প্রাচীন যুগের ‘ভূত ভাবনা’ (প্রথম পর্ব): মেসোপটেমিয়া ও মিশর1 min read
Reading Time: 4 minutes‘জন্মিলে মরিতে হবে।‘ –এই অখণ্ডনীয় লিখন আমরা কমবেশি সবাই মেনে নিয়েছি। তাই বলে যে দুনিয়াজোড়া সবাই এই দৈবেই চলবে তা তো নয়। অমরসুধা, অমরত্ব– এসব ধারণার জন্মই হতো না তাহলে। আদিমকালের লোকেরা মৃত্যুকে স্বাভাবিক জানলেও অসীম জীবন ছিল আরাধ্য। তবে এসবের বাইরেও এক ধারণা লালন করতো প্রাচীন মানবসভ্যতা– ভূত বা অতৃপ্ত আত্মা।
আদিমযুগে মানুষ তার ব্যাখ্যার অতীত বিষয়কে ভূতুড়ে কাণ্ড বলে চালিয়ে দিতো। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ভূত নিয়ে গুঁতোগুঁতি খুব যে কমেছে তা নয়। ভূত বিশারদ প্রতিষ্ঠান যেমন আছে তেমনি ভুতকেন্দ্রিক গল্প লেখকও বেশুমার। আমাদের দেশেই তো মেছো ভূত, গেছো ভূত, শাঁকচুন্নি, পেত্নি, পানিমুড়ার এক গণ্ডা গল্প খুঁজে পাওয়া যাবে। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, সভ্যতার আদ্যিকাল থেকে মেসোপটেমিয়া, মিশর, গ্রিস, রোম, চায়না, সেল্টিক প্রভৃতি অঞ্চলেও ভূতেদের নিয়ে রয়েছে বিস্তর গবেষণা। ধারাবাহিকভাবে আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করবো। চলুন আজ জেনে নিই মেসোপটেমিয়ান ও মিশরিয়দের আদিম ভূত ভাবনা।
মেসোপটেমিয়দের ভাবনা
মেসোপটেমিয়ান সভ্যতা গড়ে উঠেছিল টাইগ্রিস–ইউফ্রেতিস নদীর তীরে। বর্তমান ইরাক,ইরান, তুর্কি,কুয়েত ও সিরিয়া নিয়েই ছিল প্রাচীনতম এই সভ্যতা। মানবজাতির ইতিহাসে মেসোপটেমিয়ান সভ্যতা গুরুত্বের সাথে স্মরণ করা হয় কারণ, এখানেই প্রথম লিখিত ভাষার উদ্ভব ঘটেছিল। কৃষিনির্ভর আদিম পৃথিবীতে সেচ ব্যবস্থাও আবিষ্কৃত হয় এখানেই। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের হাতেই মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার পতন হয় এবং এটি গ্রিক সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হয়।
লিখন পদ্ধতির গোড়াপত্তন যেহেতু এদের হাতেই হয়েছিল,অতএব ভূত বা আত্মা সম্পর্কে মানুষের ধারণার একটা স্বচ্ছ পাওয়া যায় এই সভ্যতার দস্তাবেজ থেকে। মেসোপটেমিয়ানরা বিশ্বাস করতো, মৃত্যুই মানুষের সর্বশেষ গন্তব্য। মৃত্যুপুরীর একটা গালভরা নামও ছিল– ইরকাল্লা।
এখানে বলে রাখা ভালো, এই ইরকাল্লা হচ্ছে নরক বা জাহান্নামেরই অনুরূপ ধারণা। ইরকাল্লা হলো এমন এক জায়গা যেখানে পাপীরা মৃত্যুর পর অনন্তকালের জন্য বাস করে। পূতিগন্ধময় কর্দমাক্ত ইরকাল্লায় একমাত্র খাবার হলো ময়লা– আবর্জনা। এ স্থানের একমাত্র অধিপতি হলো অন্ধকারের রানি ইরেশকিগাল। মানবজাতির সবচেয়ে পুরনো ( খ্রিস্টপূর্ব ২১০০) মহাকাব্য ‘গিলগামেশ’ এও এই ধারণার উল্লেখ আছে। তবে গিলগামেশে একে ‘এনকিডু’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইনকাল্লা থেকে কোন আত্মাই আর দুনিয়াতে ফেরত আসতে পারেনা। এর বিপরীত ধারণাই হলো স্বর্গের রানি ইনান্না; যে কিনা ইরেশকিগালের বোন। মেসোপটেমিয়ানরা বিশ্বাস করতো, রানি ইরেশকিগালের অনুমতিতে মাঝে মাঝে কিছু আত্মা পৃথিবীতে ফেরত আসে। তবে সে আগমনের পেছনে একমাত্র উদ্দেশ্য হলো , জাগতিক অন্যায়কে প্রতিহত করা।
আত্মার আগমন নিয়ে তাদের ধারণা ছিল বেশ অবান্তর। পরিবারের কোন সদস্যের অসুস্থতাকে ভরকৃত আত্মার প্রভাব ভাবা হতো। বিখ্যাত গবেষক রবার্ট বিগস এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ কোন পরিবারের সদস্য অসুস্থ হলে মনে করা হতো তার উপর মৃত কোন আত্মীয়ের আত্মা ভর করেছে এবং নতুন শরীরের মাধ্যমে যথাযথ শ্রাদ্ধের দাবি জানাচ্ছে। বিশেষত সেই আত্মা যদি অপঘাতে মৃত ব্যক্তির হয় তবে তো কথাই নেই। হয়তো সে জলে ডুবে গেছে অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেছে, ফলে ঠিকঠাক দাফন করা হয় নি।‘
মেসোপটেমিয়ান ডাক্তারদের আসু এবং আসিপু নামে ডাকা হতো। রোগীর চিকিৎসার পূর্বে আসিপুরা রোগীর পারিবারিক ইতিহাস জেনে নিতেন। পাশাপাশি মৃত্যুপুরীর হাল হকিকতও জিজ্ঞেস করতেন। সেকালে অসুস্থতাকে ভাবা হতো আত্মার কেরামতি বা পাপের শাস্তি।
মৃত্যুর পর দেহ থেকে যে আত্মা অবমুক্ত হয় তাকে বলা হতো ‘গিদিম’। ইরকাল্লা থেকে যেসব গিদিম মাঝেমধ্যে পৃথিবীতে ফিরে আসতো তারা কিন্তু সবসময় সুবোধ থাকতো না। অনেক গিদিমেরই মূল লক্ষ্য ছিল স্বাভাবিক জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত করা। এসব দুষ্ট আত্মাকে অন্ধকার ইরকাল্লাতে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থাও ছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায়। সূর্যদেবতা শামাশের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য এবং পূজার মাধ্যমে খারাপ আত্মাকে শাস্তি দেয়া হতো। এছাড়াও এদের দূরে রাখতে প্রাচীন অধিবাসিরা নানান তাবিজ,কবচ,আরাধনাও করতো।
মিশরীয় ধারণা
প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে মৃত্যু পরবর্তী জীবন কিংবা আত্মা– পুরোটাই ছিল সঙ্গিন বিষয়। অভিজাত গোত্রে মৃত্যুর পরের জীবনকে নিয়ে নানারকম চর্চা চলতো। মমিফিকেশনের ধারণাও ছিল পুনর্জন্মকেন্দ্রিক। তারা বিশ্বাস করতো, দৈহিক মৃত্যুর পর মানুষের আরেক জীবন শুরু হয়। প্রথমে আত্মা ‘হল অফ ট্রুথ’ বা সত্যমন্দিরে দেবতা ওসিরিস এবং ৪২ জন বিচারকের মুখোমুখি হয়। শুভ আত্মা সেই বিচারে পালকের মতো হালকা প্রতিপন্ন হলে তার ভাগ্যে জোটে শান্তি ও সমৃদ্ধির জগত। কিন্তু আত্মার ওজন ভারি হলে তাকে বিচারালয়ের মাটিতে ছুঁড়ে ফেলা হয়। এতেই শেষ নয়। শেষ ধাপে বিকটাকার দৈত্য সেই ঘৃণ্য আত্মাকে গলাধঃকরণ করে। মিশরীয় ‘Book of the Dead’ এ এই আচার পর্বের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
সেকালে একক আত্মাকে বলা হতো ‘খু’। পরে গোটা ধারণার ক্রমশ পরিবর্তনের ফলে পাঁচটি আলাদা সত্তার সাথে আত্মাকে যোগ করা হয়। এর মাঝে আত্মার মূল বস্তুকে ‘বা’ এবং ব্যক্তিত্বকে ‘কা’ বলা হতো। মনে করা হয়, এই কা এবং বা এর যোগেই মৃত্যু পরবর্তী আত্মা ‘আখ’ এ রূপান্তরিত হতো। এই আখই ভূত হয়ে দুনিয়ায় প্রত্যাবর্তন করতো।
মেসোপটেমিয়দের মতো এরাও ভাবতো, এই ভূতের মূল উদ্দেশ্যই হলো তার প্রতি করা অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়া অথবা দাফন কাজের ভুল শুধরে দেয়া। মিশরীয়দের মতে যেসব আত্মা দুনিয়াতে ফেরত আসতো তারাই ভূত। অন্যদিকে যারা ‘ফিল্ড অফ রিডস’ বা ‘নলখাগড়ার মাঠ’ এ যাবার অনুমতি পেতো তারা ছিল শুভ আত্মার প্রতীক।
অতৃপ্ত আত্মার ধারণা বিভিন্ন সময়ে অঞ্চলভেদে বদল হয়েছে। তবে এর সৃষ্টির ধারণাটা প্রায় একই। যেসব মানুষ অপঘাতে মারা পড়ে অথবা যথাযথ দাফন বা পূজা–আর্চা থেকে বঞ্চিত হয় –মূলত তাদের আত্মাই প্রতিশোধ বা শান্তির স্পৃহায় ঘুরতে থাকে। আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় ভূত বা ভূতের গল্পের। ভূত আছে কি নেই– এই তর্ক বহুদিনের। তবে যত প্রিয় ব্যক্তিই হোক না কেন, মৃত্যুর পর তার আকস্মিক ফেরত আসাটা খুব বেশি সুখকর যে নয় তা নিয়ে বিতর্ক নেই। ভূতবিদ্যা নিয়ে প্রায় সকল সভ্যতাই আগ্রহী ছিল। ধর্মীয় অনুষ্ঠান, তাবিজ, কবচ ও মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে অশুভ আত্মাকে দূর করা এবং জগতে শান্তি বজায় রাখাই ছিল আদিম মানুষের ঐকান্তিক ইচ্ছা।