রাফ কাট মোস্তফা সরয়ার ফারুকী1 min read
Reading Time: 4 minutesসালটা ২০০৩। গলিতে গলিতে, মোড়েতে পাড়াতে প্রতিদিন সকাল-বিকাল চলছে এক গান,
‘আমিতো প্রেমে পড়িনি,
প্রেম আমার উপর পড়েছে।‘
এরপরেই সিডিতে বাজছে এস আই টুটুলের,
‘কেউ প্রেম করে, কেউ প্রেমে পড়ে
আমার হয়েছে কোনটা?
জানেনা এই মনটা।’
শুধু গানের কল্যাণে নয়, সেই বছর মূল ধারার চলচ্চিত্র দর্শক থেকে শুরু করে বোদ্ধা সমালোচক সবাই চমকে উঠেছিলেন এক চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রের নাম ‘ব্যাচেলর’, পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ছবির কাহিনীকার জনপ্রিয় সাহিত্যিক আনিসুল হক। তবে শুধু গল্পের গাঁথুনির জন্যই নয়, পরিচালকের প্রজ্ঞা আর মুনশিয়ানার ছাপে সামাজিক সম্পর্কগুলোর অসংগতি নিপুণভাবে উঠে আসে সেলুলয়েডের ফিতায়, সিনেমার সংলাপ থেকে শুরু করে গান-চরিত্র সবকিছুই হয়ে ওঠে তরুণ-যুবাদের ক্রেজ।
সেবছর ‘New Jersey Independent South Asian Cine Fest , Third Eye IFF Mumbai , Asiatica filmmediale, Rome প্রত্যেকটির অফিসিয়াল সিলেকশনে ছিল এই ‘ব্যাচেলর’। এই ছবির কল্যাণে অপি করিম পান সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কারও।
শুরুর গল্প
ঢাকার নাখাল পাড়ায় বেড়ে ওঠা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী মিডিয়াতে যাত্রা শুরু ১৯৯৯ থেকে। হুমায়ূন পরবর্তী নান্দনিক ও বাস্তবধর্মী নাটকের পথিকৃৎ ধরা হয় তাকেই। আনিসুল হকের সাথে তাঁর জুটিতে আসে অসাধারণ সব কাজ। ‘স্পার্টাকাস৭১’, ‘চড়ুইভাতি’, ‘কানামাছি’ ও এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’র মতো নন্দিত টেলিফিল্মের পাশপাশি ‘একান্নবর্তী’, ‘সিক্সটিনাইন’, ‘৪২০’ এর মতো জনপ্রিয় সিরিয়ালের নির্মাতা ফারুকী। সর্বশেষ আনিসুল হকের ‘আয়েশামঙ্গল’ অবলম্বনে ‘আয়েশা’ নাটকটির মাধ্যমে পুনরায় টেলিভিশন পর্দায় ফিরেছেন তিনি। বরাবরের মতো এটিও পেয়েছে ভূয়সী প্রশংসা।
চলচ্চিত্রে নতুন আবাহন
নাটক দিয়ে দর্শকের সাথে যোগাযোগটা শুরু হলেও ফারুকী নিজেকে মনেপ্রাণে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে ভাবতেই ভালোবাসেন। তাঁর হাত ধরেই বাংলা চলচ্চিত্রে আসে অন্য এক নীরব বিপ্লব- ছবিয়াল।
প্রতিটি চিত্র পরিচালকের মতো ফারুকীরও আছে নিজস্ব গল্প বলার ভঙ্গিমা। ‘ব্যাচেলরে’ যেমন সম্পর্কের কথা বলেছেন ফারুকী, তারপরের ছবি ‘মেডইনবাংলাদেশে’ দেখিয়েছেন পলিটিক্যাল স্যাটায়ারের দুর্দান্ত চিত্র। ২০০৮ সালে ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে’ সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারটি যায় এই ছবির ঝুলিতেই।
থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার
আবারও আনিসুল হক আর ফারুকী! দুজনের কলম ধরে আসে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘তিন পর্বের জীবন ও কিছু বাস্তব কেস স্টাডি’ অবলম্বনে ‘থার্ডপারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ এর চিত্রনাট্য। মূল ছবিতে রূপদান করেন মোশাররফ করিম, নুসরাত ইমরোজ তিশা এবং গায়ক তপু। তরুণী রুবার জীবনের টানা পোড়েন এবং বাস্তবতার কালো চিত্র উঠে আসে এতে।
২০০৯ সালে মুক্তি প্রাপ্ত এই ছবিটি ‘পুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’, ’রোটেরডেম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’, ’ফ্রাইবুর্গ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’, ‘আবুধাবি চলচ্চিত্র উৎসবে’ অফিসিয়াল সিলেকশনে ছিল। এছাড়াও ২০১০ সালে ‘টিবুরন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’, ‘জোগজা- নেপটেক এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভালে’ – গোল্ডেন হ্যানোমেন এ্যাওয়ার্ডের জন্য নির্বাচিত হয় এটি। ২০১৪ সালে ‘কেস উইক চলচ্চিত্র উৎসবে’ প্রদর্শনীর পাশাপাশি ৮৩ তম অস্কারে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে এই ছবি।
‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার- ২০১০’ এ ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ এর ঝুলিতে আসে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা ও সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার।
থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ দিয়ে অন্য এক যাত্রা শুরু হয় ফারুকীর। এরপর ২০১২ সালে ‘টেলিভিশন’, ২০১৩ তে ‘পিঁপড়াবিদ্যা’, ২০১৭ তে ‘ডুব’ প্রতিটি চলচ্চিত্রেই নিজস্বতার সাক্ষর রাখতে থাকেন তিনি। ২০১৪ সালে ‘বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে’ সমাপনী ছবি হিসেবে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয় ‘টেলিভিশনে’র। সেবারই বুসানে ‘এশিয়ান সিনেমা ফান্ড ফর স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেন্ট এন্ড পোস্ট- প্রোডাকশন’ এর পুরস্কার জিতে নেয় এটি।
৮৬ তম অস্কারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বও করে এই ছবি। তবে শুধু ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ বা ‘টেলিভিশন’ই নয়, ফারুকীর প্রতিটি ছবিই অসংখ্য চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি বাহবাও কুড়িয়েছে প্রচুর।
বিতর্কের ধোঁয়া
দেশে বিদেশে অকুণ্ঠ প্রশংসার পাশাপাশি আলোচনা- সমালোচনাও কম হয়নি। বিশেষত ‘ডুবঃনো বেড অফ রোজেস’ এ প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জীবনের একটি অংশের সাদৃশ্য থাকায় তর্কবিতর্ক হয় প্রচুর। তবে এত কিছুর পরেও ফিল্ম বাজার ইন্ডিয়ার ‘দুবাই ফিল্ম মার্কেট এ্যাওয়ার্ড’ পায় ইরফান খান অভিনীত ছবিটি। ৯১ তম অস্কারেও বাংলাদেশের জানান দেয় ‘ডুব’।
সামনের কাজ
সামনে দেখা যেতে পারে ফারুকীর ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ যা ২০১৪ সালে –‘এশিয়ান স্ক্রিন এ্যাওয়ার্ডসে’ এমপিএ ফিল্ম ফান্ড এবং গোয়াতে অনুষ্ঠিত ‘ফিল্ম বাজার ইন্ডিয়া’য় ‘মোস্ট প্রমিসিং প্রজেক্ট’ হিসেবে জয় করে নিয়েছে তহবিল। একই সালে ‘বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে’ এটি ছিল এশিয়ান প্রজেক্ট মার্কেটের অফিসিয়াল প্রজেক্ট।
২০১৬ সালে ঢাকার হলি আর্টিজানে ঘটা সন্ত্রাসী হামলার ছায়া অবলম্বনে নির্মিত ‘শনিবার বিকেল’ নামক হার্ড হিটিং পলিটিক্যাল ড্রামা ভিত্তিক চলচ্চিত্র আছে মুক্তির অপেক্ষায়। ফারুকীর অন্যান্য চলচ্চিত্রের মতো এটিও রয়েছে আলোচনা- সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। দেশের ভাবমূর্তির জন্য এই ছবিটি ক্ষতিকর জানিয়ে সেন্সর বোর্ড আপাতত এই চলচ্চিত্রটির ছাড়পত্র স্থগিত করেছে। তারপরও ফারুকী থেমে নেই। ‘শনিবার বিকেল’ চলচ্চিত্রটি ৪১তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নতুন এ ছবিতে কাজ করছেন ফিলিস্তিনের অভিনেতা ইয়াদ হুরানি। এছাড়াও থাকছেন জাহিদ হাসান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, ইরেশ যাকের, মামুনুর রশীদ, কলকাতার পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ও।
ব্যক্তি জীবনের ফারুকী
২০১০ সালের ১৬ জুলাই অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কখনোই সরব থাকতে পছন্দ করেন না তিনি। তবে নানান সাক্ষাৎকারে চলে আসে তাঁর পছন্দ-অপছন্দের কথা। প্রিয় পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তমি। তিনি বলেন ‘কিয়ারোস্তমির ছবির স্বাভাবিকত্ব, অস্বাভাবিকত্বের ভেতরের হস্যময়তার যে হাতছানি, নীরবতার মধ্যে যে সংলাপ, সূক্ষ রসবোধ, সব মিলিয়ে তাঁর যে স্বতন্ত্র চিত্র ভাষা—এসবই আমাকে কিয়ারোস্তমির প্রতি হয়তো আকৃষ্ট করেছে। ফারুকী প্রিয় অভিনেত্রীর তালিকায় রাখেন তিশাকে। আর বইয়ের বেলায় প্রিয় বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।
উপসংহার
চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়াও লেখালেখি ও নানান কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত আছেন ফারুকী। ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে ‘রাফকাট’ নামে একটি বইও আছে তাঁর। যুক্ত আছেন ‘মেরিল-প্রথমআলো’র ‘আগামীর নির্মাতা’ উদ্যোগের সাথেও । ভবিষ্যতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অন্য রকম স্রোতের সাথে নারী নির্মাতারাও এগিয়ে আসবেন সেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি গত বছর এপ্রিলে ‘বেঙ্গল ক্রিয়েটিভ হাব’ আয়োজিত ‘ক্রিয়েটিভ ফেস্টে’।
ফারুকীর সব চলচ্চিত্র দেখলে এটা আপনাকে স্বীকার করতে হবেই যে সৃষ্টিশীলতার সীমাহীন জগতে এক পথে দ্বিতীয়বার হাঁটার অভ্যাস তার নেই। সময়ের সাথে তিনি নিশ্চয়ই আরও নতুন অচেনা-অজানা পথে যাত্রা শুরু করবেন এবং সেলুলয়েডের মায়াজালে তার সেই যাত্রার আনন্দ, বেদনার সহযাত্রী করবেন আপনাকে- আমাকে।