প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর: কী দিলেন, কেন দিলেন?3 min read
Reading Time: 6 minutesপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়ে গত ৫ অক্টোবর দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে দু‘দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এছাড়া ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দুই দেশের নেতারা তিনটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এটাই শেখ হাসিনার প্রথম দিল্লী সফর। এর আগে ২০১৭ সালে তিনি সর্বশেষ দিল্লি সফর করেন।
কেন হাসিনার দিল্লি সফর?
প্রধানমন্ত্রী কেন ভারত সফরে গিয়েছেন তা স্পষ্ট হবে সেখানে গিয়ে তিনি কী কী কাজ করেছেন বা কী কী বিষয়ে কথা বলেছেন তা সম্পর্কে জানলে।
প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে যে ৭টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে –
#১. Standard Operating Procedure (SOP) on the use of Chattogram and Mongla ports
#২. MoU on withdrawal of 1.82 cusec of water from Feni river by India for drinking water supply, scheme for Sabroom town, Tripura, India
#৩. Agreement concerning implementation of GoI Line of Credits (LOC) extended to Bangladesh
#৪. MoU between University of Hyderabad and University of Dhaka
#৫. Cultural Exchange Programme- Renewal
#৬. MoU on Co-operation in Youth Affairs
#৭. MoU on providing Coastal Surveillance System [তথ্য সূত্র]
৭টি সমঝোতার মধ্যে ৪, ৫ ও ৬ নং- এই তিনটি খুবই সাধারণ বিষয় নিয়ে। কিন্তু বাকি ৪টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। এরমধ্যে সবচেয়ে সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়টি ছিল MoU on providing Coastal Surveillance System বা বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে ভারতকে নজরদারি করার জন্য অনুমতি দেয়া।
কী ধরনের নজরদারির অনুমতি দেয়া হয়েছে তা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে।
ইকোনোমিক টাইমস লিখেছে–
“India and Bangladesh on Saturday inked a important MoU that will enable Delhi to set up a coastal surveillance system radar in Bangladesh besides deciding to further expand connectivity network corridors boosting Delhi’s Indo-Pacific strategy with Dhaka emerging as a key pillar in that vision.” [তথ্য সূত্র]
পত্রিকাটির প্রতিবেদনে important MoU শব্দ দুটি লক্ষ্যণীয়। ভারতের কাছে এই রাডার সিস্টেমটি স্থাপন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ভারতের ডেকান হেরাল্ড শিরোনাম করেছে, “India’s radars in Bangladesh to monitor Bay of Bengal”
ইন্ট্রোতে হেরাল্ড লিখেছে–
“India is set to get more eyes to keep watch on Bay of Bengal region as it inked a pact with Bangladesh to install a network of 20 radar systems along the coastline of the neighboring country.
The new network of Coastal Surveillance Radar Systems in Bangladesh will help India not only to detect any seaborne terrorist attack along its eastern coastline, but also to keep watch on its maritime neighborhood, where the Chinese People’s Liberation Army Navy (PLAN) has been frequently deploying its warships over the past few years.” [তথ্য সূত্র]
ভারত শেখ হাসিনার সফল থেকে কী অর্জন করেছে সে সম্পর্কে ধারণা পেতে আরও তিনটি প্যারা পড়ুন একই প্রতিবেদন থেকে–
“New Delhi first proposed the MoU with Dhaka for installing the coastal surveillance radar system in Bangladesh in 2015. Dhaka, however, was a bit cautious about accepting New Delhi’s proposal, as it was worried about the possibility of its implication on its relations with Beijing.
The professed objective of the radar systems India would set up in Bangladesh is to help the neighbouring country safeguard its sovereignty in its Exclusive Economic Zone (EEZ). Sources, however, told the DH that the network would also prove to be a strategic asset for India and help Indian Navy to detect and respond to any threat to its national security and sovereignty.
The spy planes of the Indian Navy last month tracked seven Chinese PLAN warships operating in and around the Indian Ocean region.”
অর্থাৎ, ভারত এই রাডার সিস্টেম স্থাপনের অনুমতির পেয়ে চীনের বিরুদ্ধে (এবং সম্ভাব্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের বিরুদ্ধে) বঙ্গোপসাগরে খবরদারি করার ব্লাংক চেক পেয়েছে। ভারতীয় পত্রিকার রিপোর্টেই তা স্পষ্ট। যদিও চুক্তিটি গোপন, কিছুই প্রকাশ করা হয়নি কোনো পক্ষ থেকে।
ভারতের আরেক পত্রিকা ফার্স্ট পোস্ট বলেছে–
“It will go a long way in assuaging India’s concerns over the growing influence of China and the presence of Chinese warships in the Bay of Bengal region.” [তথ্য সূত্র]
দেয়া হয়েছে ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফেনী নদীর পানিও:
ভারতের ফার্স্ট পোস্ট লিখেছে–
“In a much-needed relief for the people of Sabroom town in South Tripura, Bangladesh has agreed to let India withdraw 1.82 cusecs of water from Feni river for the residents of the border town. The negotiations, which were dragging on since the early 90s, finally came to fruition on Saturday as Hasina signed an MoU allowing the release of potable water to India.” [তথ্য সূত্র]
চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের চুক্তি করে ভারত কতটুকু লাভবান হয়েছে তার বর্ণনা দেখুন ভারতের পত্রিকায়। “Standard Operating Procedure (SOP) on the use of Chattogram and Mongla ports”- এই চুক্তি নিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম হলো–
“Indo-Bangladesh agreements to benefit Tripura, direct access to Chittagong, Mongla ports”
প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়েছে–
“Tripura will be a major beneficiary of the seven Indo-Bangladesh agreements signed during Bangladesh Prime Minister Sheikh Hasina’s recent visit to New Delhi. It will become the first Northeast state to have direct access to international sea trade routes, once the agreements are implemented.
“All these agreements will reap huge benefits for India at large. Among these, the first three points offer direct benefits to Tripura. After these agreements are implemented, Tripura will become the first Northeast state to have direct access to international sea trade routes. This will immensely boost the state’s trade and commerce potential,” a senior official from the Chief Minister Office said on Saturday.” [তথ্য সূত্র]
অর্থাৎ, শেখ হাসিনার ভারত সফরে সই করা সমঝোতা চুক্তিগুলোর সব ক‘টিই ভারতের জন্য চরমভাবে লাভজনক। লাভের খুশি লুকাতে পারছেন না ভারতীয় নেতারা।
“The CMO official said out of the seven agreements signed during the Bangla premier’s visit to New Delhi, Tripura would be direct beneficiaries of three aspects while the rest would provide cascading effect on the rest.”
ভারতকে খুশি করলেন শেখ হাসিনা, কিন্তু বাংলাদেশ কী পেল?
এক কথায় বললে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি! ৭টি সমঝোতা চুক্তির দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট। একটিতেও বাংলাদেশের বিশেষভাবে পাওয়ার কিছু নেই। আছে দেয়ার কিছু। যা পাওয়ার পেয়েছে ভারত।
তিস্তা ইস্যু:
“শেখ হাসিনার দিল্লি সফর থেকে বাংলাদেশ আসলে কী পেল?” বিবিসির এক রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি–
“প্রধানমন্ত্রী মোদী জবাবে (তিস্তা চুক্তির) বলেছেন, তার সরকার তিস্তায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের (স্টেকহোল্ডার) সঙ্গে নিরন্তর কাজ করে চলেছে যাতে যত দ্রুত সম্ভব একটি তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করা যায়। এগুলো অবশ্য বিশেষ নতুন কোনও কথা নয়। আগেও বহুবার এই ধরনের কথাবার্তা দু‘দেশের পক্ষ থেকে শোনা গেছে।
নতুন যেটা তা হল, তিস্তা ছাড়াও আরও ছয়টি অভিন্ন নদীর (মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, দুধকুমার) জল কীভাবে ভাগাভাগি করা যায়, অবিলম্বে তার একটি খসড়া কাঠামো প্রস্তুত করতে দুই নেতা যৌথ নদী কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন। ভারত ও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, এই সাতটি অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে যে দ্বিপাক্ষিক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে – সেই একই ফর্মুলা ভবিষ্যতে তিস্তার ক্ষেত্রেও কাজে লাগানো যেতে পারে।
তিস্তা চুক্তির প্রশ্নে এই সফরে আদৌ যদি কোনও অগ্রগতি হয়ে থাকে, তা এটুকুই।”
বিবিসি-ই বলছে, ভারত সফরে শেখ হাসিনাকে তিস্তা নিয়ে পুরোনো আশ্বাসের কথাই শুনিয়েছেন শুধু মোদি। এই আশ্বাস শুনিয়ে শুনিয়েই সই করিয়ে নিয়েছেন তার দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৭টি চুক্তি।
রোহিঙ্গা ইস্যু:
এই ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের জন্য কী অবদান রাখার প্রতিশ্রুতি দিল সে বিষয়ে বিবিসির জানাচ্ছে–
“কিন্তু এগুলো কোনটাই বিশেষ নতুন কোন কথা নয়। বরং রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার প্রশ্নে ভারতের কাছ থেকে যে আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা বাংলাদেশ আশা করছিল, তা তেমন পূর্ণ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
ভারত এক্ষেত্রে তার দুই বন্ধু দেশ, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একটা ভারসাম্যের নীতি নিয়েই এতকাল চলেছে – শেখ হাসিনার এই সফরেও দিল্লির সেই মনোভাবেরই প্রতিফলন দেখা গেছে।”
ভারতের এনআরসি ইস্যু:
গত কয়েক বছর ধরে ভারতের নেতারা আসামের ৪০ লাখ (এবং বর্তমানে ১৯ লাখ) নাগরিককে বাংলাদেশে খেদানোর হুমকি দিয়ে আসছেন। এই বিষয়ে ভারত সরকারের আনুষ্ঠানিক অবস্থান কী তা নিয়ে কথাই বলেননি মোদি!
