দুর্ধর্ষ এক সিরিয়াল কিলার: টেড বান্ডি1 min read
Reading Time: 6 minutes‘হ্যালো ম্যাম, একটু সাহায্য করবেন?’
আপনার সামনে ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সুদর্শন যুবক,হাতে ভারি ব্রিফকেস। হাঁটতে খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছে তার। দয়াপরবশ হয়ে এগিয়ে ব্রিফকেসটা হাতে নিলেন আপনি, এগিয়ে দিলেন লোকটাকে তার গাড়ি অব্দি। স্বভাবতই ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য। কিন্তু এর বদলে যদি অন্য কিছু পান? কী ভাবছেন? কাড়ি কাড়ি টাকা বা রূপকথার মত ভাগ্যবদলের সুযোগ?
না, আপনার পুরস্কার হবে ‘মৃত্যু’।
বলছিলাম দুর্ধর্ষ সিরিয়াল কিলার টেড বান্ডির কথা। যার হাতে ৩০ জনেরও বেশি নারী খুন হয়েছে। বান্ডির মৃত্যুর ৩০ বছর কেটে গেলেও তাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ ও আতঙ্ক দুটোই সমানতালে আছে। সেই বান্ডিকে নিয়েই এই লেখা। চলুন জেনে আসি এই ঘৃণ্য ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু কথা।
পিতৃপরিচয়ে ধোঁয়াশা
১৯৪৬ সালের ২৪ নভেম্বর। আমেরিকার ভারমন্টের এলিজাবেথ ল্যান্ডহোমে ২২ বছর বয়সী ইলিয়ানর লুইস কাউয়েলের কোলে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক ছেলে। হোমটি ছিল অবিবাহিত মায়েদের সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য বিখ্যাত। সেই শিশুটির নাম রাখা হয় ‘থিওডর রবার্ট কাউয়েল’।
জন্মের প্রথম ৩ বছর এই থিওডর কাটায় তার নানা–নানীর সাথে, ফিলাডেলফিয়ায়। শুধু তাই নয়, কৈশোরের একটা বড় সময় পর্যন্ত তাকে বলা হয় স্যামুয়েল এবং ইলিয়ানর কাউয়েলই তার বাবা–মা।
টেডের আসল বাবা কে তা নিয়ে রয়েছে রহস্য। অনেকের মতে, বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা লয়েড মার্শাল তার জৈবিক পিতা, আবার কারো মতে জ্যাক অরদিংটন নামক নৌবাহিনী কর্মকর্তাই থিওর পিতা। তবে সবচাইতে ভয়ানক গুজব হচ্ছে, টেডের নানা অর্থাৎ স্যামুয়েলই হলো তার জৈবিক পিতা।
বেড়ে ওঠা
টেডের যখন ৩ বছর বয়স তখনই তাকে নিয়ে টাকোমায় পাড়ি জমান লুইস। সেখানেই লুইসের সাথে পরিচয় হয় জনি বান্ডির এবং তা গড়ায় পরিণয়ে। টেড তার সৎ বাবার পদবি গ্রহণ করলেও শ্রমজীবী এবং দরিদ্র হওয়ায় তাকে অবজ্ঞাও করতো।
কৈশোরের সময়টাতে খুব একটা সামাজিক ছিলনা টেড। বন্ধু সংখ্যাও ছিল নগণ্য। বইয়ের দোকানে গোয়েন্দা সমগ্র পড়তে গিয়েই সে আবিষ্কার করে পর্ণোগ্রাফির বই আর ভিডিও। সম্ভবত এই ঘটনাই তার পরবর্তী মানসিক বিকারকে প্রভাবিত করে। এছাড়াও প্রতিবেশিদের ঘরে আড়ে আবডালে চোখ রাখাও ছিল তার অভ্যাস।
চুরির দায়ে বেশ কবার ধরাও পড়েছিল সে। এতকিছুর মাঝেও স্কিইং এর শখ ছিল টেডের প্রবল। আর স্কি করবার টাকাটাও আসতো চুরির মালামাল বিক্রি করে।
প্রতিভা আর চাতুর্যের মিশেল
১৯৬৫ সালে হাইস্কুল পাশের পরই পুগেট সাউন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় টেড। পরের বছরই সে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে চাইনিজ ভাষা শিখতে ভর্তি হয়। ’৬৮ তে সেই বিষয় বদলে মনোবিজ্ঞানে ভর্তি হয় আবার। এই সময়েই টেড আবিষ্কার করে যাকে সে এতদিন বড় বোন হিসেবে জেনে এসেছিল, সেই লুইস আসলে তার মা।
এর পরপরই এলিজাবেথ ক্লেওফারের সাথে প্রেম শুরু হয় টেডের। সেই প্রেম চলেছিল ১৯৭৬ পর্যন্ত। তবে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল তাদের মধ্যে।
১৯৭১ সালে সিয়াটল সুইসাইড হটলাইন ক্রাইসিস সেন্টারেও কাজের অভিজ্ঞতা আছে তার। সে সময় তার সহকর্মী ছিল এন রুল, তৎকালীন সিয়াটল পুলিশ অফিসার। পাশাপাশি কাজ করেও রুল বুঝতে পারেননি বান্ডি এক দুর্ধর্ষ সিরিয়াল কিলার।
১৯৭৩ সালে পুনরায় পুগেট ল স্কুলে ভর্তি হয় সে। এরপরের বছর থেকেই তার ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড শুরু হয়।
বান্ডির প্রথম শিকার
টেডের দুষ্কর্মের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যখন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ক্যারেন স্পার্কের ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করে সে। রডের আঘাতে ক্যারেনের মৃত্যু না হলেও স্থায়ীভাবে মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যায়। এরপর লিন্ডা এন হিলিকেও একইভাবে খুন করে বান্ডি।
পরবর্তী ৫ মাসে তার হাতে খুন হয় ডোনা ম্যানসন, সুসান রেনকোরট, ক্যাথেলিন পার্কস, ব্র্যান্ডা ক্যারল এবং জরগান হকিন্স। টেডের প্রথম ভিক্টিম কে ছিল সেটা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও ’৭৪ সাল থেকেই যে প্রতি মাসে একজন করে তরুণী নিখোঁজ হচ্ছিল সে ব্যাপারটি নজরে আসে ওয়াশিংটন পুলিশের।
অপহরণ, হত্যা এবং
টেডকে শুধুমাত্র খুনি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলে বেশ অবিচারই করা হবে। কেননা তার হিংস্রতা শুধু হত্যাকাণ্ডেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। হত্যার আগে এবং পরে ভিক্টিমের দেহকে ক্রমাগত ধর্ষণ করতো সে। তবে এতেই শেষ না। হত্যাকাণ্ডের পর লাশ পচে গলে ওঠা না অব্দি চলতো তার এই বিকারগ্রস্ত আচরণ। টেড তার জবানবন্দিতে এও জানায়,’সারারাত লাশের সাথে কাটাতে আমার ভালো লাগতো। লাশ ফেলার জায়গাগুলোয় প্রায়ই যেতাম। ওগুলো কুকুর–শেয়ালে খেয়ে না ফেলা পর্যন্ত ধর্ষণ করতাম,বারবার।‘ এই জবানে আরও জানা যায়, ১২ জন নারীর শিরশ্ছেদ করে সেগুলো দীর্ঘদিন সংরক্ষণও করেছিলো টেড। কাটা মাথায় মেকাপ বসিয়ে নিজের বিকৃত যৌন লালসা মেটাতো সে।
টেডের এপার্টমেন্ট তল্লাশি করতে গিয়ে পুলিশ বেশ কিছু ভিক্টিমের মাথার খুলি, দেহের অংশ পায়। কথিত আছে, টেড তার ভিক্টিমদের মাংসেরও স্বাদ নিতো সময় সময়। ভিক্টিমদের দেহের অনেকাংশে পাওয়া কামড়ের গাঢ় দাগই এর প্রমাণ। এই নৃশংসতাকে টেড ব্যাখ্যা করতো অন্যভাবে। ‘ আমি আমার ভিক্টিমের সাথে দৈহিক ও আত্মিকভাবে মিলিত হতে চাইতাম। নির্যাতন ,ধর্ষণ যাই বলুন না কেন এর মাঝে একটা আনন্দ ছিল, পুরোপুরি গ্রহণ করে নেবার একটা আনন্দ। যেন আমি সেই দেহের একটি অংশ, আর সেও আমার।‘
কৌশলে হেরফের
বান্ডির হত্যা কৌশল সবসময় এক ছিলনা। প্রথমদিকে রাতকেই বেছে নিতো সে তার হত্যাকাণ্ডের জন্য। ক্রমান্বয়ে সেটা দিনের যেকোনো সময়ে চলে আসে। নারীদের আকর্ষণ করতে সে পুলিশের এবং দমকল কর্মীর পোশাক পরে বের হতো।তবে মাঝেমাঝে পঙ্গু সেজে নারীদের সমবেদনাও অর্জনও ছিল তার আরেক কৌশল। ভিক্টিম নারীদের তার ১৯৬৮ মডেলের ভক্সওয়াগন বিটল গাড়ির কাছে এনেই শাবল বা রডের আঘাতে অজ্ঞান করে ফেলতো। এরপর হ্যান্ডকাফ পরিয়ে গাড়িরই ব্যাকসিটের নিচে লুকিয়ে রাখতো তাদের দেহ। এরপর নিজ বাড়িতে বা কোন স্থানে নিয়ে শ্বাসরোধ, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করতো তাদের।
তরুণী বা যুবতী ছাড়াও টেডের ভিক্টিমের কাতারে আছে ২ শিশুও। তাঁদেরও ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে বান্ডি।
ভিক্টিমের ধরণ
তার মূল টার্গেট ছিল কলেজ পড়ুয়া নারীরা। প্রথমে ওয়াশিংটনই ছিল তার হত্যাকাণ্ডের স্থান। পরে তা উতাহ, কলোরাডো, ফ্লোরিডাসহ ৭টি রাজ্যে সংঘটিত হয়। এদের মধ্যে সিংহভাগ নারীই মাঝ বরাবর সিঁথি করতেন।
সন্দেহ পোক্ত স্কেচে
ছয় মাসের মাঝে ছয় নারীর নিখোঁজ সংবাদ আতঙ্কিত করে তোলে জনগণকে। তবে একেবারে দিনের বেলায় সাম্মামিশ স্টেট পার্কের ভিড় থেকে জেনিস এন ওট এবং মেরি নাসলান্ডের নিখোঁজ হওয়াটাই ঘুরিয়ে দেয় ঘটনার মোড়। তদন্তে জানা যায়, পার্কে উপস্থিত বহু নারীকেই এক লোক গাড়িতে ওঠার প্রস্তাব দিয়েছিল সেদিন, তার হাত নাকি ভাঙ্গাও ছিল। তাদের বর্ণনা অনুসারেই পুলিশ বান্ডির ছবি এঁকে ছেপে দেয় পত্রিকায়। আর এর ফলাফল? ৪ জন ব্যক্তি ফোন করে নিশ্চিত করে এই খুনির নামই টেড বান্ডি। তারা ছিলেন– বান্ডির সাবেক প্রেমিকা, এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহকর্মী এবং মনোবিজ্ঞানের এক শিক্ষক যিনি টেডকে পড়াতেন। তবে পুলিশ খুব একটা আমলে নেয়নি অভিযোগ। টেডের আইনে গ্র্যাজুয়েশন এবং ধোপদুরস্ত রেকর্ডই ছিল এর কারণ।
১৯৭৪ সালেই ওয়াশিংটন স্টেট ডিপার্টমেন্ট অফ ইমারজেন্সি সার্ভিসের সহকর্মী ম্যারি এন বুনের সাথে পরিচয় হয় টেডের যা পরে প্রেম ও টেডের বিচার চলাকালে বিয়েতে গড়ায়। এলিজাবেথের মত বুনেরও টেডের খুনে স্বভাব সম্পর্কে ধারণা ছিলনা ।
সন্দেহের তালিকায়
ওয়াশিংটন থেকে উতাহ হত্যাকাণ্ড– ক্রমে পুলিশ এবং এলিজাবেথের সন্দেহ গাঢ় হতে থাকে টেডের ব্যাপারে। ১৯৭৫ সালে সল্ট লেক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে। তার গাড়িতে পাওয়া যায় হ্যান্ডকাফ, শাবল, মুখোশ সহ নানান জিনিস। এমনকি বান্ডির বিটল কারেও ৩ ভিক্টিমের চুল খুঁজে পায় পুলিশ।
পলাতক বান্ডি
তবে এতেই শেষ হয়না বান্ডির কর্মকাণ্ড। ১৯৭৭ সালে কলোরাডোর ল লাইব্রেরি থেকে পালাতে সমর্থ হয় সে। তবে ৬ দিনের মাথাতেই ফেরত আসতে হয় জেলে। এর মাস ছয়েক পরেই জেল থেকে পালায় টেড। এর জন্য তার কৌশল ছিল বেশ হিসেবি। জেল ঘরেই শাবল দিয়ে ক্রমে সিলিং খুলে পালায় সে। তবে এর জন্য দীর্ঘ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত ছিল কম খেয়ে ওজন কমানোও, যেন সিলিংয়ে সহজেই সেঁধিয়ে যায় শরীর।
পালানোর ২ সপ্তাহ পর ১৯৭৮ এর ১৫ জানুয়ারি ফ্লোরিডার কাই ওমেগা হোস্টেলে আরেক দফা হত্যাযজ্ঞ চালায় টেড। ১৫ মিনিটের ব্যবধানে মারগারেট বাউমেন ও লিসা লেভিকে হত্যা ও ধর্ষণ করে সে। এরপর ক্যাথি ক্লেইনার ও ক্যারেন স্যান্ডলারের উপর চালায় নৃশংস যৌন নির্যাতন। তাদের মৃত্যু না হলেও দাঁত ও মুখ ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেদিনই শেরিল থমাসের এপার্টমেন্টে ঢুকে নির্যাতন করে তাকে, যার ফলে স্থায়ীভাবে শ্রবণ শক্তি হারায় শেরিল।
অবশেষে ফেব্রুয়ারিতে ১২ বছর বয়সী কিম্বারলে লিচকে হত্যার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় টেডের ঘৃণ্য এই অধ্যায়। এর পরপরই ধরা পড়ে সে।
শেষ পরিণতি
সম্পূর্ণ বিচারিক কার্যক্রমের দায়িত্ব বান্ডি নিজেই করে। এমনকি সে তার উকিলের কোন উপদেশ গ্রহণ করতেও ছিল নারাজ।
শেষ পর্যন্ত টেডের সমস্ত অপকর্ম প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য–প্রমাণের মাধ্যমে প্রমাণিত হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। ফ্লোরিডার রেইফোর্ড প্রিজনে থাকাকালে কার্যকর হয় আদালতের নির্দেশ। ১৯৮৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকাল ৭ঃ১৬ মিনিটে অবশেষে ইলেক্ট্রিক চেয়ারের মাধ্যমে এই দণ্ড কার্যকর করা হয়।