বৈশ্বিক মহামারি: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির দৈন্য প্রকাশ করেছে যে সংকট1 min read
Reading Time: 4 minutes‘শনিবার (২৫ এপ্রিল) সকালে আশুলিয়ার নরসিংপুর এলাকার ‘সিগমা ফ্যাশন লিমিটেড’ কারখানার দেয়ালে ছাঁটাই সংক্রান্ত নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হয়। এতে কারখানার ৭০৯ শ্রমিককে ছাটাই করা হয়। প্রতিবাদে কারখানার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা।‘
এ তো গেলো বাংলাদেশের খণ্ডচিত্র। পুরো বিশ্বের অবস্থা কী?
করোনা ভাইরাসের প্রকোপে বিশ্বব্যাপী শুধু স্বাস্থ্য খাতেই নয়, অর্থনীতিতেও দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তার আশঙ্কা। সারাবিশ্বে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন শিল্প কারখানা থেকে কয়েক কোটি কর্মী ছাটাই হয়েছে, অনেক স্থানে কমিয়ে দেয়া হয়েছে কর্মীদের বেতন। ২০০৮-০৯ সালের মহামন্দার সাথে তুলনা করা হচ্ছে বর্তমান সংকটকে।
সরবরাহ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি, কারখানা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাসহ ভোক্তাগণও এই অবস্থার ভুক্তভোগী। ২০০৮ এর অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে অন্যান্য অর্থনীতিবিদদের সাথে কাজ করেছেন নোবেলজয়ী জোসেফ স্টিগলিজ। সম্প্রতি ‘People, Power, and Profits’ নামক বইও প্রকাশ পেয়েছে তাঁর।
ট্রাম্প প্রশাসনের কড়া সমালোচক স্টিগলিজ জানান, আগামী মাসেই আমেরিকার ৩০% লোক কর্মহীন হবে। পরবর্তীতে তা বাড়তে পারে। বিশেষত পুঁজিবাদের ফলে আমেরিকা তথা বিশ্ব বাণিজ্যের ধসের উপর তিনি আলোকপাত করেছেন বেশি। সম্প্রতি Investopedia-কে দেয়া স্টিগলিজের এক সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে দেয়া হলো এখানে।
আয় ও স্বাস্থ্যখাতে বৈষম্য
প্রশ্ন: আপনার মতে, এই মন্দার প্রভাব কতদিন থাকবে? আয় বৈষম্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং গোটা বিশ্বের সম্পর্ক কেমন হবে?
স্টিগলিজ: খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই প্রচুর বৈষম্য চলছে। কোভিড-১৯ এর ফলে জিনিসটা আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে। আয় ও সম্পদের চাইতে স্বাস্থ্যখাতে বৈষম্য আরও প্রকট। পুষ্টির বেলায় যে আমরা লবডঙ্কা তা টের পেয়েছি। স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা না করবার ফল এটা।
রিপাবলিকানরা এখন বলছে রাষ্ট্রের উচিত সব কাজ নিজে করা। এর মানে হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ কল্যাণের পুরো দায় ন্যস্ত থাকবে মার্কিনিদের হাতে। রাষ্ট্রের নিজস্ব বাজেট আছে, তারা ধার নিতেও অপারগ।
২০০৮ সালের চাইতে মন্দার প্রভাব বেশি হবে। শিক্ষা, কল্যাণ, গবেষণা সব ক্ষেত্রে কমবে ভর্তুকি, অভিবাসীরা দেশে ফিরতে বাধ্য হবে।
প্রশ্ন: ভৌগোলিক ও জাতিগত দিক থেকে এই মন্দায় কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে? আমরা দেখেছি, মহামন্দার ১০ বছরেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো আগের মতো দাঁড়াতে পারেনি। আজ থেকে ৫-১০ বছরে কী অবস্থা দাঁড়াবে?
স্টিগলিজ: প্রান্তিক মানুষের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হবে। বিশেষত যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন তাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
এর আগে মন্দায় আমরা দেখেছি মার্কিনীদের মধ্যে যারা ভাড়া বা পে চেকের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা একবারে পথে বসে গেছেন। যারা উচ্চ পর্যায়ে বা স্থায়ী কোন চাকরিতে আছেন তারা নিশ্চিন্ত হলেও অধিকাংশ পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তিটি হয় চাকরি হারাবেন নয়তো করোনার কবলে পড়বেন। এই দুরবস্থার জন্য দায়ী আমেরিকান সরকার। স্বাস্থ্যখাতে অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা এবং নাগরিকদের সুরক্ষা প্রদানে তারা ব্যর্থ।
সচ্ছল পরিবার ও বিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস নিলেও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। নিয়মিত ইন্টারনেট সেবা গ্রহণ এবং কম্পিউটারের মালিক হওয়া, দুটোই দরিদ্র জনগণের জন্য দুঃসাধ্য। শিক্ষার যেই শূন্যতা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, এর জন্য ভবিষ্যতে ভুগতে হবে।
করোনাভাইরাস সম্পর্কিত আমাদের সকল আর্টিকেল পড়তে ক্লিক করুন এখানে- কোভিড- ১৯
বিশ্বায়নের প্রভাব
প্রশ্ন: আমরা তো বিশ্বায়নে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। মহামারীর কারণে এর উপর দীর্ঘস্থায়ী কুপ্রভাব পড়বে। আপনার কী মনে হয়, সরবরাহ ব্যবস্থা, পণ্যের বৈচিত্র্যে এর প্রভাব কতটা খারাপ হবে?
স্টিগলিজ: ট্রাম্প সরকার বহুদিন যাবত যেই অ-বিশ্বায়নের কথা বলে আসছিলো, সেটাই পূরণ হবে। এর ফলে তুলনামূলক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবো আমরা, জীবনযাত্রার মান কমে যাবে।
মহামারীর ফলে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, আমাদের অর্থনীতি আসলে নির্ভরযোগ্য নয়। ক্ষণস্থায়ী লাভের উপর গোটা বাজার ব্যবস্থা বসে আছে। স্থিতিস্থাপকতা না থাকায় সরবরাহও সমস্যায় পড়েছে।
মহামারীর আগে লোকে নিশ্চিত ছিল এই ভেবে যে, তেলের, খাবারের, কাপড়ের একটা বিশ্ব বাজার স্থায়ীভাবে আছে। কিন্তু এখন বুঝেছে, কাজের সময় এগুলো পাওয়া যায় না। এ অবস্থা থেকেই আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চিন্তা মাথায় আসছে।
কোভিড–১৯ এবং তেলের দরপতন
প্রশ্ন: বৈশ্বিক সংকটে তেলের দরপতন কী নির্দেশ করছে? তার মানে কি মধ্যপ্রাচ্যের তেলের দৌরাত্ম্য শেষ, পথে বসবে তেল কোম্পানিগুলো? জলবায়ু পরিবর্তনে এর ভূমিকা কী?
স্টিগলিজ: তেলের দাম কমে যাওয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এখন একটি বড় সমস্যা। যেহেতু এই খানিজ তেল ও গ্যাস পরিবেশের জন্য ভালো নয়, সেক্ষেত্রে এর ব্যবহার কমানো উচিত। কিন্তু দাম কমার ফলে এর চাহিদা বাড়তে পারে, লোকে অহেতুক অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করতে পারে। এটা উভমুখী সমস্যা।
সবার জন্য সমান আয় ও শিক্ষা
প্রশ্ন: সবার জন্য সমান আয় ও শিক্ষার দাবিটা আরও বেশি জোরদার হয়েছে এই সময়ে। এটা কি সম্ভব?
স্টিগলিজ: উপাত্ত বলছে, আয়-শিক্ষার চেয়ে মানুষ চিকিৎসার উপর গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। এটা মৌলিক চাহিদা।
উচ্চশিক্ষার সহজলভ্যতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। মার্কিনীরাই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে হিমশিম খায়। আমাদের জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেশি। অস্ট্রেলিয়ার মতো ঋণভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা বা ইউরোপের মতো কম খরচে পড়াশোনার ধারণা কাজে লাগতে পারে।
কিন্তু যাই করুন, আয় বাড়ানো ছাড়া গতি নেই।
বিজ্ঞান ও গবেষণায় ভর্তুকি
প্রশ্ন: মহামারীর কারণে বিজ্ঞান ও গবেষণায় বিনিয়োগ বেড়েছে। কোভিড-১৯ না এলে আমরা কি এটা করতাম?
স্টিগলিজ: মহামারীর ফলে আমরা একসাথে কাজ করা শুরু করেছি। সরকার দূরদৃষ্টির প্রমাণ দেয়নি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও মিচ ম্যাককনেল সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কাজ করেননি। আমরা দেখেছি, ভেন্টিলেটর, সুরক্ষা সরঞ্জাম- সবকিছুরই সংকট। কিন্তু দিনশেষে ঐক্যই চাই।
দুর্যোগের ফলে আমাদের সীমাবদ্ধতা ও প্রস্তুতিহীনতা সামনে এসেছে। সব দেশেই রাষ্ট্র প্রধানেরা বুঝেছে বিজ্ঞান ও গবেষণা ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব। শুধু সংকটে নয়, সবসময়ই বিজ্ঞানের স্বার্থে কাজ করা প্রয়োজন।
সংকটে অর্থনীতি
প্রশ্ন: অর্থনীতির ভাষায় কিছু বলুন। যেমন- বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে প্রাথমিকভাবে কী ভাবছেন?
স্টিগলিজ: অর্থনীতিতে একটা কথা আছে- স্থিতিস্থাপকতা। অর্থাৎ আমরা আগে যেই অবস্থায় ছিলাম সেখানে আবার ফিরে আসা। এই মহামারীর আগে এই তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা হতো না। কিন্তু এখন হচ্ছে। পুঁজিবাদ ও বিশ্বায়নের ভুল ব্যবস্থাপনার কারণে এই স্থিতিস্থাপক অবস্থায় ফেরত যাওয়া আদৌ সম্ভব কিনা জানা নেই।
দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনে বাহ্যিক প্রভাব। এখন যেমন আক্রান্ত ব্যক্তির বাইরে যাওয়া নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কড়াকড়ি করছি, তেমনি জলবায়ু সংকটেও একতা প্রয়োজন।
লেখক- সারাহ তামান্না