মোহাম্মদ আলী: ক্রীড়া জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র1 min read
Reading Time: 4 minutesক্রীড়া জগতে জনপ্রিয় একটি খেলা হচ্ছে বক্সিং। আর এই বক্সিং ক্ষেত্রে উজ্জ্বল হয়ে, যে নামটি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে, সেটি হলো মোহাম্মদ আলী। শুধু এই খেলার জগতেই নয় বরং মানবহিতৈষী হিসেবেও এই নামটি প্রায় সবার কাছেই পরিচিত। তিনি তার যোগ্যতা, সক্ষমতা ও আদর্শ দিয়ে বিশ্ববাসীর মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন, এ কথা অনেকটাই নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই লেখাটিতে খ্যাতনামা এই ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের বর্ণাঢ্য জীবনবৃত্তান্ত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে। আপনি যদি মোহাম্মদ আলী সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য জানতে চান, তবে এই লেখাটি আপনার জন্যই।
মোহাম্মদ আলীর জন্ম ও বাল্যকাল
মোহাম্মদ আলীর জন্মের সময় নাম ছিল ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে জুনিয়ার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের লুইসভিল শহরে ১৯৪২ সালের ১৭ই জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে সিনিয়র। আর মায়ের নাম ছিলো ওডিসা গ্লাডি ক্লে। তার পিতা সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড ইত্যাদি রং করার কাজ করতেন এবং তার মা ছিলেন একজন গৃহিণী। বাল্যকালেই মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি বক্সিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করেন। মূলত তার একটি সাইকেল চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে, এই প্রশিক্ষণে হাতে খড়ি শুরু হয়। তার প্রথম কোচ ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার।
বক্সিংয়ের জগতে প্রবেশ
মুষ্টিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করেই, তিনি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা শুরু করেন। ১৯৬০ সালে মাত্র ১৮ বছরেই, তিনি পেশাদার মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হোন। ১৯৬০ সালের অলিম্পিকে লাইট হেভিওয়েট বক্সিংয়ে স্বর্ণপদক জিতে নেন। ১৯৬৩ সালে পেশাদার মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে লন্ডনে আসেন। লন্ডন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার পূর্বেই তিনি জয় লাভ করার আশা ব্যক্ত করেন।
লন্ডন প্রতিযোগিতায় তিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা হেনরি কুপারকে চতুর্থ রাউন্ডে ধরাশায়ী করেন এবং পঞ্চম রাউন্ডে হেনরি কুপারকে পরাজিত করতে সক্ষম হোন। ক্লে ১৯৬৪ সালে তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান সনি লিস্টনকে পরাজিত করে, হেভিওয়েট বক্সিংয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট প্রথমবারের মতো জয় করে। এই জয়ের মধ্য দিয়েই তার ঝুলিতে প্রথম বিশ্ব খেতাব আসে। মাত্র ২২ বছর বয়সেই বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন শিরোপা জেতেন, যা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়েছিল।
ধর্মান্তর ও পরবর্তী জীবন
সনি লিস্টনকে হারানো এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরপরই তিনি ধর্মান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নতুন ধর্ম হিসেবে তিনি ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করার জন্য ১৯৬৪ সালে নেশন অব ইসলামে যোগদান করেন। ১৯৬৪ সালের ৬ই মার্চে তার আধ্যাত্বিক গুরু এলিজাহ মোহাম্মদ তার নাম রাখেন মোহাম্মদ আলী। তখন তিনি তার পূর্ববর্তী নাম ক্যাসিয়াস মারসিলাস ক্লে থেকে নতুন নাম মোহাম্মদ আলী গ্রহণ করেন। তারপর থেকেই তিনি মোহাম্মদ আলী নামে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ করেন। এরপর তিনি ১৯৭৫ সালে এসে পরিপূর্ণভাবে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হোন।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তিনি আমেরিকান মুসলিমদের নিকট আদর্শ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে ওঠেন। মোহাম্মদ আলী ১৯৬৫ সালর নভেম্বর মাসে সাবেক চ্যাম্পিয়ন ফ্লুয়েড প্যাটারসনকে হারিয়ে শিরোপা জয়ের ধারা অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৬ সালে তিনি আবার হেনরি কুপারের সঙ্গে লড়াই করতে লন্ডনে আসেন। প্রথম সফরে তার তেমন কোনো ভক্ত ছিলো না বললেই চলে।
কিন্ত দ্বিতীয় সফরে ভক্তদের উচ্ছাস ও উল্লাস ছিলো চোখ ধাঁধানো। ১৯৬৭ সালে তাকে মুষ্টিযুদ্ধ খেলা থেকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। কারণ তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার পক্ষে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নিষেধাজ্ঞা রহিত করা হয়। তিন বছর নিষিদ্ধ ঘোষিত থাকার পর মোহাম্মদ আলী আবার বক্সিং জগতে ফিরে আসেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি মুখোমুখি হোন আরেক বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা জো ফ্রেজিয়ার। এই লড়াইকে শতাব্দীর সেরা লড়াই হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। বহুল আলোচিত এই লড়াইয়ে মোহাম্মদ আলী পরাজয় বরণ করেন। আর এই পরাজয় ছিলো তার প্রথমবারের মতো পরাজয়। তারপর ১৯৭৪ সালে জর্জ ফরম্যানকে হারিয়ে তিনি আবার বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এই প্রতিযোগিতাটির আরেকটি জনপ্রিয় নাম ছিলো রাম্বল ইন দ্য জঙ্গল। মুষ্টিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনিই দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি এই শিরোপা হারিয়ে আবার জিতে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তিনি ১৯৭৮ সালে লিওন স্পিংক্সের কাছে হেরে, প্রথম ব্যক্তি হিসেবে কোনো অপেশাদারের কাছে শিরোপা হেরেছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তবে ১৯৮০ সালে ল্যারি হোমসের নিকট থেকে শিরোপা জেতার জন্য আবার মুষ্টিযুদ্ধে ফিরে আসেন। কিন্তু ১১ রাউন্ডে এসে তিনি ল্যারি হোমসের কাছে পরাজিত হোন। তারপর তিনি ১৯৮১ সালে পুরোপুরি অবসর গ্রহণ করেন।
মোহাম্মদ আলীর পারিবারিক জীবন
মোহাম্মদ আলী মোট চারটি বিয়ে করেছিলেন এবং তার রয়েছে মোট ৯ জন সন্তান। ১৯৬৪ সালে সোনজি রয়কে বিয়ে করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে বিয়ের ১ বছর পরেই তার সঙ্গে ডিভোর্স হয়। তারপর ১৯৬৭ সালে বেলিন্ডা বয়েডকে বিয়ে করেন। ১৯৭৭ সালে বেলিন্ডকে ডিভোর্স দিয়ে ভেরোনিকা পোর্শেকে বিয়ে করেন। ১৯৮৬ সালে তার সঙ্গেও ডিভোর্স হলে ইয়োল্যান্ডা উইলিয়ামসকে বিয়ে করেন। মৃত্যু পর্যন্ত ইয়োল্যান্ডার সঙ্গেই সংসার করেন।
অর্জন
তিনি একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে তিনবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই কিংবদন্তি বক্সার ৬১টি লড়াইয়ে অংশ নিয়ে মোট ৫৬টিতেই জয় লাভ করেছেন। আর এরমধ্যে ৩৭টিতে প্রতিপক্ষকে নকআউট করে জিতেছেন। ১৯৯৯ সালে স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড তাকে শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় এবং বিবিসি তাকে শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মানিত করে।
১৯৭৮ মোহাম্মদ আলী বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে এবং পল্টনের বক্সিং স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয় তার নামে। ২০০১ সালে তার জীবনীকে ভিত্তিকে করে একটি সিনেমা তৈরি করেন উইল স্মিথ। ২০০৫ সালে মোহাম্মদ আলী ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ গ্রহণ করেন, তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের নিকট থেকে।
মৃত্যু
১৯৮৪ সালে মোহাম্মদ আলী পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হোন। ৩২ বছর এই রোগে ভুগে ২০১৬ সালের ৩ই জুন ৭৪ বছর বয়সে মোহাম্মদ আলী মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর মাধ্যমে বিশ্ব এক কিংবদন্তিকে হারিয়ে ফেলে।