সুতোমু ইয়ামাগুচি- মৃত্যু দেবতা দুবার হার মেনেছে যার কাছে1 min read
Reading Time: 3 minutes১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ভয়াবহ পারমাণবিক বোমার ক্ষত হয়ত শুকিয়ে গেছে কিন্তু জাপান বা পুরো পৃথিবী এখনো ভোলেনি সেই নারকীয় তাণ্ডব। নিমেষেই একেবারে মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল এই দুটি শহর। মানুষ থেকে শুরু করে কীটপতঙ্গ – বাঁচতে পারেনি কেউই। কিন্তু এর মধ্যেও এমন একজন মানুষ রয়েছেন যিনি শুধু একটি নয়, দু-দুটি পারমাণবিক হামলা থেকেই বেঁচে ফিরেছিলেন। যিনি ভাগ্যের লীলা খেলায় হিরোসিমা আর নাগাসাকি দুই শহরেই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বলে না, রাখে আল্লাহ, মারে কে!
ভাগ্যবিড়ম্বিত দিনের শুরু
সুতোমু ইয়ামাগুচি বেরিয়েছিলেন কাজের উদ্দেশ্যে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ইয়ামাগুচি তার কোম্পানি মিৎসুবিশি এর জন্য ৫০০০ টনের ট্যাঙ্কারের ডিজাইন সদ্যই শেষ করেছিলেন। তিনি অফিসে গিয়ে কাজ গুছিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন- এই চিন্তা করতে করতেই হিরোশিমার আকাশে বিমানের দেখা পান। তিনি দেখেন বিমান থেকে রূপালি রঙের চকচকে কিছু একটা নামছে। বোমা আন্দাজ করে তিনি মাটিতে ঝাপিয়ে পড়ে আঙুল দিয়ে কান ঢেকে ফেলেন। কিন্তু এটি সাধারণ কোনো বোমা ছিল না। ছিল মৃত্যুদূত। ইয়ামাগুচির পায়ের নিচের মাটি কেপে উঠেছিল সেদিন। বোমার তীব্রতায় ছিটকে পড়ে জ্ঞান হারান তিনি।
লাশের স্তুপ
জ্ঞান ফিরলে তিনি দেখেন তার চারপাশের শহর অন্ধকার আর ধোয়ায় ঢাকা। তার মাথার উপর ধোঁয়ার মেঘ, গায়ের চামড়া প্রায় ঝলসে যায় যায় অবস্থা। বোমার মূল কেন্দ্র থেকে তিন কিলোমিটার দূরে থাকলেও ইয়ামাগুচি সাময়িক ভাবে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, বাম কানে কিছু শুনতেও পাচ্ছিলেন না।
হতবিহ্বল ইয়ামাগুচি ছুটলেন মিৎসুবিশি অফিসের দিকে। কিন্তু অফিসের নাম নিশানাই ছিল না। দালানটি মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। চারপাশে লাশের স্তুপ আর পোড়া মাংসের গন্ধে আকাশ ভারি হয়েছিল। কোথাও যাবার জায়গা না পেয়ে, এই ধংসস্তুপ থেকে পালাতে ছুটলেন স্টেশনের দিকে, ট্রেন ধরতে। কিন্তু নদীর ওইপারে অবস্থিত স্টেশনে যাবার ব্রিজটাই নেই। বিপর্যস্ত ইয়ামাগুচি সিদ্ধান্ত নিলে তিনি তার নিজ শহর নাগাসাকিতে ফিরে যাবেন।
নিরাপদ আশ্রয় নাকি মৃত্যুর হাতছানি
সব হারিয়ে মানসিক ভাবে পর্যদুস্ত ইয়ামাগুচি ফিরে আসলেন তার নিজ শহর নাগাসাকিতে। ভেবেছিলেন সব দুঃস্বপ্নের বোধহয় শেষ হয়েছে। ৯ আগস্ট ইয়ামাগুচি নাগাসাকিতে অবস্থিত মিৎসুবিশি অফিসে গিয়ে বাকি কাগজপত্র জমা দিতে গিয়ে বসকে বোঝাচ্ছিলেন কেমন করে এক আজব বোমার আঘাতে পুরো হিরোশিমা শহর বাতাসে উড়ে গেছে৷ কিন্তু বস বিশ্বাস করতে নারাজ।
“পাগল নাকি! একটি মাত্র বোমা কিভাবে একটি পুরো শহর ধ্বংস করতে পারে?”
হয়ত এটিই ছিল তার শেষ কথা। কারণ সাথে সাথেই আরেকটি পারমানবিক বোমা আঘাত হানে নাগাসাকিতে। মজার ব্যাপার, এখানেও তিনি জিরো গ্রাউন্ড অর্থাৎ মূল হামলা কেন্দ্র থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ছিলেন।
ইয়ামাগুচির পরবর্তী জীবন
ইয়ামাগুচিই যে দুই পারমাণবিক বোমা হামলার শিকার হবার পরও বেঁচে যাওয়া বিশ্বের একমাত্র ব্যক্তি ব্যাপারটি কিন্তু এমনও নয়। প্রকৃতপক্ষে এমন মানুষের সংখ্যা মোট ১৬৫ জন। তবে ইয়ামাগুচিই জাপান সরকারে কাছে দু’বার হামলা থেকে বেঁচে যাবার স্বীকৃতি চাওয়ায় এটি কেবল তার ভাগ্যেই জুটেছিলো।
তবে এত পরিমান গামা রে শরীরে নিয়ে ইয়ামাগুচির বেঁচে থাকার কথা ছিল না৷ কিন্তু কোনো এক কারণ বশত তার ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্থ হলেও বাহ্যিক কোন বড় সমস্যা দেখা দেয়নি। মাথা ব্যথা, বমি, কানে না শোনার মত সমস্যা নিয়েই তার জীবন চলছিল।
বিজ্ঞানীদের হিসেবে এইরকম ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ নিয়ে মানুষের বেঁচে থাকারই কথা নয়, সেখানে সন্তান জন্মদান প্রায় অসম্ভব। আর হলেও সন্তানেরা বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেবে অথবা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে বাস করবে সারাজীবন৷ কিন্তু ইয়ামাগুচি তো সব অসম্ভবকেই জয় করেছেন, এটাই বা বাদ থাকে কেন!
পারিবারিক জীবন
৫০ এর দশকের শুরুতে ইয়ামাগুচি আর তার স্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন সন্তান জন্মদানের। পরবর্তীতে তাদের দুটি কন্যা সন্তান হয়, যাদের নাম নাওকো এবং তোশিকো। দূর্ভাগ্যকে আবারো ধোকা দিয়ে ইয়ামাগুচির দুই সন্তানই সুস্থ এবং কোন ত্রুটি ছাড়াই জন্ম নেয়। যদিও কিশোরী বয়সে অন্যান্যদের তুলনায় বেশি অসুস্থ থাকতেন কিন্তু তারপরও দুই বোন এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন।
মিসেস ইয়ামাগুচি ২০০৮ এ লিভার এবং কিডনির ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৮৮ বছর বয়সে মারা যান। হতে পারে এই ক্যান্সার নাগাসাকি বোমা হামলার কারণে হয়েছে অথবা এমনও হতে পারে স্বাভাবিক ভাবেই এই ক্যান্সার হয়েছিল।
আশ্চর্য ডিএনএ
ইয়ামাগুচি দুইবার এবং তার স্ত্রী একবার- মোট তিনবার পারমাণবিক রেডিয়েশন এর স্বীকার হওয়া বাবা মায়ের সন্তান হিসেবে ইয়ামাগুচি দম্পতির সন্তানেরা ছোটবেলায় স্বাস্থ্যগত দিক থেকে অন্যদের থেকে দূর্বল হলেও, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, ৭০ বছর পর, তাদের কারোরই ডিএনএ তে পারমাণবিক বোমার কোন প্রমাণ অবশিষ্ট নেই।
শেষের দিনগুলি
হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে হামলার ৬৫ বছর পরও সুস্থ সবল ভাবে বেঁচেছিলেন সুতোমু ইয়ামাগুচি। জন্ম দিয়েছিলেন তিনটি সুস্থ সন্তানেরও। অবশেষে ২০১০ সালে ৯৩ বছর বয়সে পাকস্থলীর ক্যান্সারে মারা যান তিনি।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেয়ে এই হাসিখুশি বৃদ্ধ তার কন্যা তোশিকোর সাথে বাস করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি তার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বইও প্রকাশ করেন। তার রয়েছে একটি কবিতার বইও।
“আমি চাই, আমার মৃত্যুর পরও হিবাকুশার (হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক হামলার স্বীকার ব্যক্তি) পরবর্তী প্রজন্ম এবং তাদের সন্তানেরা জানুক আমাদের সাথে কি হয়েছিল”-এটি ছিল তার শেষ ইচ্ছা।