বিবিসির রিপোর্ট বলছে:
“ভারত ও বাংলাদেশ এদিন যে যৌথ বিবৃতিটি জারি করেছে, সেই সুদীর্ঘ বয়ানের কোথাও এনআরসি শব্দটির উল্লেখ পর্যন্ত নেই। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, “আমরা তো বরাবরই বলে আসছি জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাহলে আন্তর্জাতিক স্তরের একটি যৌথ বিবৃতিতে কেন তার উল্লেখ থাকতে যাবে?” [তথ্য সূত্র]
বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গাদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে একটি কথাও বলতে চায় না ভারত! অথচ ওই বৈঠকেই নিজেদের স্বার্থের পক্ষে সাত সাতটি চুক্তি সই করে নিয়েছে তারা!
প্রাপ্তি নেই, কিন্তু উদ্বেগ আছে:
ভারত সফরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জন্য একমাত্র যা নিয়ে এসেছেন তা হলো “উদ্বেগ”। ভারতকে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌশলগত সুবিধা হিসেবে বঙ্গোপসাগরে রাডার বসানোর অনুমতি দিয়েছেন তিনি। এতে আঞ্চলিক পরাশক্তি চীনের মধ্যে উদ্বেগ বাড়বে, বা বাড়ছে।
প্রথমত আসছে চীনের প্রসঙ্গ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশি নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতকে রাডার স্থাপনের অনুমতি দেয়ার বিষয়টি চীন ভালোভাবে নেবেনা। এ বিষয়ে জাগোনিউজের একটি প্রতিবেদনের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো-
‘বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ভারত রাডার স্থাপন করতে যাচ্ছে। মালদ্বীপ-শ্রীলঙ্কায় এমন রাডার লাগানো হয়েছে। তার কৌশলগত কারণ আছে। এমন কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশের উপকূলেও যদি রাডার লাগানো হয়, তাহলে চীন ভুল বুঝতে পারে’- বলছিলেন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্প্রতি ভারত সফর নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এ বিশ্লেষক। বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফর নিয়ে কারও মধ্যে আগ্রহ এবং কারও মধ্যে উচ্ছ্বাস ছিল। বিশেষ করে তিনটি ইস্যু নিয়ে আগে থেকেই আলোচনা হচ্ছিল। রোহিঙ্গা, তিস্তা ও এনআরসি। এ তিন ইস্যুতে বিস্তর কোনো আলোচনা হয়েছে অথবা কোনো ইতিবাচক খবর আছে- তা মিডিয়ায় দেখতে পাইনি।’
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এ নিয়ে হতাশা আছে। অথচ মানবতার কথা বলে আমরাই ভারতকে পানি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলাম।’
বাংলাদেশ-চীনের মধ্যকার সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘এ মুহূর্তে চীনকে বাংলাদেশের খুব বেশি দরকার এ কারণে যে, চীন বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ এবং চীনের সঙ্গে এখন বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক বড় হয়ে আসছে। চীন বাংলাদেশের উন্নয়নে ব্যাপক অর্থের জোগান দিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সমুদ্র অঞ্চলে ভারতের এমন নিরাপত্তা বলয় কার স্বার্থে? এ প্রশ্নের উত্তর কিন্তু সহজে মিলছে না। এসব নিয়ে ইতোমধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। আমি মনে করি, চুক্তির চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাওয়ার আগে আরও ভালো করে বোঝা উচিত। কারণ, একটি পক্ষকে খুশি করতে গিয়ে আপনি আর দশটি পক্ষকে নাখোশ করবেন না নিশ্চয়ই।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফর ব্যর্থ কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কূটনীতিক বিশ্লেষক নই। আমি নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্ব দেই। আমি উপকূলে রাডার স্থাপনের বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী ভারতের ব্যবসায়ী ও অর্থনৈতিক ফোরামে বাংলাদেশকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক ফোরামে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। এটি অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক উপস্থাপন বলে মনে করি। [তথ্য সূত্র]
মার্কিন সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত বেনার নিউজের “Bangladesh Gives India Greenlight to Install Surveillance Radar System” শিরোনামের প্রতিবেদনেও চীনের এই উদ্বেগের কথা উঠে এসেছে।