শিক্ষক পিতা পরবর্তীতে সরকারি অডিটর হিসেবে কাজ করেছেন।

ছোটবেলায় মাহাথির ভর্তি হয়েছিলেন মালয়ের একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে। অন্য সবাইকে পেছনে ফেলে তিনি হতেন ক্লাসের ফার্স্টবয়। ইংরেজি শিক্ষক বাবার বদৌলতেই হয়ত শিখেছিলেন অসাধারণ ইংরেজি। স্কুলের-কলেজের পাঠ চুকিয়ে মাহাথির ১৯৪৭ সালে ভর্তি হন সিঙ্গাপুরের কিং এডওয়ার্ড সেভেন মেডিকেল কলেজে। সেখানে মাহাথির সহ মালয় শিক্ষার্থী ছিল মোটে সাতজন। এরপর ১৯৫৩ সালে সিঙ্গাপুর ফেরত মাহাথির একজন সরকারি চিকিৎসক হিসেবে চাকুরিতে যোগ দেন। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার ঠিক পূর্বে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে নিজ শহর এলোর সেতারে একটি প্রাইভেট ক্লিনিক শুরু করেন। যার নাম ছিল মাহা-ক্লিনিক।

মাহাথিরের মতে চিকিৎসক হিসেবে তার প্রশিক্ষণ আর চর্চা তার মধ্যে এনেছিল ধীরস্থিরবোধ এবং যেকোনো পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা । তিনি একবার ‘দ্য ইকোনোমিস্ট, পত্রিকাতে বলেছিলেন “চিকিৎসা বিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের জন্য রাজনীতি একটি ভাল পেশা। একজন ডাক্তার রোগীকে পর্যবেক্ষন করেন, স্বাস্থ্যগত ইতিহাস রেকর্ড করেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন, ল্যাব পরীক্ষা করেন এবং চুড়ান্তভাবে রোগ নির্ণয় করেন। এ প্রক্রিয়া রাজনীতির মতই”।

এই মহামতি ১৯৭৪ সালে মন্ত্রী হবার আগ পর্যন্ত চিকিৎসা পেশা অব্যাহত রেখেছিলেন।

ছাত্র অবস্থাতেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন মাহাথির। এমনকি সরকারি ডাক্তার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়েও রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চেয়েছিলেন। এমন কথা প্রচলিত আছে শুধু রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। মালয়েশিয়ার জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও) যোগ দেন তিনি।

মালয়েশিয়ার মূল ধারার রাজনীতিতে মাহাথিরের প্রথম প্রবেশ একজন সংসদ সদস্য হিসেবে। সালটা ছিল ১৯৬৪ যখন মাহাথিরের বয়স ছিল ৩৯ বছর। তবে ১৯৬৯ এ রাজনীতি থেকে অনেকটা ছিটকে পরেন। সে বছরেই নিজ দলের প্রধান এবং সে সময়কার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টেংকু আবদুর রহমানের সাথে তার মতবিরোধ হয়। এরপর তিনি তিন বছর রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। মূলত ১৯৬৯ সালের ৩০ মে চীনাদের সাথে মালয়ীদের মধ্যকার দাঙ্গার জন্য টেংকু আব্দুর রহমান কে দায়ী করেছিলেন মাহাথির এবং তার দল ইউএমএনও কে দোষারোপ করে টেংকু আবদুর রহমানকে কড়া ভাষায় চিঠি লেখেন ও পদত্যাগের পরামর্শ দেন। ফলস্বরূপ দল থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি।

১৯৭২ সালে  রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন ঘটে মাহাথিরের। নির্বাচিত হন সিনেটর। ১৯৭৪ সালে সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করলে  শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন মাহাথির মোহাম্মদ।

পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তুন হোসেনের শারীরিক অসুস্থতার দরুণ মাহাথিরকে উপ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এর মাঝে ইউএমএনও প্রধান টেংকু আব্দুর রহমান মারা গেলে দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নেতা হিসেবে  ১৯৮১ সালের নির্বাচনে মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মাহাথির মোহাম্মদ।

এরপর টানা ২২ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৩ সালে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে সরে আসেন তিনি। তবে দীর্ঘ ১৫ বছর রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মাহাথির ২০১৮তে আবারো ক্ষমতায় আসেন। সে প্রসঙ্গে একটু পর আসছি।

ক্ষমতার ২২ বছরে মাহাথির পুরো মালয়েশিয়ার চিত্র বদলে দেন। তার শাসনামলে মালয়েশিয়া বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে। মাহাথিরের মালয়েশিয়াকে বদলে দেওয়ার বিষয়টি অল্প কথায় বলা অসম্ভবই বটে।

মালয়েশিয়ানদের শিক্ষার ৯৫ ভাগ ব্যয় ভার সরকার বহন করে। এই নীতি মাহাথিরের আমল থেকে চালু হয়। আশির দশকে গৃহীত ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি শক্ত হাতে বাস্তবায়ন করা শুরু করেন তিনি। এই নীতির ফলে ১৯৯২ সালে নিজ দেশের সবাইকে কর্মসংস্থান দিতে সক্ষম হয় তার সরকার।

যে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার আজ মালয়েশিয়ার পর্যটন খাতের রূপই বদলে দিয়েছে সেটা এই মাহাথিরের আমলেই নির্মিত। এছাড়া সমুদ্র থেকে ৬,৩০০ হেক্টর জমি উদ্ধার, অত্যাধুনিক এয়ারপোর্ট তৈরি করা, একাধিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ,হাইওয়ে নির্মাণসহ তার অসংখ্য উদ্যোগ সফল হয়েছে ।

১৯৯০ সালেই প্রবদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ার ২০০২ সালে জিডিপি দাঁড়ায় ৯৫.২ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিতে ভীষণ দূর্বল থাকা মালয়েশিয়াকে তিনি শক্তিশালী অর্থনীতির তালিকাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ১৪ নম্বরে নিয়ে আসেন।

পরিবর্তনের ছোয়া লাগান সরকারি দপ্তরগুলোতেও। নিজের শৃঙ্খলা সফলভাবে ছড়িয়ে দেন সরকারি দপ্তরগুলোতে। উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত জনবল নিয়োগ দিতে তিনি ছিলেন বিশেষ ভাবে দক্ষ। তিনি প্রতিটি সরকারি প্রেজেক্ট রাজনীতির প্রভাবের বাইরে রেখে করেছিলেন এবং এমন একটি আমলাতন্ত্র গড়ে তুলেছিলেন নেন সময় আর অর্থ দুটোরই উপযুক্ত ব্যয় হয়।

আশির দশক এবং নব্বইয়ের শুরুটা ছিল মালয়েশিয়ার জন্য সুবর্ণ সময়। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের এই সময়টায় মাহাথিরের নেতৃত্বে মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে আসে।

২০০৩ সালে তিনি যখন ক্ষমতা ছাড়েন তখন মালয়েশিয়া এক অন্য দেশ। মাহাথির ক্ষমতায় বসার আগে মালশিয়ার মাথাপিছু আয় ছিল ১৩০ ডলার, শিক্ষিতের হার ছিল ২০ শতাংশ, দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো ৩৫ শতাংশ মানুষ।  কিন্তু তিনি যখন ক্ষমতা ছাড়েন তখন মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৩৩০ ডলার, শিক্ষিতের হার ৯০ শতাংশের বেশি।  মালয়েশিয়ায় ব্যক্তি খাতের বিকাশও এসেছে তার হাত ধরে।

মাহাথির ক্ষমতা ছাড়ার পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন নাজিব রাজাক।  এরপর নানান নাটকীয়তায় ২০১৮ তে আবারো ক্ষমতায় আসেন মাহাথির মোহাম্মদ। বিষ্ময়করভাবে মাহাথির ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে হাত মেলান। যোগ দেন পাকাতান হারাপান পার্টিতে। এরপর এক সময় তারই হাতে গড়া নাজিব রাজাক এবং নিজের পুরনো দলের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দীতা করে জিতে ক্ষমতায় আসেন।

দুই বছর পর আনোয়ার ইব্রাহিমের হাতে প্রধানমন্ত্রীত্বের ভার তুলে দেবেন এমন কথা বলে পাকাতান হারাপান জোট থেকে ২০০১৮ এর ৯ই মে প্রধানমন্ত্রী হন মাহাথির মোহাম্মদ। প্রায় দুই বছর পর নতুন সরকার গঠন নিয়ে দলীয় কোন্দলের মুখে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ(৯৫) পদত্যাগ করেন। তিনি একইসাথে নিজের রাজনৈতিক দল বারসাতু থেকেও পদত্যাগ করেছেন।

বর্তমানে মালয়েশিয়ার ৮ম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথিরের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন মুহিউদ্দিন ইয়াসিন যিনি কিনা মাহাথিরের প্রতিষ্ঠা করা রাজনৈতিক দলের সভাপতি।

কিন্তু মুহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনেছেন মাহাথির। এখন দেখা যাক রাজনীতির খেলায় পটু মাহাথিরের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হয়।

লেখক- মাহের রাহাত 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *