সাদ্দাম হোসেন: এক স্বৈরশাসকের উত্থান এবং পতন1 min read
Reading Time: 3 minutesসাদ্দাম হোসেন, পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম এক স্বৈরশাসক। ১৯৩৭ সালের ২৮ এপ্রিল হত দরিদ্র এক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা সাদ্দাম হোসেন ধীরে ধীরে ভয়ংকর এক নেতায় নিজেকে পরিণত করেন। তবে সব কিছুর যেমন শুরু আছে ঠিক তেমনই শেষও আছে। আমেরিকার ইরাক আক্রমণের ফলাফল স্বরূপ সাদ্দাম হোসেনের ২৫ বছরের শাসনামল শেষ হয়েছিল ২০০৩ সালে।
প্রাথমিক অবস্থায় সাদ্দাম হোসেন ইরাকের বাথ পার্টি’র নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে ইরাকী নেতা আবদুল করিমকে হত্যার চেষ্টার মাধ্যমে প্রথম তিনি খ্যাতি লাভ করেন। সেই সময় পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আহত অবস্থায় প্রায় চার বছর বিদেশের মাটিতে পালিয়ে বেড়ান তিনি। পরবর্তীতে দেশে ফিরে এসে প্রায় দুই বছরের মতো জেল খাটার পর তিনি পালিয়ে যান এবং বাথ পার্টিতে তিনি গুপ্ত ঘাতক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালে তার কৌশল অবলম্বন করে বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে এবং সাদ্দাম তার পাশবিক ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য আরেক ধাপ এগিয়ে আসেন।
আহমেদ হাসান আল বকর বাথ পার্টির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদে থাকলেও, তার পেছনে ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল সাদ্দাম হোসেনই মূলত কলকাঠি নাড়তেন। পরবর্তীতে শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে প্রেসিডেন্ট অবসর গ্রহণ করলে সাদ্দাম হোসেইন ইরাকের প্রেসিডেন্ট পদে আবির্ভূত হন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সাদ্দাম ইরাককে নিয়ে গিয়েছিলেন ইরানের বিরুদ্ধে এক রক্তস্নাত যুদ্ধে এবং এর ধরেই পরে কুয়েতের সাথে গালফ যুদ্ধের সূচনা হয়। নিজের সহযোদ্ধাদের লাশের উপর ভর করে প্রতিবারই সাদ্দাম হোসেন হাসছিলেন তার বিজয়ের পৈশাচিক হাসি। সাদ্দাম হোসেনের এই রক্তের হোলি খেলা থেমেছিল ইউনাইটেড ন্যাশনের হস্তক্ষেপে। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের যৌথ মিসাইল আক্রমণের মাধ্যমে সাদ্দাম হোসেনকে অবশেষে হার মানতে বাধ্য করা হয়।
সাদ্দাম তার পারিবারিক আত্মীয় এবং বন্ধুদেরও রেহাই দেননি। কেউ যদি তার একটু অবাধ্য হত, তবে সাথে সাথেই তাদের উপর নেমে আসত মৃত্যুর কালো থাবা। তার শাসনামলে তিনি অনেক মানুষকে হত্যা করেন, তার সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে ইরাকজুড়ে অনেক গণ কবর পর্যন্ত খুঁড়তে হয়েছিল। নিজের পরিবারের সদস্যদের প্রতিও সাদ্দাম ছিলেন চরম নির্মম। তার দুই মেয়ে জামাতা তার বিরুদ্ধচারন করার পর জর্ডানে আশ্রয় নিয়েছিল। সাদ্দাম তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে নিজের দেশে নিয়ে এসেছিলেন এবং নির্মমভাবে তাদের হত্যা করেছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে এমন বর্বরোচিত নিদর্শন খুব কমই দেখা যায়।
ইতিহাস অন্যায়ের প্রতিশোধ ঠিকই নিয়েছিল বিশ্বের ভয়ানক এই শাসকের চরম অপমানজনক পতনের মাধ্যমে। ২০০৩ সালে আমেরিকান সেনার এক দল ইরাকে এক গর্তের মধ্যে লুকানো অবস্থায় সাদ্দাম হোসেনকে আটক করেছিল। কারাগারে আটককৃত সাদ্দাম হোসেনের অপমানজনক ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল পুরো পৃথিবী জুড়ে। এমনকি শুধুমাত্র আন্ডারওয়্যার পড়া অবস্থার কিছু ছবিও পাওয়া গিয়েছিল ইন্টারনেটে, যে ছবিগুলো নিয়ে সে সময় বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল।
৬৯ বছর বয়স্ক সাদ্দাম হোসেনকে আটকের প্রায় মাস খানেকের মধ্যেই এপ্রিলের নয় তারিখে যখন বাগদাদে অবস্থিত তার বিশাল প্রতিকৃতটি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল, সেই মুহূর্তে সাদ্দাম হোসেন চুল দাঁড়ি ও জামা কাপড়ের জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় জেলের মধ্যে তার মৃত্যুর দিন গুনছিলেন।
সাদ্দাম হোসেন তার জনগণদের মধ্যে নিজেকে এতটাই পোক্ত করে নিয়েছিলেন যে, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও দীর্ঘদিন ধরে একদম সাধারণ জনগণের সাহায্যেই তিনি আমেরিকান বাহিনী থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। সাধারণ জনগণ হয়ত তখনও সাদ্দামের বিরুদ্ধে যেতে ভয় পাচ্ছিল, পাছে না আবার তিনি পুনরায় ক্ষমতায় এসে তার বিরুদ্ধচারনকারীদের ভয়াবহ কোন শাস্তি দেন!
তবে এতকিছুর মধ্য দিয়েও অনেকেই সাদ্দাম হোসেনকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একমাত্র নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিল। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান করা শক্তিশালী কোন নেতা বলতে তখন তারা কেবল সাদ্দাম হোসেনকেই দেখতেন। সেই স্থানে বসার মতো তেমন কোন নেতা আজ অবধি যেমন নেই, তখনও ছিল না।
আমেরিকার যে সৈন্য সাদ্দাম হোসেনের জেলের গার্ড হিসেবে ছিলেন, তিনি এক সাক্ষাৎকারে সাদ্দাম হোসেনকে “অদ্ভুত এক পাগল বৃদ্ধ” বলে আখ্যায়িত করে বলেন, জেলে বন্ধী অবস্থাতেও নাকি সাদ্দাম হোসেন নিজেকে ইরাকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দাবী করছিলেন এবং তার বিশ্বাস ছিল ইরাকের জনগণ তাকে এখনো ভালোবাসে।
অবশেষে বিশ্বের ইতিহাসে উদাহরণ স্থাপন করা বর্বর স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনকে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৮২ সালে দুজাইল শহরে সাদ্দাম হুসাইনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে সন্দেহভাজন ১৪২ জন ইরাকীকে একত্রে হত্যা করার কারণে ইরাকের এক স্পেশাল ট্রাইবুনালের বিচারের মাধ্যমে সাদ্দাম হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল।