লোটে শেরিং: ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী1 min read
Reading Time: 3 minutesরাজনৈতিক অঙ্গনে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী এমন বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। তবে যারা রাজনৈতিক অঙ্গনে আসেন তারা অধিকাংশই পুরনো পেশা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। কিন্তু ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং এমন একজন রাজনীতিবিদ, যিনি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেও তার পূর্ববর্তী পেশা থেকে নিজেকে দূরে রাখেননি, বরং পূর্ববতী পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন।
লোটে শেরিং ভুটানের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে তৃতীয় ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। তিনি পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। ১৯৬৮ সালে ভুটানের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করা লোটে শেরিং শেরুবসের পুনাখা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৯১ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ২৮তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তিনি থাকতেন ময়মনসিংহ জেলা শহরের বাঘমারা কলেজ হোস্টেলের ২০ নম্বর রুমে।
তিনি এমবিবিএস পাস করে ঢাকায় ডাক্তার খাদেমুল ইসলামের অধীনে জেনারেল সার্জারি বিষয়ে এফসিপিএস করেন। ১০বছরেরও অধিককাল বাংলাদেশ অতিবাহিত করে ২০০২ সালে তিনি তার নিজ দেশ ভুটানে ফিরে যান। দেশে ফিরেই তিনি ডাক্তারির চাকরি নেন এবং তার প্রাক্তন রুমমেট ও বন্ধু টান্ডি দরজির মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন।
তবে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি যতটা না পরিচিতি পান, তার চেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করেন চিকিৎসক হিসেবে। ভুটানে যত বিশেষজ্ঞ ও নাম করা সার্জন রয়েছে তাদের মধ্যে লোটে শেরিং শীর্ষস্থানীয়। ইউরোলজিস্ট সার্জন হিসেবে তার সুনাম ও সুখ্যাতি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো ভুটান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। একটি সময় তিনি দিনে ১৫ থেকে ১৮ ঘন্টা পর্যন্ত অস্ত্রপাচারে ব্যস্ত থাকতেন। এমনকি কখনো কখনো ছুটির দিনগুলোতেও তাকে হাসপাতালে দেখা যেতো। এমন ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি “ভুটান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস(বিবিএস)” টিভি চ্যানেলের চিকিৎসা বিষয়ক অনুষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকতেন।
রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি রাজনীতির মাঠেও তিনি সগরম হয়ে ওঠেন। ২০০৮ সালে ভুটানে রাজতন্ত্রের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং দেশটিতে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়। এই সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ২০১৩ সালের নির্বাচনে লোটে শেরিং ও তার দল “ড্রাক নামরুপ শকবা” অংশগ্রহণ করে। কিন্তু সেই নির্বাচনে তার দল জয় লাভ করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে লোটে শেরিং সফলতার মুখ দেখেন। তার রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে এবং তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন।
এই সময়ে অনেকেই ভেবে নেয়, লোটে শেরিং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চিকিৎসা সেবা দেওয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন। কিন্তু সকলের ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে লোটে শেরিং প্রতি শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য বেছে নেন। লোটে শেরিং বলেন, “ছুটির দিনে মানুষ সাধারণত গলফ, তীরন্দাজি ইত্যাদি খেলতে পছন্দ করে কিন্তু আমি পছন্দ করি অসুস্থ রোগীর অস্ত্রোপচার করতে। এই কাজের মাধ্যমেই আমার সারা সপ্তাহের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি কেটে যায়। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমি এ কাজ করে যাব। এখন আমি প্রতিদিন হাসপাতলে আসতে না পারাটাকে খুব মিস করি। সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে যখন আমি গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাই, তখন বার বার মনে হতে থাকে যদি গাড়িটা ঘুরিয়ে হাসপাতালের দিকে যেতে পারতাম!”
এছাড়াও তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রির পাশাপাশি লোটে শেরিং বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
২০১৯ সালের এপ্রিলে লোটে শেরিং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের এক বিশেষ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। বন্ধু, সহপাঠী ও শিক্ষকদের পেয়ে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন এবং পুরনো বিভিন্নস্মৃতিচারণ করেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে এক অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তব্যও রাখেন।
তিনি বলেন, “প্রিয় শিক্ষার্থীরা, আমার কোনো সন্দেহ নেই যে তোমরা একদিন সার্জন হবে। তোমরা কতটা ভালো সার্জন হবে, সেটাই প্রশ্ন। ভালো সার্জন কোথা থেকে আসবে? পাঠ্যবই থেকে নয়। ভালো সার্জন হতে হলে যা প্রয়োজন, তার মধ্যে এক নম্বর হলো—ভালো মানুষ হতে হবে। আমি আশা করব এখানে যারা আছে, তারা সবাই ভালো মানুষ।”