হংকংয়ের রাজপথ আন্দোলনে উত্তাল কেন?1 min read
Reading Time: 3 minutes“আমাদের পেছনে ফিরে যাবার উপায় নেই”
“আমরা অতীতে অনেক ছাড় দিয়েছি, আর না!”
কথাগুলো হংকং এর রাস্তায় নেমে আসা লাখো মানুষের, যারা একটি সম্পূর্ণ বিবেকহীন বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেছে। বিলটি হংকংয়ের অবস্থান এবং হংকংয়ের উপর চায়নার প্রতিপত্তির ব্যাপার। কিন্তু হংকংয়ের সাধারণ মানুষের কাছে এটি তাদের স্বাধীনতার প্রশ্ন।
স্ফুলিঙ্গের শুরু
৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮। এক তরুণ যুগল, চ্যান টং কাই এবং পুন হিউ উইং, হংকং থেকে তাইওয়ানে ছুটি কাটাতে যায়। কিন্তু ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখ তাদের মধ্য থেকে শুধুমাত্র চ্যান ফিরে আসে। ঘটনার এক মাস পর চ্যান স্বীকার করে যে, সে তার অন্তঃসত্ত্বা প্রেমিকা পুনকে হত্যা করেছে। তার শাস্তির দাবিতে পুনের পরিবার সোচ্চার হয়ে উঠলেও একটি সমস্যা দেখা দেয়। চ্যানকে শাস্তি দেবার কোন অধিকার হংকংয়ের ছিল না, কারণ হত্যাকান্ড ঘটে তাইওয়ানে। আবার চ্যানকে তাইওয়ানে ফেরত পাঠিয়েও আইনের আওতায় আনা সম্ভব ছিল না, কারণ হংকং এবং তাইওয়ানের মধ্যে কোন এক্সট্রাডিশন বা বহিঃসমর্পণ আইন ছিল না।
২০১৯ সালে হংকং সরকার একটি এক্সট্রাডিশন আইন প্রস্তাব করে যেখানে হংকং কোন অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনতে তাইওয়ানে পাঠাতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হল সেই একই আইন মেইনল্যান্ড চায়নার ক্ষেত্রেও খাটে। কিন্তু চীনের ত্রুটিপূর্ণ বিচার ব্যবস্থা হংকংয়ের বিচার ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলবে আশংকা করে হংকং এই আন্দোলনে জড়িয়ে পরে।
পেছন ফিরে দেখা
চীন এবং হংকং সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম শাসনব্যবস্থার দুটি দেশ যারা একটি খুবই জটিল রাজনৈতিক সম্পর্কে আবদ্ধ। আর এই এক্সট্রাডিশন বিল চায়নাকে হংকংয়ের উপর প্রভাব ফেলতে আরো শক্তিশালী করে তুলবে।
যদিও বলা যেতে পারে হংকং চায়নারই একটি অংশ। এর শুরুটা হয় ১৮০০ শতকের শেষ দিকে যখন চীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হতে থাকে। চীন হংকংকে ব্রিটিশ সরকারের কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয়। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত হংকং ব্রিটিশ কলোনির অংশ হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে একটি বিশেষ আইনের আওতায় ব্রিটেন চীনের কাছে হংকং হস্তান্তর করে। একে বলা হয়েছিল “এক দেশ, দুই নীতি” আইন। এই আইনে বলা হয় হংকং চীনের অংশ হলেও এতে নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার পূর্ণভাবে বজায় থাকবে, যেমন, ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা, প্রচার স্বাধীনতা ইত্যাদি। যা হংকং কে মেইনল্যান্ড চায়না থেকে পুরোপুরি ভিন্ন করে তোলে। কেননা চীনের বিচার ব্যবস্থায় প্রায়শই যারা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে তাদের দমন করতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ব্যবহার করা হয়। সেখানে নাগরিকের কথা বলার অধিকার অনেকটাই রহিত।
২০০৩ সালে, প্রায় ৫ লক্ষ হংকং বাসী একটি আইনের বিরুদ্ধে লড়ে যেখানে বলা হয় চীনের বিপক্ষে কথা বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ২০১৪ সালে লাখো হংকং বাসী তাদের নির্বাচনের ওপর চায়নার প্রভাবের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন আন্দোলনে লেগে থাকে। বর্তমানে হংকংবাসীর এই লড়াই চায়নার এক্সট্রাডিশন বিলের বিরুদ্ধে।
বাধা যখন গণতন্ত্র
এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা দেখে বোঝা যায় যে আসলে কত মানুষ এই আইনের বিপক্ষে। কিন্তু এই বিল পাস করতে হংকং এর পার্লামেন্টের সদস্যদের ভোটই যথেষ্ট। কারণ হংকং এর গণতান্ত্রিক ধাচটাই একটু আলাদা। চিফ এক্সিকিউটিভ অফ হংকং নির্বাচিত হন একটি ছোট কমিটির দ্বারা যা চায়না দ্বারা অনুমোদিত হতে হয়। যদিও তারা সরকার প্রধান তবুও তাদের আইন প্রনয়ণ করার কোন অধিকার নেই। আইন প্রনয়ণের জন্য রয়েছে লেজিসলেটিভ কাউন্সিল সংক্ষেপে লেজকো।
অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মত হংকংয়েরও রয়েছে নির্বাচিত প্রতিনিধি। রয়েছে ৭০ টি আসন। হংকং এর সিস্টেমে যে কয়টি সক্রিয় রাজনৈতিক পার্টি আছে তারা হয় প্রো ডেমোক্রেটিক অথবা প্রো চায়না। প্রতি নির্বাচনে প্রো ডেমোক্র্যাটরা জয়ী হলেও লেজকোতে অর্ধেকেরও কম সীট পায়। কারণ হংকং বাসীরা ৭০ টি সীটের মাত্র ৪০ টির জন্য ভোট দিতে পারে। বাকি ৩০ টি সীট বিভিন্ন ব্যবসায়ীক প্রতিনিধির দখলে থাকে। আর এই বড় বড় ব্যবসা খাত স্বাভাবিকভাবেই চীনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক রাখতে চায়। তাই স্বভাবতই এই সীটগুলো প্রো চায়না দলের সমর্থক। ১৯৯৭ সালে যখন হংকং -চীনের চুক্তি হয় তখন বলা হয়েছিল এই ৭০ টি সীট জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা হয়নি। বরং শুরু থেকেই প্রো চায়না দল লেজকো এর চালকের আসন নিয়ে নিয়েছে। অথচ তারা কোনদিনই ৫০% এর বেশি ভোট পেয়ে জেতেনি।
শেষ কথা
এইসব কারণে এই এক্সট্রাডিশন বিল হংকং বাসীর মধ্যে ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছে। লাখো মানুষকে টেনে এনেছে রাস্তায়। যদিও এটি চীনের বিরুদ্ধে হংকং এর প্রথম আন্দোলন নয়, কিন্তু এটিই সবচেয়ে বড়। অনেকের মতে এটি বেশ ভিন্ন। কেননা এতে রয়েছে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ। আইনজীবি থেকে শিক্ষক – সবাই এতে অংশ নিচ্ছেন। তবে সবচেয়ে বেশি অংশ নিয়েছে তরুণ সমাজ- যারা এই এক্সট্রাডিশন বিলের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা বিশ্বাস করে এই আন্দোলন শুধু তাদের জন্য নয় বরং হংকংয়ের ভবিষ্যতের জন্য। এই আন্দোলন হংকং সরকারকে কিছুটা হলেও বোঝাতে পেরেছে। ফলে বিলটি সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু তাতে এই আন্দোলন দমে যায়নি। বরং তারা এই বিলের সম্পূর্ণ রদ চেয়ে আন্দোলন কঠোর করছে। এই আন্দোলন এখন আর এক্সট্রাডিশন বিল রদের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নেই বরং হংকং বাসীর যে অধিকার রয়েছে তা রক্ষার আন্দোলন হয়ে উঠেছে।