মোহাম্মদ মুরসি: মুসলিম বিশ্বের কাছে মহান নেতার মর্যাদা পাওয়া এক ব্যক্তিত্ব1 min read
Reading Time: 3 minutesবিশ্ব রাজনীতিতে অনেক বড় নাম না হলেও মুসলিম বিশ্বে যিনি মহান নায়কের আসনে সমাসীন হয়েছিলেন; তিনি মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি। ১৯৫১ সালের ৮ই আগস্ট মিসরের শারকিয়া প্রদেশের আল-আদওয়াহ গ্রামে কৃষক ও দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা মোহাম্মদ মুরসি ইসলামিক ভাবাদর্শের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠেছিলেন। বাল্যকালেই তিনি কুরআনের হাফেজ হয়েছিলেন।
মুরসি ১৯৭৫ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক ও ১৯৭৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যালিফোর্নিয়াতে পিএইচডি শেষ করে ক্যালিফোর্নিয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। কিন্তু তিনি জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করতে পারেননি। তাই ১৯৮৫ সালে তিনি মিশরে ফিরে এসে জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। আর এখানেই তিনি ২০১০ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন।
পড়ালেখা ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৭ সাল থেকে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা শুরু করেন। ১৯৯২ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যপদ গ্রহণ করার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তবে সেই সময়ে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড সংগঠনটির জন্য প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা নিষিদ্ধ ছিলো। তাই তিনি স্বতন্ত্র পদপ্রার্থী হিসেবে ২০০০ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন নেতৃস্থানীয় নেতায় পরিণত হন।
২০১১ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি মিসরের জনগণের গণআন্দোলনের মুখে প্রায় তিন দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পতন ঘটে; ফলে দেশে জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মোহাম্মদ মুরসি মুসলিম ব্রাদারহুড ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি নামের একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। যদিও তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন তারপরও মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। বলা যেতে পারে মুসলিম ব্রাদারহুড ও মুসলিম ব্রাদারহুড ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি ছিল পৃথক নামের একই সংগঠন।
২০১২ সালের মে ও জুনে দুই পর্বের নির্বাচনে মোহাম্মদ মুরসির দল বিপুল সংখ্যক ভোট পেয়ে জয়লাভ করে এবং তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন মিশরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি। ক্ষমতাসীন হয়েই তিনি মুসলিমদের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের কল্যাণের জন্য তিনি মরণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই তিনি ফিলিস্তিনের গাজার নিকটবর্তী রাফাহ সীমান্ত খুলে দেন। এতে ইসরায়েল ক্ষেপে যায় এবং ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এই রাফাহ সীমান্ত বন্ধের জন্য মুরসির উপর চাপ আসতে থাকে। তারা মুরসিকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ১৯৭৯ সালে মিসর–ইসরায়েল শান্তি চুক্তি অনুসারে রাফাহ সীমান্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, কিন্তু মুরসি তার প্রতি কর্ণপাত না করেই তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। সীমান্ত খুলে দেওয়া ছাড়াও নানাভাবে তিনি ফিলিস্তিনের মুসলমানদের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
মুরসির সঙ্গে হামাসের সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি পেলে হামাস শক্তিশালী হয়ে উঠবে, আর তা ইসরায়েলের জন্য হতে পারে বড় হুমকিস্বরূপ এবং মুরসির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র বিস্তার লাভ করতে পারে; এমনই আশঙ্কা থেকে ইসরায়েল মুরসির পতনের জন্য উঠে–পড়ে লাগে। আবার মুরসি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করেন। এতে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ক্ষেপে ওঠে।
সেই সময় মুরসি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেয়ে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের সাহায্য সহযোগিতা বেশি গুরুত্ব দিছেন, গণমাধ্যমের বাক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে, সাংবাদিকদের কাঠগড়ার মুখোমুখি করা হচ্ছে, গির্জায় একাধিক হামলা হচ্ছে, নারীদের অধিকার হারা করা হচ্ছে এমনই নানা অভিযোগ নিয়ে মিশরের প্রগতিশীলরা মোহাম্মদ মুরসির বিরুদ্ধাচারণ শুরু করে। এভাবেই মুরসির উপর নানা দিক থেকে চাপ আসতে থাকে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র তো পিছু লেগেই আছে।
মুরসির ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মধ্যেই ২০১৩ সালের ৩০ই জুন মিসরের জনগণ নানা ধরনের উস্কানি পেয়ে মুরসির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এই সুযোগে মিসরের জনগণের এই বিক্ষোভের সঙ্গে যোগ দেয় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র। কথিত আছে, এই বিক্ষোভে এই রাষ্ট্রগুলো প্রচুর অর্থ যোগান দেয়। এই রাষ্ট্রগুলোর সমর্থনেই ২০১৩ সালের ৩ই জুলাই দেশটির তৎকালীন সেনাপ্রধান আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসি মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি করেন। এভাবেই মুরসির অতি অল্প সময়ের শাসনকালের যবনিকাপাত ঘটে।
মোহাম্মদ মুরসিকে বন্দি করে অন্ধকার কারাগারে প্রেরণ করা হয় এবং এরপর একের পর এক মিথ্যা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়। নির্বাচনে মিথ্যা তথ্য প্রচার করেছেন, এই অভিযোগে তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তারপর হামাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, এই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা চলে। আর এই মামলার শুনানিতেই বক্তব্যরত অবস্থায় ২০১৯ সালের ১৭ই জুন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। মুরসির মৃত্যুর পর পশ্চিমা-বিশ্ব, ইসরাইল, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত আনন্দিত হলেও ফিলিস্তিন, তুরস্ক, ইরানসহ অন্যান্য মুসলিম বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে আসে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান মুরসিকে শহীদ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মিসরীয়দের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন মুরসি। এ কারণে তিনি মুসলমানদের কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”
মূলত মোহাম্মদ মুরসির মতাদর্শ ও জীবনযাপনের ধরণই তাকে এমন নেতার আসনে বসিয়েছে। মোহাম্মদ মুরসি ফিলিস্তিনের মুসলমানদের জন্য যা করার চেষ্টা করেছেন তা ফিলিস্তিনি জনগণ কখনোই ভুলবে না। এছাড়াও তিনি অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। মানবিক সহায়তায় তিনি সর্বদাই আন্তরিক ছিলেন। মুসলমানদের কল্যাণে কাজ না করে বরং তিনি যদি পশ্চিমা বিশ্ব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং ইসরাইলের মদদ-পুষ্ট হয়ে থাকতেন, তবে তাকে বন্দী জীবনযাপন করতে হতো না বরং মিশরের শাসন ক্ষমতায় অধিককাল অধিষ্ঠিত থাকতে পারতেন। কিন্তু মোহাম্মদ মুরসি তার নীতি ও আদর্শ বিসর্জন দেননি।