খেলা

এক যে ছিলেন হাবিবুল বাশার 1 min read

মার্চ ১৪, ২০২০ 5 min read

author:

এক যে ছিলেন হাবিবুল বাশার 1 min read

Reading Time: 5 minutes

মুস্তাফিজ উইকেট পেলেন, এগিয়ে এসে মাশরাফি ছোট ভাইয়ের মতো তাকে বুকে টেনে নিলেন, তামিম ভাঙা হাতে ১০ নাম্বারে নামবেন কিনা সংশয়, মাশরাফি পিঠ চাপড়ে সাহস যোগালেন। মাঠে বা মাঠের বাইরে চারদিকে যখন সংশয় আর দুয়ো, তখন নেতা হয়ে বাংলাদেশকে অন্য রূপ দিয়েছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। কিন্তু পেস ব্যাটারি মাশরাফির নড়াইল এক্সপ্রেস কিংবা অধিনায়ক মাশরাফি হবার গল্পটা লিখেছিলেন অন্য একজন। তার নাম হাবিবুল বাশার সুমন।

ভারতে বীরেন্দ্র শেবাগ, জহির খান কিংবা হরভজনের জন্য সৌরভ গাঙ্গুলীর নাম যতটা আসে, আমাদের আশরাফুল, আফতাব, শাহরিয়ার নাফীস অথবা মাশরাফির জন্য হাবিবুল বাশারের নাম সেভাবে শোনা যায়নি। ভারতের ‘ম্যান ইন ব্লু’ এর কারিগর যেমন সৌরভ গাঙ্গুলী, আমাদের উত্থানের ইতিহাসেও তেমন মিশে আছেন হাবিবুল বাশার সুমন।

মাশরাফি তখন সদ্য ক্রিকেটে এসেছেন। সখ্যতা ইনজুরির সাথে। মাঠের বাইরে আছেন বেশ কদিন হয়। এরইমাঝে একদিন অধিনায়ক বাশার তাকে বললেন, “তোর সামনে দুটো চয়েস আছে। খেলা ছেড়ে দিয়ে চিত্রা নদীর পাড়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারিস। তখন তোকে কেউ মনে রাখবে না। যদি ক্রিকেটেই বেঁচে থাকতে চাস, তাহলে তাড়াতাড়ি সেরে ওঠ।”

মাশরাফি ফিরেছেন। বাংলাদেশকে ক্রিকেটের বড় মঞ্চে অধিনায়ক হিসেবে বারবার চিনিয়েছেন। আর আড়ালে তখনো কাজ করেছেন হাবিবুল বাশার সুমন। নির্বাচক হয়ে মাশরাফিকে তুলে দিয়েছেন একের পর এক উদীয়মান ক্রিকেটার।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে খেলোয়াড় বাশারকেই সবসময় এগিয়ে রাখবেন ক্রিকেট ভক্তরা। ১০-১২টা সেঞ্চুরি তিনি করেননি। আন্তর্জাতিক বাদই দেয়া হোক, ঘরোয়া কিংবা লিস্ট- এ মিলিয়েও হয়ত শতক পেরোনো ইনিংস দশের বেশি হবেনা। কিন্তু শতক অনেকেই পাননি। মাইকেল ভন কিংবা মিসবাহ উল হক দুজনেই সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারের মাঝেও ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি পাননি। কিন্তু তাদের গড় ছিল ঈর্ষণীয়। তবে আমাদের হাবিবুল বাশারের গড়ও এমন আহামরি কিছু নয়, টেস্টে মাত্র ৩০.৮৭ এবং ওয়ানডেতে সেটা ২১.৬৮।

শতক হাঁকানোয় তেমন দক্ষ না হলেও “মিস্টার ফিফটি” নামে নিজেকে পরিচিত করতে পেরেছিলেন হাবিবুল বাশার

তবে এতকিছু ছাপিয়ে বাশার সবসময়ই ছিলেন নির্ভরতা, ছিলেন ড্রেসিংরুমের নেতা। ছিলেন মাঠের নেতা। সংখ্যায় কি আসে যায় যদি আপনি সাহস নিয়ে খেলতে নামেন!

হাবিবুল বাশারের গল্পটাও তেমন। চড়াই উৎরাই আর সাহসী ব্যাটিংয়ের।

হাবিবুল বাশারের শুরুটাই বেশ সাহসিক। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ১৯৭২ সালে জন্ম তার। কুষ্টিয়ার ছেলে বাশারের ধ্যান জ্ঞান ছিল ক্রিকেট। কিন্তু রাজধানী থেকে বেশ দূরের জেলা কুষ্টিয়ায় ক্রিকেট তখনো জমেনি। ১৯৮৮ সালে মাত্র ১৬ বছরে ঘর ছাড়লেন বাশার। উদ্দেশ্য শুধুই ক্রিকেট। বাশারের ভাষায়, “ক্রিকেটকে ক্যারিয়ার ভাবার বিশেষ সুযোগ ছিলো না ১৯৮৮ সালে। কুষ্টিয়া ছেড়ে ক্রিকেট খেলার উদ্দেশ্যে ঢাকায় চলে আসাটা আমার জন্য ছিলো বিশাল এক সিদ্ধান্ত।”

ভাগ্য নাকি সাহসীদের পক্ষে থাকে। ১৯৮৯ সালেই বাশার সুযোগ পেলেন ছোট মঞ্চে। এশিয়া ইয়ুথ কাপে ছিলেন। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে। অংশ নিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী আর অজয় জাদেজার মত ক্রিকেটারদের সমান মঞ্চে। এরপর ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ অফিসিয়াল দলের হয়ে আর ঘরোয়া ক্রিকেটে ছিলেন নিয়মিত মুখ। আর ঘরোয়া ক্রিকেটে ভাল ফলাফলের স্বীকৃতি মেলে ১৯৯৫ সালে এশিয়া কাপে ওয়ানডে অভিষেকের মধ্য দিয়ে।

তবে হইচই ফেলার মত কিছু করা হয়নি হাবিবুল বাশারের। সে গল্প অব্যাহত রইলো ১৯৯৭ এশিয়া কাপেও। তবুও কেনিয়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আনঅফিসিয়াল সিরিজে সুযোগ পেলেন। সেখানেই মিস্টার ফিফটি পেলেন প্রথম ফিফটি। টিকে গেলেন জাতীয় দলে।

দূর থেকে সিরিয়াস নেতা মনে হলেও খেলার মাঠে এমনই প্রাণবন্ত ছিলেন বাশার

তবে এতকিছুর পরেও ১৯৯৯ বিশ্বকাপ খেলা হয়নি তার। প্রাথমিক দলে সুযোগ না পেয়ে ভাবতে বসেছিলেন, এবারই কি তবে শেষ?

কিন্তু না! ইংল্যান্ড এ দলের বিপক্ষে লিস্ট এ ম্যাচে শতক আর ঘরোয়া দলে করলেন অনবদ্য পারফর্ম। ২০০০ সালের এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে এলো ফিফটি। এই ফিফটির জোরেই কিনা বাদ পড়তে পড়তেও চলে এলেন বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট দলে।

২৬ জুন। সাদা পোশাকে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। ১০ রানেই ওপেনার ফিরে গেল। হাবিবুল বাশার এলেন ক্রিজে। বুক চিতিয়ে লড়ে গেলেন। ৭১ রান করে জহির খানের বলে যখন ফিরলেন তখন বাংলাদেশের আস্থার নতুন নাম হয়ে গেলেন হাবিবুল বাশার সুমন। প্রথম ইনিংসে বিশাল সংগ্রহ বাংলাদেশের, কিন্তু ২য় ইনিংসে তালগোল পেকে গেল। দল অলআউট মাত্র ৯১ রানে। কিন্তু তার মাঝেও দ্বিতীয় ইনিংসে ৩০ রান করে আলো নিজের করে নিলেন বাশার।

২০০১ সালের আগেই ৬ টেস্টে ৫ ফিফটি করে ফেলেছিলেন হাবিবুল বাশার। ‘মিস্টার ফিফটি’ নামটাও তখনই নিজের করে নিলেন। এরপর জিম্বাবুয়ের সাথে টেস্টে একই ম্যাচে ছিল ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি আর ফিফটি।

মাশরাফির কাছে বাংলাদেশের ক্রিকেট লিজেন্ড কিন্তু হাবিবুল বাশারই

২০০৩ সাল। বিশ্বকাপ এলো। দলের মতই ব্যর্থ হাবিবুল বাশার। অধিনায়কত্ব ছাড়লেন খালেদ মাসুদ পাইলট। খালেদ মাহমুদ সুজনের নেতৃত্বে আর হোয়াইটমোরের কোচিংয়ে বাংলাদেশ গেল পাকিস্তানে। নিজের জাত সেখানে আবারও চেনালেন বাশার। ৩ টেস্টে গড় ৬৩ এর উপরে। তিন ফিফটির সাথে শতক একটি। সিরিজের ৩য় টেস্টে রশিদ লতিফের চৌর্যবৃত্তি আর ইনজামামের অনবদ্য ইনিংস না থাকলে জয় হয়তো বাংলাদেশেরই হতো।

২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ে আবার এলো বাংলাদেশে। অধিনায়ক হলেন বাশার। সে সফরে বাংলাদেশ জিতল একটি ওয়ানডে আর ড্র করল একটি টেস্ট। সেসময়কার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য সেটিই অন্যরকম কিছু। বাশার ফর্ম টানলেন আরো কিছুদিন। ক্যারিবীয় দ্বীপ সফরে পেলেন আরো একটি সেঞ্চুরি।

কিন্তু অধিনায়ক নিজের সবটা দিলেন ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর। নিজেদের শততম ম্যাচে বাংলাদেশ জিতল ভারতের বিপক্ষে। ব্যাটে বলে ম্যাচসেরা মাশরাফি হলেও সেদিন হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে অবাক ছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্ব।

এতকিছু যার হাত ধরে সেই বাশারই এনে দিলেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়। ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে দল জয় পায় ২২৬ রানে। দুই ইনিংসে হাবিবুল বাশার খেলেন ৯৪ আর ৫৫ রানের ইনিংস। সেই সাথে জিতে নেয় ওয়ানডে সিরিজটাও।

বাশারের অধিনায়কত্ব দেখা গেল পরের বছরেও। ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কার্ডিফ কাব্যেও অধিনায়ক ছিলেন বাশার। আশরাফুল সেঞ্চুরি হয়ত ঢেকে দিয়েছিল বাশারের কীর্তি। কিন্তু সবসময়ই আড়ালে থাকা বাশার সেদিনও ছিলেন।উজ্জ্বল।

২০০৭ সাল। আরেক বিশ্বকাপ। দলে সাকিব, তামিম আর মুশফিকের মত তরুণ। সাথে মাশরাফি। বাশারের দল ক্যারিবীয় দ্বীপে তুললো ঝড়। তাতে লণ্ডভণ্ড শচীন, দ্রাবিড়, গাঙ্গুলীর ভারত বিদায় নেয় গ্রুপ পর্ব থেকে। বাংলাদেশের ঝড় তখনো থামেনি। প্রথমবার সুপার এইটে গেল দল। সেখানে ৬৭ রানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিধ্বস্ত করলো হাবিবুল বাশারের বাংলাদেশ।

ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় বাশার অংশ নিয়েছিলেন ভারতের বিতর্কিত “আইসিএল” টুর্নামেন্টে

কিন্তু দল ভাল করলেও ব্যক্তি বাশার ছিলেন নিষ্প্রভ। দেশে ফিরতেই তাই প্রথম শুনলেন ‘অবসর কবে নিচ্ছো তুমি?’

বিশ্বকাপের পর ভারত সিরিজেই তাই নিজের শেষ ওয়ানডে খেললেন বাশার। কয়েক মাস পর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেললেন শেষ টেস্ট।

এরপরে নিষিদ্ধ আইসিএল ঘুরে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে যখন ফিরলেন তখন বয়স বেড়েছে অনেক। তবে শেষ ঘরোয়া ম্যাচে শতক হাঁকিয়ে নির্বাচকদের কিছু একটা ঠিকই জানিয়েছিলেন মিস্টার ফিফটি।

বাশার এখন নির্বাচক। বাংলাদেশ এখন ক্রিকেটের বড় এক নাম। সেই ১৯৮৯ সাল থেকে দেশকে একটানা নিজের সবটা দিয়েছেন কুষ্টিয়ার হাবিবুল বাশার। বাংলাদেশ ক্রিকেটে সামনে নিশ্চিতভাবে আরও এগিয়ে যাবে কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্থানের শুরুর কারিগর হিসেবে বাশারও হয়ে থাকবেন ইতিহাসের অংশ।

লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *