শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের উপর যে হামলার কারণে আজো বিপর্যস্ত পাকিস্তান ক্রিকেট1 min read
Reading Time: 3 minutes“আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এ ধরণের ঘটনা তো ঘটেনি। পাকিস্তানীরা ভেবেছিলো ক্রিকেট তাদের দেশে ধর্মের মত। সুতরাং সন্ত্রাসবাদের ছোঁয়া অন্তত ক্রিকেটে লাগবে না। কিন্তু তারা আমাদের দিকেই গুলি ছুড়ছিল। গুলি লেগে জানালার কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে আমাদের ওপর পড়ছিলো। আমাদের গাড়ির ড্রাইভারে কাঁধে গুলি লেগে সে মারা গেল। রক্তে ভেসে যাচিছলো গাড়ির মেঝে।”
ঘটনার ৮ বছর পরে ২০১৭ সালে এসেও এভাবেই তরতাজা স্মৃতির কথা বিবিসিকে বলছিলেন ইংলিশ পেসার স্টুয়ার্ড ব্রডের বাবা এবং আইসিসি ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড। ৩ মার্চ, ২০০৯ সালে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের বাইরে উগ্র সন্ত্রাসবাদ তার কালো হাত রাখে ক্রিকেটের উপরে। ক্রিকেট পাগল পাকিস্তানে আতর্কিত হামলায় সেদিন প্রাণ হারায় অন্তত পাঁচ জন পুলিশ সদস্য, একজন গাড়ি চালক। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের ছয় জন খেলোয়াড়সহ আহত হন অনেকেই।
লাহোর হামলার অন্যতম সাক্ষী আম্পায়ার এহসান রাজা। স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে তিনি বলছিলেন-
“আমরা প্রথমে ভাবলাম দুই গ্রুপের মধ্যে লড়াই শুরু হয়েছে। আমরাই যে হামলার লক্ষ্য সেটা বুঝিনি, কারণ পাকিস্তানীরা ক্রিকেট পাগল জাতি।”
ম্যাচ অফিসিয়ালদের বাসে হামলা শুরু হলে এহসান তার পাশে থাকা ম্যাচ রেফারি ব্রডকে দ্রুত শুয়ে যেতে বলেন। ব্রড তুলনামূলক লম্বা হওয়াতে তখন বেশ অসুবিধা হচ্ছিল তার। ওদিকে গুলি লেগে মারা যান বাসচালক। তখনই বীরের ভূমিকা নেন পাকিস্তানের এহসান রাজা।
“ক্রিস এবং আমরা কজন ভয়ে চিৎকার করছিলাম, কারণ আমরা বুঝতে পারছিলাম আমাদের গাড়ির ওপর গুলি চলছে এবং আমরা ঘোরতর বিপদে। এক পর্যায়ে আমার মনে হলো যদি ক্রিস বা গাড়ির অন্য কারোর গায়ে গুলি লাগে সেটা আমার দেশের জন্য সর্বনাশ হবে। এটা ভেবে আমি উঠে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ আমি ক্রিসকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম। আমার গায়ে দুটো গুলি লাগে। একটা পিঠে, একটা পেটে। মারা যেতে পারতাম, কিন্তু ক্রিস আমার রক্ত আটকানোর চেষ্টা করছিলো।”
এহসান রাজা বেঁচে ফিরেছেন তবে নষ্ট হয়ে যায় তার একটি ফুসফুস। দেশের সম্মান বাঁচাতে না পারলেও জীবনের যুদ্ধে জয়ী ছিলেন এহসান রাজা। ২০১৭ সালে আবার ফিরেছেন মাঠের দায়িত্বে।
আরও পড়ুন- ২৬/১১ মুম্বাই হামলা, ২০০৮
তবে সেদিনের আরেকজন বীরের কথা কখনো ভুলবেনা কেউ। অন্তত সামারাবিরা, সাঙ্গাকারা কিংবা জয়াবর্ধনেরা। তিনি বাস চালক খলিলুর রহমান। ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার পরে নিরাপত্তার ইস্যুতে ২০০৯ সালে পাকিস্তান সফর বর্জন করে ভারত। পাকিস্তানের বিপদের বন্ধু হয়ে রাজি হয় শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এই সফরেই শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল শিকার হয় এই বর্বর হামলার।
এলোপাতাড়ি গুলির সাথে শ্রীলঙ্কার টিম বাসে হামলা হয় রকেট লঞ্চারের মাধ্যমে। বাসের নিচে ছুঁড়ে দেয়া হয় বিস্ফোরক। কিন্তু শ্রীলঙ্কার টিম বাসের ড্রাইভার খলিলুর রহমান কোন কিছু পরোয়া না করে দ্রুতগতিতে বাস চালিয়ে দলকে রেখে আসেন গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে। তাই সেদিন ৬ জন আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যায় পুরো দল। কোনভাবে বাসের নিচে যদি বিস্ফোরণটি ঘটতো তাহলে তার ফলাফল কি হতো সেটি কল্পনা করাও কঠিন।
সেদিনের পর থেকে আজও স্বাভাবিক হতে পারেননি ২২ গজের আরেক কিংবদন্তি আম্পায়ার সাইমন টফেল। নিজের সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত আত্মজীবনীতে লিখেছেন-
“সেদিন থেকে যেকোনো জোরে আওয়াজ কিংবা গুলির শব্দ আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে।সেদিন নাস্তার টেবিলে ফ্লোরে আঘাত করা চামচের শব্দ এখনো আমাদের নিস্তব্ধ করে দেয়।আগেই চিন্তা করেছি এমন বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে কাজ করতে আমাদের বেশ সময় লাগবে, এমনকি এই ঘটনা পেছনে ফেলে সামনে এগোতে পারব কিনা এনিয়েও ছিল সন্দেহ।”
সফরের আগেই খারাপ কিছু হতে পারে এই ধারণা ছিল অস্ট্রেলিয়ান সাইমন টফেলের। কিন্তু পেশাদার মনোভাব প্রাধান্য দিয়ে ঠিকই ধরেছিলেন পাকিস্তানের ফ্লাইট। সফরের প্রথম ম্যাচ করাচিতে সফলভাবে শেষ হবার পরেও ভয় যায়নি তাদের। টফেলের দাবী, তারা আইসিসিকে বলেছিলেন সিরিজের ২য় টেস্টও যেন করাচিতেই হয়। কিন্তু ভেন্যু বদলায়নি পাকিস্তান। আর তাতেই যেন নির্বাসিত হয় পাকিস্তান ক্রিকেট।
আরও পড়ুন- মুম্বাই হামলা ১৯৯৩- যে হামলায় মৃত্যু উপত্যকায় রূপ নিয়েছিল মুম্বাই!
আরও পড়ুন- ফ্লাইট আইসি ৮১৪ হাইজ্যাকিং– এক মাসুদ আজহারের কাছে ভারতের পরাজয়
প্রায় ২০ মিনিটের সে হামলার প্রায়শ্চিত্ত আজো করতে হচ্ছে পাকিস্তানকে। যদিও লাহোরের সেই গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে ২০১৫ সালে খেলেছে জিম্বাবুয়ে। শ্রীলঙ্কা দলও দুই দফায় খেলেছে ওয়ানডে আর টেস্ট। এমনকি চলতি বাংলাদেশ সফরেও খেলা চলছে সেই গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতি আস্থা রাখেনি আর কেউ। ২০১১ সালে বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয়নি দেশটির। আগামী এশিয়া কাপ পাকিস্তানে হবার কথা থাকলেও ভারত ঘোষণা দিয়েছে এই এশিয়া কাপ বর্জনের। তাই যদি হয়, তবে ২০২৩ বিশ্বকাপ বয়কট করতে পারে পাকিস্তান।
ক্রিকেট পাগল পাকিস্তান বিগত দশ বছর ধরে কেবল প্রার্থনা করেছে আবার ক্রিকেট ফিরুক। লাহোর, করাচি, পেশোয়ার, ফয়সালাবাদ কিংবা মুলতানে হাজারো দর্শকের ভিড়ে হারাতে চায় পাকিস্তানের আরো অনেক সাধারণ মানুষ।