featured অর্থনীতি বিশ্ব

সিল্ক রোড: প্রাচীন, দীর্ঘতম ও বিপজ্জনক বাণিজ্যিক রুট    1 min read

সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯ 5 min read

author:

সিল্ক রোড: প্রাচীন, দীর্ঘতম ও বিপজ্জনক বাণিজ্যিক রুট    1 min read

Reading Time: 5 minutes

সিল্ক রোড ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম ও ঐতিহাসিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক। এটি চীনের হান সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত সিল্ক রোড চীনের সাথে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোর বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। এছাড়াও সেসব অঞ্চলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে সংস্কৃতির বিনিময় ঘটেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৩০ অব্দ থেকে ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সিল্ক রোড এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাণিজ্যিক পথ ছিল। ইউনেস্কো সিল্ক রোডকে ‘ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট’ এ অন্তর্ভূক্ত করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে চীন সরকার ঐতিহাসিক এই বাণিজ্য পথটিকে পুনঃনির্মাণের উচ্চাভিলাষী ঘোষণা দিয়েছেন।

সিল্ক রোডের গোড়াপত্তন

সিল্ক রোড কোন একক রাস্তার নাম নয়। এটি কতগুলো বাণিজ্যিক স্থলপথের সমষ্টি যা চীন, মধ্য এশিয়া, মধ্য প্রাচ্য, আফ্রিকার কয়েকটি দেশ এবং ইউরোপকে যুক্ত করেছে। অনেকেই একে ‘সিল্ক রুট’ নামেও চেনে। ১৮৮৭ সালে জার্মান ভূতত্ত্ববিদ ফার্ডিন্যান্স ভন রিথোফেন সর্বপ্রথম এই নামটি ব্যবহার করেন। এশিয়ান সিল্ক থেকেই মূলত সিল্ক রোডের নামটি এসেছে। কারণ সেসময় সিল্ক বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই সিল্ক রোডের যাত্রা শুরু হয়েছিল। অত্যন্ত মূল্যবান, বিলাসবহুল ও শৌখিন এ পন্যটি মধ্য এশিয়ার তৎকালীন বণিকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। তারা স্বর্ণ, পশম, কাচের জিনিসপত্র, ঘোড়া ইত্যাদির বিনিময়ে চীন থেকে রেশম নিয়ে যেত। দেখতে দেখতে চীনের সিল্ক বা রেশমকে ঘিরে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য জমজমাট হয়ে ওঠে। ফলে অচিরেই বণিকেরা সহজে পণ্য আনা নেওয়া ও ভ্রমণের জন্য একটি নিরবচ্ছিন্ন পথের প্রয়োজন অনুভব করেন।

বণিকদের এই চাহিদা থেকেই খ্রিস্টপূর্ব ১৩০ অব্দে সিল্ক রোডের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ১৪৫৩ সালে বিখ্যাত অটোমেন সাম্রাজ্য চীনের সাথে বাণিজ্য বয়কট করে। এরপর থেকে চীন সিল্ক রোড বন্ধ করে দেয়। রেশম বাণিজ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন বাণিজ্য কেন্দ্র, পণ্য কেনা-বেচা, বিতরণ ও গুদামজাতকরণ এবং বাণিজ্য কাফেলার জন্য পানি সরবরাহের উৎস হিসেবে তৈরিকৃত পানির প্রবাহ প্রভৃতি কাজে সিল্ক রোড ব্যবহৃত হতো।

যেভাবে সিল্ক রোডের সৃষ্টি

সিল্ক রোডের যাত্রার ৩০০ বছর পূর্বে পারস্যের (বর্তমান ইরান) দ্য রয়্যাল রোডের যাত্রা শুরু হয়। এটা ইরান থেকে শুরু হয়ে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এটা নির্মাণ করেন ইরানের তৎকালীন শাসনকর্তা দারিয়াস I। রয়্যাল রোডের আশপাশের বিভিন্ন বাণিজ্য পথও আস্তে আস্তে এর সাথে যুক্ত হয়। তার মধ্যে মেসোপটেমিয়া থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং মিশর হয়ে উত্তর আফ্রিকা প্রভৃতি বাণিজ্য পথ প্রধান। মেসেডোনিয়ার রাজা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট রয়্যাল রোডসহ পারস্য পর্যন্ত নিজের সাম্রাজ্য বিস্তৃত করার পর রয়্যাল রোডের অনেকাংশ সিল্ক রোডের অন্তর্ভূক্ত হয়।

আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে সৃষ্ট সিল্ক রোডের প্রাথমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র চীন দেশের অভ্যন্তরে রেশম বাণিজ্য করতে ব্যবহৃত হতো। সেসময় চীনের কেন্দস্থল থেকে পশ্চিম প্রান্তীয় অঞ্চলসমূহে কাফেলারা রেশম পৌঁছে দিত। কিন্তু প্রায়ই পথিমধ্যে কাফেলারা মধ্য এশিয়ার ছোট ছোট আদিবাসী গোষ্ঠীর হামলার স্বীকার হতো। চীনের বিখ্যত হান সম্রাট হান উডি তাঁর জেনারেল ঝাং কিয়ানকে ঐ অঞ্চলে দূত হিসেবে নিযুক্ত করেন। অসাধারণ কূটনীতিবিদ ও আবিষ্কারক ঝাং কিয়ান আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করার জন্য বিভিন্ন ধরণের চেষ্টা চালাতে থাকেন। পাশাপাশি হান সাম্রাজ্যের রাজধানী চেং থেকে শুরু করে, বিস্তৃত পশ্চিমাঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য সেসব অঞ্চলে ঝাং কিয়ান তাঁর বিশাল বাহিনী মোতায়েন করেন।

নানা কৌশল ও সাহসিকতার বিনিময়ে কিয়ান বাহিনী নতুন অঞ্চলগুলো সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে আস্তে আস্তে পশ্চিমের বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঞ্চলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সমর্থ হয়। ঝাং কিয়ান তখন পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে বাণিজ্যের এক নতুন দ্বার উন্মোচন করেন। সেই সুযোগে চীনা বণিকেরা পশ্চিমা বিশ্বেও বাণিজ্য প্রসারিত করে। ঝাং কিয়ানের আদিবাসীদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের পর থেকেই মূলত ব্যবসায়ীরা সিল্ক রোডে নিরাপদে ভ্রমণ ও ব্যবসায়িক কাজকর্ম পরিচালনা করতে থাকে এবং সিল্ক বিশ্ব বাণিজ্যে পরিচিত হয়ে ওঠতে থাকে।

সিল্ক রোডের গুরুত্ব

চীন, ইরান, হর্ণ অব আফ্রিকা, ইউরোপ, কোরিয়া ও জাপানে সভ্যতার উন্নয়নে সিল্ক রোড অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। শুধুমাত্র সিল্ক রোডের কল্যাণে এ সমস্ত সভ্যতাসমূহের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। সিল্ক রোডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য সিল্ক হলেও এর মধ্য আরও নানান পণ্য কেনা-বেচা ও সংস্কৃতির বিনিময় হতো। এ পথ দিয়ে ধর্ম, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদির বিনিময় ঘটে। প্লেগের মতো রোগও সিল্ক রোডের মাধ্যমে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ৫৪২ সালে সিল্ক রোড ধরে এক ভয়ংকর প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং তা পৌঁছে যায় কনস্ট্যান্টিনোপল পর্যন্ত যা বাইজান্টিন সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে ফেলে।

অটোমান সাম্রাজ্যের সময়ে সিল্ক রোড বন্ধ হওয়ার পর বণিকেরা বাণিজ্যের জন্য সমুদ্রপথ বেছে নেয় যার হাত ধরেই শুরু হয় আবিষ্কারের নতুন অধ্যায়। এমনি করেই আধুনিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠার মাইল ফলক তৈরি করে দিয়ে যায় ঐতিহাসিক সিল্ক রোড।

সিল্ক রোডের নতুন রূপ

‘দ্য ইউরেশিয়ান ল্যান্ড ব্রিজ’ নামের রেল রোডকে অনেকে ‘নিউ সিল্ক রোড’ নামে অভিহিত করে। কেননা এটি চীন, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়াকে যুক্ত করেছে। ১৯৯০ সালে চীনের সাথে কাজাখস্তানের রেল সংযোগের মাধ্যমে এর কাজ শেষ হয়।

Image Source: dw.com

এরপর থেকে ধাপে ধাপে নতুন এ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের পরিধি বাড়তে থাকে। ২০০৮ সালে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ থেকে কাজাখস্তানের আলামাতি ও আসতানা পর্যন্ত রেল সংযোগ দেওয়া হয়। একই বছরের অক্টোবর মাসে চীনের জিয়াংতান থেকে জার্মানির হামবুর্গ পর্যন্ত ‘ট্রান্স ইউরেশিয়া লজিস্টিক ট্রেন’ নামক একটি রেললাইন চালু হয়। এ লাইনটি ২০১১ সাল থেকে চীন ও জার্মানির পণ্য পরিবহন করছে। ফলে এ দুদেশের পণ্য কন্টেইনার শিপে পরিবহন করতে আগে যেখানে ৩৬ দিন লাগত, এখন রেল রুটে পরিবহনের কারণে সেখানে মাত্র ১৩ দিনে পণ্য পৌঁছে যায়। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এ প্রকল্পের আওতায় একটি ট্রেন প্রথমবারের মতো চীন থেকে লন্ডনে পৌঁছায়। এর কিছুদিনের মধ্যেই মাদ্রিদ ও মিলানেও রেল সংযোগ দেওয়া হয়।

চীন সরকার মূল সিল্ক রোডকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ইউরোপের সাথে রেল সংযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশ্যে উচ্চগতি সম্পন্ন বুলেট ট্রেন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। এটা অনেকটাই পূর্বের সিল্ক রোডের বাণিজ্যিক সুবিধা অনুসরণ করে নির্মাণ করা হতে পারে।

এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চীন থেকে ইউরোপ পর্যন্ত নতুন এক বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। সেখানে তিনি পূর্ববর্তী সিল্ক রোডের আওতাভুক্ত দেশসমূহ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া ও পূর্ব আফ্রিকাকে অন্তর্ভূক্ত করার কথা বলেন। চীন সরকারের এ প্রকল্পকে ‘দ্য সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট অ্যান্ড দ্য টুয়েন্টি-ফার্স্ট সেন্সুরি মেরিটাইম সিল্ক রোড’ বা ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নামে ডাকা হয়। কেউ কেউ আবার এর নাম দেয় ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ বা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’।

চীন সরকার এ পরিকল্পনাকে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে সমালোচকেরা বলছেন, এটি বিশ্ব বাণিজ্যে চীন কেন্দ্রিক বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চীনের একটি পদক্ষেপ।

সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর প্রস্তাবিত সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্টের অন্তর্ভূক্ত দেশসমূহের মধ্যে রয়েছে— মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত মূল সিল্ক রোডের আওতাভুক্ত দেশসমূহ, পশ্চিম এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ। এর বাইরে বেল্ট বা বলয়ের বর্ধিত অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে যুক্ত করা হবে। এছাড়াও উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ বলয় প্রস্তাবিত হয়েছে। উত্তর বলয় মধ্য এশিয়া থেকে রাশিয়া হয়ে ইউরোপে যাবে। মধ্য বা কেন্দ্রীয় বলয় মধ্য এশিয়া থেকে পশ্চিম এশিয়া হয়ে পারস্য উপসাগর ও ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত যাবে। এদিকে দক্ষিণ বলয় চীন থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও পাকিস্তান হয়ে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত যাবে।

মেরিটাইম সিল্ক রোড

সামুদ্রিক এ রুটটিও সিল্ক রোড পরিকল্পনার অংশ। এ রুটে সমুদ্র পথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর জন্য দক্ষিণ চীন সাগর, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে বাণিজ্য পথ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

চীন শুধু স্থল ও জলপথেই বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা উত্তরমেরু অঞ্চলকেও এই ইকোনমিক বেল্টের সাথে যুক্ত করার জন্য চীন-রাশিয়া হয়ে বরফের তৈরি একটি সিল্ক রোড নির্মানের পরিকল্পনা করছে। এখন অপেক্ষার পালা, চীন তার পরিকল্পনার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারে।

লেখক- নিশাত সুলতানা 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *