ইতিহাস

সোভিয়েত ইউনিয়ন: পতিত পরাশক্তি1 min read

এপ্রিল ২৭, ২০২০ 4 min read

author:

সোভিয়েত ইউনিয়ন: পতিত পরাশক্তি1 min read

Reading Time: 4 minutes

সোভিয়েত ইউনিয়ন, একটি নাম, একটি পরাশক্তি। যার অস্তিত্ব ছিল ১৯২২ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। অর্থনীতি ছিল কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। ভূমি ও বাড়ির ব্যক্তিগত মালিকানা সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমন এক দেশ যা ছিল পুরোপুরি কার্ল মার্ক্সের আদর্শে পরিচালিত। বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ। যদিও আদর্শ অনুযায়ী প্রচার করা হতো যে, সব সম্পদের মালিক সোভিয়েত জনগণ। কিন্তু বাস্তবতা বিচারে সম্পদের মালিক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার। মূলত রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ১৯১৭ সালে এই রাষ্ট্রের সূচনা। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে হয়েছিল রুশ বিপ্লব। সে সময় মার্কস-অ্যাঙ্গেলসের অর্থনৈতিক-সমাজবাদী তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ ও প্রকাশ ঘটান লেনিন ও তার রাজনৈতিক দলের সদস্যরা। এর প্রভাব সারা বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপের মাঝে ব্যাপকভাবে দেখা যায়। সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থা স্নায়ুযুদ্ধ যুগে পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

আয়তন

সোভিয়েত ইউনিয়নে মূলত রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ এবং ট্রান্স ককেশিয়ান দেশগুলো যুক্ত ছিল, যার সাথে ১৯২৪ সালে তুর্কমান ও উজবেক যোগ দেয়। পরবর্তীতে ১৯২৯ সালে তাজিক সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক এবং ১৯৩২ সালে কিরিগ ও কাজাখ সোভিয়েত সোশ্যালিস্টরা ইউনিয়নে যোগ দেয়। ট্রান্স ককেশিয়ান অংশটিকে আর্মেনিয়ান, জর্জিয়ান ও আজারবাইজান এসএসআরে বিভক্ত করা হয়। ১৯৪০ সাল নাগাদ লাটভিয়ান, লিথুনিয়ান, এস্তোনিয়ান, মালদোভাসহ বাল্টিক সাগর পাড়ের আরও কিছু অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নে যুক্ত হয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়লে এ রিপাবলিকগুলো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আয়তন ছিল ২,২৪,০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার, যা সে সময়ের সর্ববৃহৎ দেশ। এই বিশাল রাষ্ট্রের মধ্যে ১১টি বিভিন্ন টাইম জোন ছিল। পূর্ব ইউরোপ থেকে শুরু হওয়া ইউনিয়নটি মধ্য এশিয়া হয়ে উত্তর এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যার রাজধানী ছিল রাশিয়ার মস্কোতে।

মানচিত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন

গঠনতন্ত্র

মূলত চারটি প্রজাতন্ত্র হতে সোভিয়েত ঐক্যের উৎপত্তি হলেও ১৯৯১ সালে ভেঙে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এই ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৫টিতে। এগুলো ছিল- আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্র, আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র, বেলারুশ প্রজাতন্ত্র, এস্তোনিয়া প্রজাতন্ত্র, জর্জিয়া প্রজাতন্ত্র, কাজাখস্তান প্রজাতন্ত্র, কিরগিজিস্তান প্রজাতন্ত্র, লাটভিয়া প্রজাতন্ত্র, লিথুয়ানিয়া প্রজাতন্ত্র, মলদোভিয়া প্রজাতন্ত্র, রাশিয়া প্রজাতন্ত্র, তাজিকিস্তান প্রজাতন্ত্র, তুর্কমেনিস্তান প্রজাতন্ত্র, ইউক্রেন প্রজাতন্ত্র, উজবেকিস্তান প্রজাতন্ত্র। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ঐক্য ভেঙে গেলে ভূতপূর্ব সোভিয়েত ঐক্যের ১৫টি প্রজাতন্ত্রের মধ্যে ১১টি নিজেরা একটি শিথিল জোট সৃষ্টি করে। যেটা স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রমন্ডল নামে পরিচিত। তিনটি বাল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া এই জোটে যোগ দেয়নি। এই রাষ্ট্রমন্ডলের মূল সদস্য থাকলেও তা থেকে তুর্কমেনিস্তানকে বর্তমানে সহযোগী সদস্য করা হয়েছে। তিনটি বাল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া ২০০৪ সালে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়।

নাগরিক সুবিধা

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিচালিত হতো কার্ল মার্ক্সের দর্শনানুসারে। রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত সবাই বিনামূল্যে শিক্ষা পেত। পানি, গ্যাস, সেন্ট্রাল হিটিংসহ নাগরিক বিভিন্ন সুবিধায় রাষ্ট্র প্রচুর পরিমাণে ভর্তুকি প্রদান করায় নাগরিকদের এ খাতে তেমন কোনো খরচ করতে হতো না। পেশা ও চাকরির শর্তানুসারে বেতন নির্ধারিত হতো। ছাত্রদেরকেও রাষ্ট্র বেতন প্রদান করত। সব চাকরিজীবীকে ডরমিটরিতে আবাসন প্রদান করা হতো। পরবর্তীতে সবাইকেই নিজস্ব বাসা প্রদান করা হতো। খুব অল্প কিছু বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন লোককে জীবনের শুরুতেই বড় অ্যাপার্টমেন্ট প্রদান করা হতো। মূলত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ছিল সোভিয়েত সমাজের বৃহত্তর অংশ। অত্যন্ত ক্ষমতাবান গুটিকয়েক পার্টি সদস্যকে রাষ্ট্রের তরফ থেকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হতো।

সোভিয়েতের ভাঙন

১৯৯১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৯১ সালে ভেঙে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সোভিয়েত ঐক্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ১৫টি নতুন প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। তিনটি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুশের নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে সই করেন।

১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার পর পূর্ব ইউরোপের বহু দেশে কমিউনিজমেরও পতন ঘটে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনো টিকে ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা তখন মিখাইল গর্বাচেভ। মূলত তখন থেকেই সোভিয়েতের ভাগ্যেও ভাঙনের দিন শুরু হয়।

১৯৯১ সালের আগস্টে গর্বাচেভের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে কট্টরপন্থি কমিউনিস্টরা। কিন্তু সেই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখানেই থেমে যায়নি সব কিছু। ১৫টি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অনেকগুলোতেই স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ইউক্রেনসহ অনেক ছোট ছোট প্রজাতন্ত্রে স্বাধীনতার দাবিতে গণভোটও হয়ে যায়। ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান। একই বছর ডিসেম্বরে বেলারুশে বৈঠকে বসেন তিনটি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের নেতারা। বৈঠকটি ডেকেছিলেন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট স্ট্যানিস্লাভ শুশকেভিচ। ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক এবং রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন যোগ দেন তার সঙ্গে। তবে ইউক্রেন বৈঠক বা আনুষ্ঠানিকতার ধার ধারেনি। নিজেদের ততদিনে তারা স্বাধীন ঘোষণা করে দিয়েছে।

যদিও বেলারুশ তখনো সে রকম ঘোষণা দেয়নি। আবার গর্বাচেভকে না জানিয়ে এ রকম একটা বৈঠকে বসা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ১৯৯১ সালের ৭ ডিসেম্বর রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন, ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক এবং বেলারুশের নেতা স্ট্যানিস্লাভ শুশকোভিচ পূর্ব বেলারুশের এক বিরাট খামারবাড়িতে রুদ্ধদ্বার এক বৈঠকে মিলিত হন।

রুদ্ধদ্বার এক বৈঠক

বৈঠক নিয়ে দুধরনের মন্তব্য পাওয়া যায়, বেলারুশের প্রেসিডেন্টের মতে, “বেলারুশে শীতকালে তেল এবং গ্যাসের সরবরাহ কিভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা করাই ছিল আমার মূল উদ্দেশ্য। আমাদের অর্থনীতি তখন সংকটে। আমাদের তখন এসব জ্বালানির মূল্য পরিশোধের ক্ষমতা নেই। আমাদের কেউ অর্থ ধার দিতে চাইছে না। সেজন্যে আমরা রাশিয়াকে অনুরোধ করতে যাচ্ছিলাম আমাদের সাহায্য করার জন্য, যাতে আমাদের শীতে জমে যেতে না হয়।”

কিন্তু অন্য সুর বাজিয়েছিলেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট। ক্রাভচুক বলেন, “শুশকেভিচ যখন তেল এবং গ্যাসের কথা বলছিলেন, তখন আমার মাথায় আসছিল না, তিনি কি বলছেন। আমি ভেবেছিলাম, আমরা সেখানে গিয়েছি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলার জন্য। দেশ তখন পরস্পরবিরোধী টানাপোড়েনে ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম। সংকটের কারণে মানুষ তখন অতিষ্ঠ। আমরা বেলারুশে গিয়ে বৈঠকে বসেছি দেশ কোনদিকে যাচ্ছে তা নিয়ে আলোচনার জন্য।”

আলোচনার পূর্ব নির্ধারিত বিষয় যাই থাক, তিন নেতাই ভালো করে জানতেন, গর্বাচভকে না জানিয়ে এরকম একটা বৈঠকে বসা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

পরদিন ৮ ডিসেম্বর আরেকটি বৈঠক শুরুর অল্প পরেই তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির লক্ষ্যে চুক্তির প্রথম লাইনটির ব্যাপারে একমত হন সবাই। লাইনটি ছিল এ রকম-

‘ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিষয় হিসেবে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস বা ইউএসএসআরের কোনো অস্তিত্ব আর নেই। ’

এই চুক্তির মধ্য দিয়ে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লেন। এর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। ক্রুভচিক ফোন করলেন রাশিয়ায় গর্বাচেভের কাছে। আর বেলারুশের শুশকোভিচ ফোন করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়রকে। বাদবাকি গল্পটা ১৫টি স্বাধীন দেশের জন্ম। আর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রুর পতনের।

লেখক- ঐশ্বর্য মীম 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *